আফগানিস্তানে একটি প্রাসাদের পুনঃসংস্কার করছেন মেয়েরা
১৪ জুন ২০১৭প্রায় চার দশকের যুদ্ধ ধ্বংস করে দিয়েছে নব্যধ্রুপদী এই স্থাপনাকে৷ ‘আমরা পারি'- এই কথাগুলো তিনতলা দালানের মাচায় বড় করে লেখা৷ প্রতিদিন যখন ওয়াঝমা কুররাম কাজে আসেন, তাঁর চোখে পড়ে এটি৷ গেলো এক বছর ধরে ধ্বসে পড়া ভবনটিকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন স্থপতি বা প্রকৌশলীরা, যাদের এক চতুর্থাংশ নারী৷ প্রাসাদটির পুনর্নির্মাণ কাজে সিকি ভাগ নারীকে রাখতে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির নির্দেশ ছিল৷ প্রাসাদের চার দেয়ালের ভেতর কাজ করতে তাই তেমন কোন সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না কুররামদের৷ সমস্যা যা হচ্ছে তা কাজে আসা যাওয়ার সময়, রক্ষণশীল আফগানদের হাতে ৷এমনিতেই দেশটিতে স্বাধীন পেশায় মেয়েদের সংখ্যা খুব নগন্য, কারিগরি খাতে তো একেবারেই বিরল৷ তাই আসতে যেতে অনেক কটূক্তি শুনতে হয় কুররামকে৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আমাদের সমাজটাই এমন৷ এভাবেই বাঁচতে হয়৷ ওরা চায় আমি যেন উত্তর দেই৷ বিবাদে জড়াই৷ কিন্তু আমি এড়িয়ে যাই৷ এটাই ওদের শাস্তি৷’’ দারুল আমান প্যালেসের পুনর্নির্মাণ কাজটি একজন পুরোদস্তুর নির্মাণ প্রকৌশলী কুররামের প্রথম কাজ৷ ‘‘আমরা যা ধ্বংস করেছি তার সংস্কার আমাদেরই করতে হবে৷ নতুন প্রজন্ম পুরোনো প্রজন্মের ভুল শোধরাবে৷ আর এই ভবনটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য৷ এর সংরক্ষণ করতেই হবে৷'' দিন নেই রাত নেই, কাজ চলছে৷ ওভারটাইম নিয়েও কারও ভ্রুক্ষেপ নেই৷ হাতুরি বেলচা নিয়ে বাইরে কয়েক ডজন শ্রমিক কাজ করে যাচ্ছেন, জড়ো করছে খুলে পড়া পলেস্তারা৷
‘শান্তির ঠিকানা'
আফগানিস্তানের সংস্কারপন্থি বাদশাহ আমানুল্লাহ খান ১৯২০ সালে দারুল আমান প্রাসাদ, যার অর্থ ‘শান্তির ঠিকানা', নির্মাণ করেন৷ কাবুলের পশ্চিমদিকে ভবনটি নির্মাণের জন্য ওয়াল্টার হার্টেনের নেতৃত্বে একদল জার্মান স্থপতি নকশা তৈরি করেছিলেন৷ ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর আমানুল্লাহ চেয়েছিলেন দেশটিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে৷ ভবনটি আফগানিস্তানের সংসদ ভবন হিসেবে ব্যবহারের কথা ছিল৷ কিন্তু একদল চরমপন্থি ধার্মিকের উত্থানে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হন তিনি৷ ঐতিহ্যবাহী এই ভবনটি তখন থেকেই এক বিরামহীন যুদ্ধের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে৷
আফগানিস্তানে এমন একটি দিনও যায় না যেদিন কোথাও বোমা ফাটেনি৷ গাড়ি বোমা, ট্রাক বোমা অথবা আত্মঘাতী বোমা হামলা৷ এত সব ধ্বংসলীলার মাঝেও এমন একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের পুনঃসংস্কার? তাই বলে একেবারে নিরাশ হয়ে ঘরে বসে থাকতে চান না কুররাম৷
‘‘আমাদের আশাবাদী হতে হবে৷ আমি নতুন প্রজন্মকে বিশ্বাস করি৷''
অনিশ্চিত ভবিষ্যত
যে আশা নিয়ে কুররামরাদিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তার সঙ্গে বাস্তবতার ফারাকটা অনেক৷ দেশটিতে চলমান দ্বন্দ্বের কোন সমাধান আপাতত নেই৷ দেশের ৬০ ভাগেরও কম অঞ্চল সরকারের নিয়ন্ত্রণে, ৩৪টি প্রদেশের ৩১টিতেই যুদ্ধ চলছে৷ প্রায় ১৫ লাখ মানুষ গৃহহারা৷ তালেবান, আল কায়দা, ইসলামিক স্টেটসহ অনেকগুলো জঙ্গিগোষ্ঠী দুর্বিষহ করে তুলেছে সাধারণ মানুষের জীবন৷ দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে৷
এ অবস্থায় প্রেসিডেন্ট ঘানি এই প্যালেসটিকে একটি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা করেছেন৷ দু'বছর পর আফগানিস্তান তার স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন করবে৷ তার মধ্যেই এই পুনঃসংস্কার কাজ শেষ করতে চান তিনি৷ যদিও এখনো পুরো অর্থ যোগাড় হয়নি৷ ২০০ মিলিয়ন ইউরোর মধ্যে ২০ মিলিয়ন এখন পর্যন্ত বরাদ্দ দিয়েছে সরকার৷
বুলেটের আঘাতে জর্জরিত ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে দূরে তাকিয়েছিলেন প্রকল্পটির প্রধান স্থপতি মাসুমা দেলিজাম৷ মরচে ধরা দণ্ডে পতপত করে উড়ছে আফগানিস্তানের পতাকা৷ একটা গোলাপী প্লাস্টিক ব্যাগ বাতাসে এদিক ওদিক উড়ছে৷ অন্যপ্রান্তে নতুন সংসদ ভবনের তামার গম্বুজটিতে ঠিকরে পড়ছে সূর্যের আলো৷ প্রতিবেশী ভারতের অর্থে তৈরি এটি৷
‘‘এখানে দাঁড়ালে খুব ভালো লাগে৷'' বলছিলেন দেলিজাম৷ ইরানের শরণার্থী ক্যাম্পে বড় হয়েছেন ২৮ বছর বয়সি এই নারী৷ দেশে ফিরেছেন ২০০৪ সালে৷ চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তাঁর৷ ‘‘একদিন এই পথ দিয়ে আমি আমার সন্তান আর তার বাবাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটবো৷ আর বলব, এই দারুল আমান তার বাবা-মা তৈরি করেছে৷''
সান্ড্রা পেটার্সমান/জেডএ