এন্ড্রু কিশোরের পাশে দাঁড়ানোর এখনই সময়
২৯ নভেম্বর ২০১৯এন্ড্রু কিশোরের সাথে সখ্য ও বন্ধুত্বের শুরু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে৷ অবশ্য আমি তার সংগীতের ভক্ত আরো আগে থেকে৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই রাজশাহীতে, রানীবাজারে আমাদের বাড়ীর একদম কাছেই সুরবাণী সংগীত বিদ্যালয় স্থানান্তরিত হয়েছিল৷ স্বাধীনতার আগে এই সুরবাণী সংগীত বিদ্যালয়টি ছিল রাজশাহী শহরের কেন্দ্র ভূবন মোহন পার্কের সামনে একটি দোতালা ভবনে৷
সুরবাণী সংগীত বিদ্যালয়টি তখন রাজশাহীর বেশ বড় নামকরা সংগীত চর্চা কেন্দ্র৷ একটি পুরানো বাড়ীর ছাদসংলগ্ন বেশ বড় জায়গায় অবস্থিত সংগীত বিদ্যালয়ে প্রায়ই গানের আসর বসতো৷ যে কোনো জাতীয় দিবস বা রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীতে সেখানে ঘটা করে অনুষ্ঠান হতো৷
এরকম একটি অনুষ্ঠানেই প্রথম দেখি এন্ড্রু কিশোরকে৷ উনি কয়েকটি নজরুল সংগীত পরিবেশন করেছিলেন৷ তার গাওয়া ‘চাঁদ হেরিছে চাঁদ মুখ তার’ গানটি শুনে খুব বিমোহিত হয়েছিলাম৷ এরপর নানা উপলক্ষ্যে ঐ সংগীত নিকেতনে যখনই কোনো গানের অনুষ্ঠান হতো, আমি গিয়ে হাজির হতাম৷ সুরবাণী সংগীত বিদ্যালয়ে এন্ড্রু কিশোরের ‘ওস্তাদ’ ছিলেন আব্দুল আজিজ বাচ্চু৷ প্রথম দিকে এন্ড্রু কিশোর নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, আধুনিক, লোক ও দেশাত্মবোধক গান করতেন৷ তখন তিনি রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী৷
রাজশাহী শহরে তখন খুব ধূমধাম করে দুর্গাপূজা হতো৷ পুজার সময় মিউজিক কনসার্ট হতো৷ রানীবাজারের অ্যারোহেড ক্লাব খুব জাঁকজমকের সাথে দুর্গাপূজা করতো৷ তাদের সেই পূজা মিউজিক কনসার্টে এন্ড্রু কিশোর গান গাইতো৷ কয়েকবার অলকা সিনেমা হলের কাছে সেই পূজা মিউজিক কনসার্টে গিয়েছি৷ সে এক এলাহী কান্ড৷রাস্তার ধারে উচুঁ মঞ্চে এন্ড্রু কিশোর গান গাইছে আর হাজার হাজার মানুষ তার গান শুনছে৷ তার গানের সময় রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতো৷তখন দেখেছিলাম তিনি নজরুল গীতির বাইরে কিশোর কুমারের জনপ্রিয় গানগুলিও খুব মুন্সিয়ানা দিয়ে অবিকল গাইতো৷
স্বাধীনতার কয়েক বছর পর আমি রাজশাহী কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম৷ আর আমাদের একটু সিনিয়ার এন্ড্রু কিশোর ভর্তি হয়েছিল রাজশাহী সিটি কলেজে৷ ঐ কলেজে আমাদের বন্ধুরা এন্ড্রু কিশোরকে নিয়ে গৌরববোধ করতো৷বন্ধুরা বলতো, ‘‘আমাদের কলেজে রাজশাহী শহরের সেরা গায়ক পড়াশুনা করে৷’’ তখনও এন্ড্রু কিশোরের সাথে আমার পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়নি৷
১৯৭৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদালয়ে ভর্তি হবার পর দেখলাম রাজশাহী শহরের বিখ্যাত গায়ক এন্ড্রু কিশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র৷ সে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে আরো জনপ্রিয়৷ তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অনুষ্ঠান লেগেই থাকতো৷ বিভিন্ন বিভাগের নবীন বরণ, বিদায়ী অনুষ্ঠান,অভিষেক, নানা ছাত্র সংগঠনের সম্মেলন ইত্যাদি লেগেই থাকতো৷বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনুষ্ঠানে তখন এন্ড্রু কিশোরকে নিয়ে টানাটানি লাগতো৷
সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এন্ড্রু কিশোরের সাথে পরিচয়, বন্ধুত্ব, তারপর ঘনিষ্ঠতা৷ রাজশাহী শহরে এবং মতিহারের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কিশোর তখন তুমুল জনপ্রিয়৷ এই জনপ্রিয়তা নিয়ে তার মধ্যে কোনো রকমের ইগো কখনোই আমাদের চোখে পড়েনি৷বরং সে সবসময়ই খুব বিনয়ী৷ প্রায়ই আমরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গোল হয়ে বসে আড্ডা দিতাম৷আমি তাকে কিশোরদা ডাকতাম৷
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীনই এন্ড্রু কিশোরের জনপ্রিয়তা রাজশাহীর বাইরে ছড়িয়ে পড়ে৷ সম্ভবত ১৯৭৭ সালের দিকে ঢাকা থেকে সিনেমার প্লেব্যাক গাইবার ডাক পড়েছিল৷ তখনকার বিখ্যাত সুরকার আলম খানের সংগীত পরিচালনায় মেইল ট্রেন নামের একটি চলচ্চিত্রে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তাঁর কেউ’ গান দিয়ে তার সিনেমার প্লেব্যাক গায়কের জীবন শুরু৷ এরপর পরিচালক বাদল রহমানের এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী নামের শিশুতোষ চলচ্চিত্রে ‘ধুম ধারাক্কা' গানটি রেকর্ড করলো৷ এর মাঝে আরো কিছু গান৷ ১৯৭৯ সালে এ জে মিন্টু পরিচলিত প্রতীজ্ঞা চলচ্চিত্রের ‘এক চোর যায় চলে’ গানটি পুরো বাংলাদেশে ফাটাফাটি রকমের হিট করলো৷
এরপর একটির পর একটি চলচ্চিত্রের গান হিট করতে থাকলো৷ ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্য খানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান', এই রকম অনেক গান তখন মানুষের মুখে মুখে ফিরতো৷ এন্ড্রু কিশোর অচিরেই বাংলাদেশের জনপ্রিয় শিল্পী হয়ে উঠলেন৷আমরা রাজশাহীতে তার গুনমুগ্ধরা তখন কিশোর দা-কে নিয়ে খুব গৌরববোধ করতাম৷
রাজশাহী বিশ্ববিদালয়ের তখন ভাইস চ্যান্সেলর আব্দুল বারী-বিরোধী আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় বারবার বন্ধ ঘোষিত হতে থাকলো৷সেশন জটে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের পড়শুনার মেয়াদ দুই বছর বেড়ে গিয়েছিল৷ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাবস্হপনা বিষয়ে পড়াশুনা শেষ করে ১৯৮০ সালের জানুয়ারী মাসে কিশোরদা গান গাইবার প্রয়োজনে ঢাকাতে থিতু হলো৷
ঢাকার ফকিরাপুল বাজারের কাছে কিশোরদা একটি ফ্ল্যাটের তৃতীয় তলায় বসবাস শুরু করলো৷তবে সে প্রায়ই রাজশাহীতে তার পরিবারের কাছে বেড়াতে আসতো৷১৯৮৪ সালের মে মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষা চুকিয়ে আমি চাকুরি নিয়ে ঢাকা চলে আসি৷ ঢাকাতে এসে আমিও কিশোরদার সাথে বসবাস শুরু করি৷
সেই সময় এন্ড্রু কিশোর তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে৷ এক সাথে থাকার ফলে তার সংগীতময় জীবন যাপনআর জনপ্রিয়তা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো৷ প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে কিছু ঔষধি গাছের রস খেতো, তারপর যোগ ব্যয়াম করে গলা সাধতো৷
ফকিরাপুলের ঐ বাসায় তখন নিত্যদিন গান-বাজনার লাইনের অনেক লোক আসতো৷ কিশোরদা প্রায় প্রতিদিন তখনকার সব বিখ্যাত সুরকারদের বাড়িতে গিয়ে সেইসব সুরকারের প্লেব্যাক সংগীতের সুর শুনে আসতো আর লিখে আনতো৷ সাথে একটি ছোট ক্যাসেট রেকর্ডার বহন করতো, তাতে সে নতুন গানের সুরগুলি রকর্ড করে আনতো৷ তারপর বাসায় ফিরে সেই গান গলায় তুলতো৷তার অনেক বিখ্যাত গানের প্রথম শ্রোতা ছিলাম আমি৷অনেক প্লেব্যাক গানের জন্য কিশোরদা খুব কম সময় পেতো৷ অনেক ক্ষেত্রে সকালে শিখে এসে রাতেই রেকর্ডিং করতে হতো৷তখন অধিকাংশ প্লেব্যাক গানের রেকর্ডিং হতো পরিচালক খান আতা, অর্থাৎ আতাউর রহমান খানের মগবাজারের শ্রুতি রেকর্ডিং ষ্টুডিওতে৷
১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশের ছায়াছবিতে প্লেব্যাক মিউজিকের জন্য এন্ড্রু কিশোরের গলা ছিল অপরিহার্য৷সেই সময় দেখেছি হঠাৎ করে ফকিরাপুলের বাসায় বিখ্যাত সুরকার আলাউদ্দিন আলী এসে হাজির৷হয়তো খুব তাড়াতাড়ি কোনো গানের কাজ শেষ করতে হবে সেই বিষয়ে বা সুর কেমন হবে তা নিয়ে কথা বলতে এসেছেন৷ বাংলাদেশের আরো বিখ্যাত সুরকার শেখ সাদী খান, ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুলসহ অনেকে প্রায়ই আসতেন৷ গায়কদের মধ্যে কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী প্রায় আসতেন আড্ডা দিতে৷
১৯৮২ সালে রেকর্ডিংয়ের আগে কিশোরদা আমাদের বাসায় ‘হায়রে মানুষ রঙ্গীন ফানুস’ গানটি অনুশীলন করছিল৷গানটির কথা ও সুরের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার ভাব দেখে সেদিন আমি বলেছিলাম, ‘‘গানটা কিন্তু বাজারে খাবে৷’’ সেই গানটি রেকর্ডিংয়ের দিন আমি তার সাথে শ্রুতি ষ্টুডিওতে গিয়েছিলাম৷ সন্ধ্যার পর গানটি রেকর্ড হলো৷ ‘বড় ভালো লোক ছিলো’ ছবির এই গানটি লিখেছিলেন সব্যসাচী লেখক কবি সৈয়দ শামসুল হক আর সুর করেছিলেন আলম খান৷ এই কালজয়ী গানটির জন্য পরবর্তীতে অ্যান্ড্রু কিশোর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরুস্কার পায়৷
প্লেব্যাক গানের পাশাপাশি সেই সময় সারা বাংলাদেশ থেকে নানা অনুষ্ঠানে গান গাইবার জন্য অসংখ্য অনুরোধ আসতো৷ কিশোরদা প্রথম থেকেই ঐসব অনুষ্ঠান কারা আয়োজন করছেন বা আর কোন শিল্পীরা যাচ্ছেন, তা দেখে বেছে বেছে সেইসব অনুষ্ঠানে যাবার ব্যপারে সম্মতি জানাতেন৷
তিনি ঢাকা শহরে সব সময় রিকশায় চলাফেরা করতেন৷রাস্তা দিয়ে যাবার সময় প্রায়ই তার অসংখ্য শ্রোতা ‘‘দাদা, দাদা’’ বলে চিৎকার করতেন৷১৯৮২ সালের দিকে রাজশাহী বিমানবন্দর নির্মিত হলে কিশোরদা বললো, ‘‘চলো, আমরা প্রথম ফ্লাইটে রাজশাহী যাই৷’’ কথামতো টিকিট জোগাড় হলো৷ রাজশাহীতে নামার পর অসংখ্য লোক কিশোরদাকে সম্বর্ধনা জানিয়েছিল৷
কিশোরদা'র আছে বিশাল বন্ধুকূল৷ নানা কাজে বিপদে- আপদে তার কাছে অনেকেই ছুটে আসতো৷কিশোরদা সব ফেলে তাদের সহযোগীতা করত৷
১৯৮৪ সালের জুন মাসে আমি প্রবাসে চলে আসি৷ বৃষ্টিমুখর এক দিনে কিশোরদা এবং আমার বড় ভাই দৈনিক বাংলা ও বিচিত্রার সাবেক প্রতিনিধি আহমেদ সফি উদ্দিন আমাকে বিমানবন্দরে পৌঁছিয়ে দিয়েছিল৷
১৯৮১ সালের মে মাস থেকে ১৯৮৪ সালের জুন মাস, প্রায় ৩৬ মাস কিশোরদা'র সাথে এক ছাদের নীচে একসাথে ছিলাম৷ সেই সময়কার নানা স্মৃতি সব সময় মানসপটে ভেসে ওঠে৷
দেশ ছাড়বার পর জার্মানি থেকে ১৯৯০ সালে আবার দেশে যাই৷ ঢাকা বিমানবন্দরে যথারীতি কিশোরদা এসে হাজির৷ ১৯৯২ সালে আমি বিয়ে করি৷ উদ্যোক্তা ছিলেন কিশোরদা৷ এরপর থেকে প্রায় প্রতি বছরই দেশে যাওয়া হয়৷ রাজশাহীতে গিয়ে শুনি কিশোরদার নানা মানবিক কাজের গল্প৷ তার গানের ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বা্চ্চু স্মৃতি সংসদ থেকে প্রতিমাসে নবীন শিল্পীদের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য সংগীতানুষ্ঠান, শীত ও বন্যার সময়ে নিজে রাজশাহী গিয়ে নানা রকম সহযোগিতামূলক কাজ, রাজশাহীতে দুঃস্থ শিল্পীদের সহযোগিতার জন্য সংগীতানুষ্ঠান করে আর্থিক সাহা্য্য প্রদান ইত্যাদি৷ ঢাকায় থাকলেও তার জন্মভূমি রাজশাহীর জন্য কিশোরদা সব সময় ব্যাকুল৷
আশির দশকে এন্ড্রু কিশোরের গান বাংলাদেশের সংগীত জগতে নতুন এক ধারার সূচনা করে৷তার অসংখ্য জনপ্রিয় গান বাংলাদেশের সর্বত্র মানুষের মুখে মুখে ফিরতো৷ এই গুণী শিল্পী জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকেও খুব সাধারণ ও সৎ জীবনযাপনে অভ্যস্ত৷ তবে এন্ড্রু কিশোর দুঃস্থ বা অসচ্ছল শিল্পী নন৷ আবার তার কাছে রাজার ভান্ডারও নেই৷ এন্ড্রু কিশোর এখন জীবন-মরনের কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখী৷ এখন তিনি চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে৷ প্রায় প্রতি সপ্তাহে কথা হচ্ছে৷ আমাদের সবার অশেষ প্রার্থনা, সে সুস্হ স্বাভাভিক হয়ে শীঘ্রই দেশে ফিরে আসুক৷
আমাদের দেশে সংগীত অঙ্গনে তার যে অপরিসীম অবদান, তার প্রতিদান দেবার এখনই সময়৷ গোফান্ডমি ডটকমে তাকে আর্থিক সহযোগিতা করছেন কেউ কেউ৷ তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা এখনো অপ্রতূল৷ এন্ড্রু কিশোরকে বাঁচাতে, আমার, আমাদের কিশোরদাকে সংগীতে ফিরিয়ে আনতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন৷