আরজি করের রায় আসন্ন, বৃহত্তর ষড়যন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠছেই
১০ জানুয়ারি ২০২৫গত ৯ আগস্ট আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে কর্তব্যরত তরুণী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয়েছিল। সেই মামলার তদন্তভার পুলিশের হাত থেকে যায় সিবিআইয়ের কাছে। এই ঘটনায় দ্রুত বিচারের দাবিতে অভূতপূর্ব এক আন্দোলন দেখা গিয়েছে কলকাতা থেকে জেলায় জেলায়। সেই মামলার প্রতীক্ষিত রায় ঘোষণা হতে পারে কয়েকদিনের মধ্যে।
মামলার রায়
৮ আগস্ট গভীর রাতে যখন চিকিৎসক বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, সেই সময়ে তাকে ধর্ষণ ও খুন করা হয় বলে অভিযোগ। পুলিশ দেহ উদ্ধারের দিনেই গ্রেপ্তার করে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে। এরপর সিবিআই তদন্তভার নেয়ার পর গ্রেপ্তার করেছিল হাসপাতালের সাবেক অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও টালা থানার ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে।
এই মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় ৫১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন ঘটনার দিনে নিহত চিকিৎসকের সঙ্গে সময় কাটানো কয়েকজন সহপাঠী। চিকিৎসকের বাবার বয়ান রেকর্ড করা হয়েছে। কলকাতা পুলিশ ও সিবিআইয়ের তদন্তকারী আধিকারিক থেকে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে।
এই ঘটনার কোনও প্রত্যক্ষদর্শী না থাকায় তদন্তকারীদের নির্ভর করতে হয়েছে ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত বায়োলজিক্যাল নমুনার উপর। এর সঙ্গে কাজে লেগেছে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ-সহ নানা ধরনের ডিজিটাল তথ্য। এ সবের উপর ভিত্তি করে শিয়ালদা আদালতে চার্জশিট দেয় সিবিআই। তাতে অভিযুক্ত হিসেবে সঞ্জয়ের নাম ছিল।
এই চার্জশিটের ভিত্তিতে টানা কয়েক সপ্তাহ শুনানি হয়েছে আদালতে। বৃহস্পতিবারও শুনানি হয়, যেখানে উপস্থিত ছিল সঞ্জয়।
মামলা চলাকালীন সঞ্জয় দাবি করেছে, সে চিকিৎসককে খুন করেনি। তাকে খুনি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা চলছে। আদালত সূত্রের খবর, ১৮ জানুয়ারি তিনটে নাগাদ মামলার রায় ঘোষণা হতে পারে।
তদন্ত ঘিরে প্রশ্ন
সঞ্জয়ের গ্রেপ্তারি থেকে সিবিআইয়ের চার্জশিট, বারবার এ সব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিহত চিকিৎসকের পরিবার থেকে আন্দোলনকারীরা প্রশ্ন তুলেছেন। বিশেষত সঞ্জয় একা অপরাধী নয়, এই সওয়াল বারবার করেছেন সকলে।
বৃহস্পতিবার নিহত ছাত্রীর মা বলেন, "সঞ্জয় দোষী হতেই পারে। কিন্তু একা ও আমার মেয়েকে মেরেছে, সেটা বিশ্বাস হয় না। হাসপাতালের মতো একটা সুরক্ষিত জায়গায় বাইরের কেউ এসে পড়ল, সেটা কেউ জানতে পারল না, এটা কি হতে পারে!"
তিনি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তার দাবি, "হাসপাতালের কেউ এর সঙ্গে নিশ্চয়ই যুক্ত আছেন। সিবিআই তাদের সামনে আনুক। প্রকৃত দোষী যারা, তারা সকলে শাস্তি পেলে আমরা শান্তি পাব।" সিবিআই সম্পর্কে অনাস্থা উঠে এসেছে চিকিৎসকের বাবার বক্তব্যেও। তিনি বলেন, "কলকাতা পুলিশ কয়েকটা দিনের মধ্যে যেটা করেছে, সেটা সিবিআই মাসের পর মাস তদন্ত করেও পারলো না। তা হলে কেমন হচ্ছে তদন্ত!"
রাতজাগা আন্দোলন
আরজি করের ঘটনা নিয়ে আন্দোলন শুধু রাজ্য নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়িয়ে বিদেশেও সাড়া ফেলেছিল। শুধু চিকিৎসক সমাজ নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষজন এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছিলেন। দিনের পর দিন ধরনা, অবস্থান থেকে অনশন চলেছে। তা সত্ত্বেও যখন সিবিআই চার্জশিটে সন্দীপ ও অভিজিতের নাম বাদ পড়ে, তখন ক্ষোভে ফেটে পড়েন আন্দোলনকারীরা।
সুবিচারের দাবিতে রাত দখলের আন্দোলন সামিল হয়েছিলেন নারীরা। মামলার রায় যখন ঘোষণা হতে চলেছে, সেই সময় আবার রাতজাগা আন্দোলন শুরু করেছেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই সেই ছবি দেখা যাচ্ছে। জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্টের সদস্যরা 'রাত জাগো' কর্মসূচি পালন করছেন। তাদের সঙ্গে রয়েছেন সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম, মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টার, অভয়া মঞ্চ থেকে শুরু করে অন্যান্য সংগঠনের সদস্যরাও।
শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ের কাছে তৈরি হয়েছে অবস্থান মঞ্চ। সেখানে সারা রাত ধরে ঠান্ডার মধ্যে বসে থেকেছেন আন্দোলনকারীরা। রাতভর চলেছে বক্তৃতা। সঙ্গে কবিতা পাঠ হয়েছে, হয়েছে নাটক। সেই মঞ্চে রায় নিয়ে প্রতীক্ষা আছে, কিন্তু একইসঙ্গে আন্দোলনকারীদের হতাশা ও সংশয় কম নয়।
ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট-এর সদস্য ও আন্দোলনকারী চিকিৎসক অনিন্দ্য মণ্ডল ডিডাব্লিউকে বলেন, "যারা তদন্ত করছেন, তারা নিরপেক্ষতা রাখছেন না। এটা আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি। সিএফএসএল-এর রিপোর্ট তার প্রমাণ। সঞ্জয় রায় একা অপরাধে জড়িত নয়, তার সঙ্গে আরও অনেকে আছে। বাস্তবে যেটা দেখানো হচ্ছে, সেটা অসত্য। সিএফএসএল-এর রিপোর্ট যেটা এসেছে, সেটা যদি সত্যি হয়, তা হলে সিবিআই যেটা বলছে, সেটা সত্যি নয়। অভয়ার বাবা-মা এই প্রশ্নগুলি করেছেন। তার উত্তর চাই। যতদিন না ন্যায়বিচার হচ্ছে ও প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে, তত দিন আমাদের আন্দোলন চলবে।"
তিনি বলেন, "জুনিয়র ডাক্তাররা যতই কাজের মধ্যে থাকুক না কেন, আন্দোলনের পথ ছাড়েনি। সাধারণ মানুষ আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছে। ষড়যন্ত্র করে সঠিক ঘটনাটাকে আড়াল করে শুধু সঞ্জয় রায়কে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।"
আন্দোলনকারী চিকিৎসক তথা এনআরএস হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তার অর্ণব তালুকদার ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমরা এখনো পর্যন্ত বিচারের যা গতিবিধি দেখেছি, তাতে আশা রাখতে পারছি না। এখনো পর্যন্ত এটা পরিষ্কার হয়নি যে, সঞ্জয় রায়ের খুনের মোটিভ কী ছিল। কেন ১৪ আগস্ট রাতে হামলা হল। এই উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। তারপরে যখন সিএফএসএল-এর রিপোর্ট এল, ডিএনএ রিপোর্ট এল, তাতে সম্ভাবনা আরো জোরদার হল যে, এটা একা সঞ্জয় রায়ের কাজ হতে পারে না। তদন্ত নিয়ে অনেক প্রশ্নের সদুত্তর আমরা এখনো পাচ্ছি না। ১৮ তারিখের রায় নিয়ে আমরা খুব বেশি আশান্বিত নই।"
তার বক্তব্য, "তবু সুবিচারের দাবিতে আন্দোলনকে আরো জোরদার করতে হবে। সিবিআই বিষয়টা খুব বেশি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। এতদিন হয়ে যাওয়ার পরেও সিবিআই কোনো উত্তর দিতে পারেনি।"
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের সাবেক ডেপুটি সুপার আখতার আলি এই আন্দোলনের অন্যতম মুখ। তিনি দুর্নীতি নিয়ে অনেক আগেই সোচ্চার হয়েছিলেন। ডিডাব্লিউকে বলেন, "অভয়া যদি বিচার না পায়, তাহলে বিশ্বাস করতে পারি যে ভারতের কোনো মেয়ের সঙ্গে অন্যায় হলে, বিচার পাওয়া যাবে না। বিচারের আশায় আমরা বসে আছি, সারা দেশ জুড়ে আমরা লড়াই করছি। আমরা যদি বিচার না পাই, তা হলে আইন-কানুনের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলব। ডিএনএ-র বা সিএফএসএল-এর রিপোর্ট আসার পরেও যদি ন্যায়বিচার না পাই, তাহলে কী করে বিশ্বাস রাখব যে, অন্য কোনো মেয়ে সুবিচার পাবে?"
আলির বক্তব্য, "ডিএনএ বা সিএফএসএল রিপোর্ট যা বলছে, তারপরেও প্রশাসন যদি এটা নিয়ে না ভাবে, তা হলে কবে ভাববে? আমাদের লড়াই দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে যাব, যতক্ষণ না অভয়া বিচার পায়।"