বলা হচ্ছে, ১৯৭১ সালে যে ভয়ঙ্কর অন্যায় হয়েছে সেরকম যেন আর না হয় পাকিস্তানে!
হ্যাঁ, ঠিক এই কথাই বলছেন পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার, সাবেক অধিনায়ক এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান৷ রাজনৈতিক জীবনের ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে এবারই যে ইমরান প্রথম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছেন তা কিন্তু নয়৷ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বক্তব্য ইতিহাসে পাকা আসন করে নিয়েছে৷ সে আসন অবশ্য কিছুটা টলমলো৷ এই এদিকে ঝুঁকছে তো পরক্ষণেই ওদিকে৷
ক্রিকেটে পাকিস্তানের বহু জয়ের অগ্রসৈনিক ইমরান একাত্তরে পাক-সেনাদের বর্বরতার বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন আত্মজীবনীগ্রন্থ ‘পাকিস্তান: আ পার্সোনাল হিস্ট্রি'-তে৷ ২০১১ সালে প্রকাশিত সেই বইয়ে পরিষ্কার লেখা আছে ১৯৭১-এর মার্চ মাসে নিজের চোখে দেখা ঢাকা শহরের কথা৷ ২৫ শে মার্চের কয়েকদিন আগে ঢাকায় এসেছিলেন তরুণ ক্রিকেটার ইমরান খান৷ তখন বয়স মাত্র ১৯৷ এসেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান অনূর্ধ-১৯ দলের হয়ে ক্রিকেট খেলতে৷ খেলতে এসে লক্ষ্য করেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের প্রতি বাঙালিরা কতটা ক্ষুব্ধ, একই দেশের অংশ হয়েও অত্যাচারী শাসকদের কারণে অন্য অংশটিকে কতটা ঘৃণা করে বাঙালি৷ সশরীরে ঢাকায় আসার সূত্রে পাওয়া অভিজ্ঞতা থেকে ইমরান লিখেছেন, ‘‘আমরা পূর্ব পাকিস্তান দলের বিপক্ষে খেলছিলাম৷ আমাদের কাছে সবকিছুই তখন খুব শত্রুভাবাপন্ন মনে হচ্ছিল৷ শত্রুভাবাপন্ন মনে হচ্ছিল ঢাকা স্টেডিয়ামের দর্শক, এমনকি প্রতিপক্ষ পূর্ব পাকিস্তান দলের খেলোয়াড়দেরও৷''
‘পাকিস্তান: আ পার্সোনাল হিস্ট্রি' গ্রন্থে ইমরান অবশ্য দাবি করেছেন, তখন পূর্ব পাকিস্তান কতটা অন্যায়, অত্যাচার আর বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না৷ বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার ও সফল ক্রিকেট-সংগঠক সৈয়দ আশরাফুল হক ১৯৭১-এর সেই সময়টায় ইমরানের দলের বিপক্ষে লড়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে৷ ঢাকাসহ পুরো পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে নাকি সৈয়দ আশরাফুল হকই একটা ধারণা দিয়েছিলেন ইমরান খানকে৷ তার মুখে বাঙালিদের মাঝে স্বাধীনতার চেতনা ভীষণ দৃঢ় হয়ে উঠেছে, স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠছে- এমন কথা শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন ইমরান, ‘‘এমন কথা শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম৷ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষেরা কী ভাবছে সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই ছিল না৷ এ জন্য দায়ী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে গণমাধ্যমের ওপর সামরিক জান্তার পুরো নিয়ন্ত্রণ৷''
কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া বিশ্বের প্রথম সাবেক ক্রিকেটার ইমরান সম্প্রতি জেল থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন৷ সেখানেই উঠে এসেছে ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘৃণ্য ভূমিকা এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠা করা দল আওয়ামী লীগের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কথা৷ ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি নিয়ে একটা ভিডিও প্রতিবেদন করেছে হিন্দুস্তান টাইমস৷ ভিডিও প্রতিবেদনের শুরুতেই ইমরানকে বলতে শোনা যায়, ‘‘আপনারা না জানেন ইতিহাস, না বোঝেন রাজনীতি৷ আপনারা এ-ও জানেন না যে এই পাকিস্তানে কী হয়েছে৷ আমি জানি, আমার এখনো মনে আছে কী হয়েছিল (এই দেশে)৷ আমার মনে আছে একই কৌশল কীভাবে দেশের সবচেয়ে বড় দলটির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়েছিল, কিভাবে দেশের সর্বনাশ করা হয়েছিল- দেশটাকে টুকরো করে দেয়া হয়েছিল৷''
পাকিস্তানে আবার ১৯৭১-এর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে- এমন দাবি করে এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে তিনি সবাইকে সতর্ক করে দেন৷
ইমরান মনে করেন, ১৯৭১ সালে নিরীহ বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেরকম নৃশংসতা চালিয়েছিল, এখন ঠিক সেরকম নৃশংসতাই চালানো হচ্ছে তার দল তেহরিক-ই-ইনসাফ-এর নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে৷ নয় মাসে ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ হত্যা করা, লাখো নারীকে ধর্ষণ করার ঐতিহাসিক কলঙ্কের সঙ্গে ঠিক কোন কোন জায়গায় কতটা মিল রয়েছে তা অবশ্য ইমরান বলেননি৷ ভিডিও বার্তায় শুধু বলেছেন, পাকিস্তানকে আবার টুকরো করার ষড়যন্ত্র চলছে৷ তার মতে, তেহরিক-ই-ইনসাফের বিক্ষুব্ধ সমর্থকদের সরকারি ভবনে আগুন দেয়া, সেনা কর্মকর্তার ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার মতো নিন্দনীয় ঘটনাও এ ষড়যন্ত্রের অংশ৷
পাকিস্তানকে ১৯৯২-এর ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতানো সাবেক অধিনায়ক দাবি করেন, তেহরিক-ই-ইনসাফের বিক্ষোভ মিছিলে লোক ঢুকিয়ে জ্বালাও-পোড়াও শুরু করা হয়েছে৷ নিরপেক্ষ তদন্ত হলে এ সত্য প্রকাশিত হবে এমন আশা নিয়ে ইমরান আরো দাবি করেন, তার দলের নেতা-কর্মীরা এমন কাজ কখনো করতে পারেন না, কারণ ‘‘এ দল গত ২৭ বছরে একবারও সহিংসতায় জড়ায়নি, এই দলের সমর্থকেরা তাদের চেয়ারম্যানকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করার পরও শান্ত থেকেছে৷''
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম মেয়াদ পূর্ণ করার আগেই ক্ষমতাচ্যুত রাজনীতিবিদের আশঙ্কা- এখন পাকিস্তানে যা হচ্ছে সবই পরিকল্পিত৷ আগে হয়েছে ‘লন্ডন প্ল্যান', সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নামা সমর্থকদের যে এখন জেলে ঢুকানো হচ্ছে তা-ও গভীর এক ষড়যন্ত্রের অংশ বলেই মনে করেন ইমরান খান৷ তার আশঙ্কা- এই ষড়যন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অভিযোগ তুলে তার দলকে নিষিদ্ধ করা এবং জেলে পুরে তার রাজনৈতিক জীবন শেষ করে দেয়া৷
তার বেসামরিক এবং সামরিক প্রতিপক্ষরা ভুলেও যেন সেদিকে পা না বাড়ায় সেই বিষয়ে সতর্ক করে দিতে গিয়েই ইমরান বলেছেন, ‘‘আপনারা না জানেন ইতিহাস, না বোঝেন রাজনীতি৷ আপনারা এ-ও জানেন না যে এই পাকিস্তানে কী হয়েছে৷ আমি জানি, আমার এখনো মনে আছে কী হয়েছিল (এই দেশে)৷ আমার মনে আছে একই কৌশল কীভাবে দেশের সবচেয়ে বড় দলটির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়েছিল, কিভাবে দেশের সর্বনাশ করা হয়েছিল- দেশটাকে টুকরো করে দেয়া হয়েছিল৷''
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও বাঙালির মন কিন্তু ভাঙতে শুরু করেছিল ১৯৫২ থেকে৷ সেই সময় সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারদের বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দেয়ার কথা কে না জানে! ইমরান আহমেদ খান নিয়াজীর জন্ম সেই বছরেরই নভেম্বর মাসে৷ বাঙালির প্রতি তার দেশের শাসকদের নিষ্ঠুর আচরণের কথা জানতে তাকে ঢাকায় আসতে হয়েছিল ১৯ বছর পরে৷ সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা ‘পাকিস্তান: আ পার্সোনাল হিস্ট্রি' গ্রন্থে লিখেছেন ২০১১ সালে৷ চার বছর পরই কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা যেন সকল গুরুত্ব হারিয়ে বসেছিল৷ তাই ২০১৫ সালে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে ফাঁসি দেয়ার পর ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থান সামান্য জানান দিতে শুরু করা তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলনেতা ইমরান খান৷ ইমরান তখন বুঝতে পারেননি সাকা চৌধুরী আর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের কী অপরাধ৷
হঠাৎ আবার ১৯৭১, বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের অতীত উঠে আসছে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখে৷
১৯৭১, বঙ্গবন্ধু, বাঙালি, বাঙালির জাত্যাভিমান, সুদীর্ঘ সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, শহিদ, শহিদের রক্ত, বাংলার স্বাধীনতা- এসব এখনো সত্যিই ভালো করে বুঝতে পারছেন তো, নাকি নিজের প্রয়োজন বলেই শুধু কথার কথা বলছেন ইমরান খান?