1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ইস্যু থাকার পরও বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলন কেন ব্যর্থ?

১৪ জুলাই ২০২৪

দেশে সাধারণ মানুষের ইস্যুগুলো নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কোনো আন্দোলন করছে না। দলগুলো কার্যকর কোনো আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারছে না। সরকার বা সরকারে থাকা দলও মানুষের দাবিদাওয়ার দিকে নজর দিচ্ছে না।

https://p.dw.com/p/4iGs1
৭ জানুয়ারির নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে ঢাকার রাজপথে মিছিল
রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনে দলীয় নেতাকর্মীদের বাইরে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা খুব কমই দেখা যায়ছবি: Mortuza Rashed/DW

না সরকার, না বিরোধী দল, কোনো পক্ষই গণমানুষের পক্ষে সক্রিয় না হওয়ায় সাধারণ মানুষ বলতে গেলে চিড়েচ্যাপ্টা অবস্থায় আছে। বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের টানা ১৫-১৬ বছরের শাসনামলে সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী, শ্রমিক বেশ কয়েকটি আন্দোলন গড়ে তুললে সেগুলো কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন ছিলো না। বরং  নিজেরা আন্দোলন জমাতে না পেয়ে কেনো কোনো দল তাদের ওপর ভর করে রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে আন্দোলনকারীদের চাপের মুখে ফেলেছে।

এই সময়ে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন, গণজাগরণ মঞ্চ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন, পোশাক শ্রমিকদের বেতন-ভাতার জন্য বড় বড় আন্দোলন হয়েছে। এখন দ্বিতীয়বারের মতো চলছে কোটা সংস্কার আন্দোলন।

অন্যদিকে দুর্নীতি ও দ্রব্যমূল্যের মতো বড় দুইটি ইস্যু বলতে গেলে গত ১০ বছর ধরে সব সময়ই হাতের কাছে ছিলো এবং আছে। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ না হওয়ায় ভোটাধিকার নিয়েও অনেকের ক্ষোভ রয়েছে। আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণের নামে লুটপাট, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে লুটপাট, ভর্তি ও নিয়োগ পরীক্ষা এমনকি বিসিএস পরীক্ষার ধারবাহিক প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে দেশের মানুষ নানা ভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানালেও এসব নিয়ে কোনো কার্যকর রাজনৈতিক আন্দোলনে কোনো দলেরই আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

পুলিশের শীর্ষ পদে থেকে বেনজীরের দুর্নীতি, এনবিআরের শীর্ষ পদে থেকে মতিউরের দুর্নীতি, কালোটাকা, অর্থ পাচার, ভুয়া রপ্তানি দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটসহ নানা ইস্যু থাকলেও  এর বিরুদ্ধে আন্দোলন নাই। কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি?

রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সমাজবিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়েছে তার মধ্যে প্রধান হলো রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা। তারা সাধারণ মানুষের ভাষা ও ইস্যুকে গুরুত্ব না দেয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে দলীয় ইস্যুকে প্রাধান্য দেয়া আর নেতৃত্বে দুর্বলতাও অন্যতম কারণ।

সাধারণ মানুষ ও ছাত্ররা তাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছে রাজনীতির বাইরে সামাজিক ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করলে সরকারের পক্ষ থেকেও দমনপীড়ণের মুখোমুখি হতে হয় না। কারণ এসব আন্দোলনে সরকারের ক্ষমতা হারানোর ভয় থাকে না। এ কারণেই কোটাবিরোধী বা নিরাপদ সড়কের মতো আন্দোলন অনেক বড় হয়। কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলনে ক্ষমতা নিয়ে লড়াই চলে বলেই সেগুলোকে পড়তে হয় দমনপীড়ণের মুখে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, "ধরুন দেশে মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষ এখন কষ্টে আছে। কিন্তু বিএনপির যারা আন্দোলন করেন, তারা তাদের দলীয় ইস্যুতে প্রাধান্য দেন। এটা করলে দলের ভিতরে তাদের পদ-পদবি বাড়বে। দলে অবস্থান শক্ত হবে। কোটা বিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এগুলো রাজনৈতিক দলের করার কথা ছিলো। কিন্তু এগুলো এখন ছাত্র ও সাধারণ মানুষ করছে। এই কারণে রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ মানুষের আস্থাও হারাচ্ছে।”

যাদের মানুষ নেতা হিসেবে চেনে তাদের প্রতিকূল পরিবেশে রাজপথে দেখছে না: নুরুল হক নূর

তিনি মনে করেন, "রাজনৈতিক দগুলো গণমূখী না হওয়ায় তারা অনেক সময় সাধারণ মানুষের ইস্যুও বুঝতে পারে না। তারা সব সময় চায় ক্ষমতার পরিবর্তন। কিন্তু সাধারণ মানুষের ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করলে এক সময় সবই হয় তারা তা বুঝতে পারে না।”

২০১৮ সালের আগে কোটা বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নুরুল হক নূর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হিসাবে। তিনি তার সেই সফল আন্দোলন ও জনপ্রিয়তার কারণে ডাকসুর ভিপিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখন তিনি গণ অধিকার পরিষদ নামে একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। এই রাজনৈতিক দলটি তিনিই গঠন করেছিলেন।

তিনি বলেন, "২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ ছাত্রদের সরাসরি একটা হিস্যার বিষয় ছিলো। কোটা উঠে গেলে তাদের চাকরির সুযোগ হবে। কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলন তেমন নয়। এখানে নির্যাতনের ভয়সহ নানা ভয় থাকে। আর আন্দোলন থেকে ওইভাবে সরাসরি লাভ হয় না, বৃহত্তর কোনো লাভ হয়। আর সামাজিক আন্দোলনে সরকারের দমন পীড়ণ তেমন থাকে না। ফলে সবাই অংশ নেয়। কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলনে গ্রেপ্তার, নির্যাতনের ভয় থাকে।”

নূর আরো বলেন, "এরশাদের পতনের পর যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে তারা গণতন্ত্রের নামে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, দমন পীড়ণ চালিয়ে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেছে। ফলে বাংলাদেশের যে দুইটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের যে বলয়  তাদের প্রতি দেশের সাধারণ মানুষ আগ্রহ বা আকর্ষণ বোধ করছে না। ২০১৮ সালে যখন বিরোধী দল রাজপথে দাঁড়াতে পারছিল না, তখনও কিন্তু আমাদের কোটাবিরোধী আন্দোলনে মানুষ রাস্তায় নেমেছে, সমর্থন দিয়েছে।”

তিনি মনে করেন, বিরোধী দলের কর্মসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতা আছে। তারা জনগণের ভাষা ধরতে পারছে না। তার মতে, "বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার, হামলা, মামলা এগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে, তৃতীয় বিশ্বে বা এই উপমহাদেশে একটি নিয়মিত ঘটনা। সেই ক্ষেত্রে বিরোধী দল যদি  শুধু তার রাজনৈতিক এজেন্ডায় পড়ে থাকে, যদি সামাজিক ইস্যু, জনগণের ইস্যুকে রাজনৈতিকভাবে সামনে আনতে না পারে, কাজে লাগাতে না পারে তাহলে তো ওইভাবে জনগণের সমর্থন পাবে না।”

রাজপথের নেতৃত্বেও ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন কোটাবিরোধী আন্দোলনের এই সাবেক নেতা। তিনি বলেন, "মানুষ তো নেতার পিছনে রাজপথে নামবে। কিন্তু গত ৮-১০ বছর ধরে যাদের মানুষ নেতা হিসেবে চেনে তাদের তো প্রতিকূল পরিবেশে মানুষ রাজপথে দেখছে না।”

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এর সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স মনে করেন দেশে এখন যে লুটপাট, অনিয়ম, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি গণতন্ত্রহীনতা চলছে তাতে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আর কোনো ইস্যুর দরকার নেই, এগুলোই যথেষ্ট। তবে তিনি মনে করেন, "এই কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী সরকার যে লুটপাটের অর্থনীতি চালু করেছে, সেটা মানুষকে লোভ আর ভয়ের ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক আন্দোলনকে ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী স্বার্থে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যে সাধারণ মানুষের এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, রাজনীতি বিমুখতাও তৈরি হয়েছে।”

তিনি বলেন, "মানুষ রাজনীতির বাইরে কিন্তু তার অধিকার আদায়ে মাঠে নামছে। যেমন রিকশা ভ্যান শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ে ঢাকা শহর অচল করে দিয়েছিলো। সরকার তাদের  প্রতি মারমুখী না হয়ে দাবি মেনে নিয়েছে। কারণ সরকার মনে করে এরা যদি  আবার রাজনীতিমুখী হয় তাহলে সমস্যা। অন্য সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তাই। তাদের ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করে। কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলনকে তারা দমন করে।”

সরকারের বিরুদ্ধে দমন পীড়ণের এই অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেনের। বরং, সরকার জনগণের কল্যাণে কাজ করে বলেই দেশের মানুষ সরকারের সঙ্গে রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। কামাল হোসেন বলেন, "নিরাপদ সড়ক আমি নিজেও চাই। এটা জনগণের আন্দোলন ছিলো। ফলে সরকার বিবেচনায় নিয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনও সরকার সহানুভূতির সঙ্গে দেখছে। যেকানো যৌক্তিক এবং ন্যায় আন্দোলন এই সরকার বিবেচনায় নেয়।”

আমরা রিস্ক নিচ্ছি না, সাহসী হচ্ছি না, এই কথা ঠিক নয়: সৈয়দ ইমরান সালেহ প্রিন্স

বরং বিএনপির বিরুদ্ধে তার অভিযোগ, দলটি জনগণের ইস্যু নিয়ে কাজ না করে, সন্ত্রাস করে। তিনি বলেন, "বিএনপি বা বিরোধী দল জনগণের ইস্যু নিয়ে  আন্দোলন করে না বলেই সাধারণ মানুষের সমর্থন পায়না। তারা আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস করে বলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নেয়।”

তবে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ ইমরান সালেহ প্রিন্স মনে করেন তার দল সাধারণ মানুষের ইস্যু নিয়েই আন্দোলন করছে। তিনি বলেন, "মানুষের ভোটের অধিকার গণতন্ত্র। এটাই সবচেয়ে বড় ইস্যু। দুর্নীতি,  লুটপাট, দ্রব্যমূল্য, খলেদা জিয়ার মুক্তি এইসব ইস্যুতে আমরা আন্দোলন করছি। কিন্তু সেই আন্দোলন দমন করতে গিয়ে এমন দমন পীড়ণ চালানো হচ্ছে যে এটা একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষও রাস্তায় নামতে ভয় পায়। অন্যদিকে যেসব সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠছে সেই সব আন্দোলন ওইভাবে সরকার দমনে ভয় পায়। কারণ তারা এতে দেশে বিদেশে চরম সমালোচনার মুখে পড়বে।”

বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে, এমন অভিযোগ মানতে নারাজ সৈয়দ ইমরান সালেহ প্রিন্স। তার দলের নেতাকর্মীরা ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে নামছেন না, এমন অভিযোগও সত্যি বলে মনে করেন না তিনি। তিনি বলেন, "৭ জানুয়ারির নির্বাচন তো দেশের মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা তো ভোট দিতে যায়নি। আমরা রিস্ক নিচ্ছি না, সাহসী হচ্ছি না, এই কথা ঠিক নয়। আমরা রাস্তায় নামছি বলেই তো আমাদের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে। তারপরও তো আমরা থেমে নেই।”

সমাজ বিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. নেহাল করিম মনে করেন, কোনো রাজনৈতিক দলই এখন আর মানুষের জন্য চিন্তা করে না। তিনি বলেন,  "সরকার যেমন তার ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য অনিয়ম অনাচার করে, তেমনি বিরোধী যারা আছে তারা ক্ষমতায় থাকতে যে সম্পদ অর্জন করেছে তা হারাতে চায় না। বিএনপির মধ্যেই সরকারের লোক আছে। ২৮ অক্টোবর বিএনপি ঢাকায় অনেক লোক জড়ো করেছিলো কিন্তু তারা তাদের নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে সেটা কাজে লাগাতে পারেনি।”

অতীতেও সরকারের দমনপীড়ণ উপেক্ষা করেই তো আন্দোলন সফল হয়েছে, এমন উদাহরণের কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি। তিনি বলেন, "রাজনৈতিক দলগুলো যখন জনগণের ইস্যু নিয়ে মাঠে নামতে ব্যর্থ হয় তখন সামাজিক আন্দোলন তৈরি হয়। সাধারণ মানুষ নিজেদের ইস্যু নিয়ে নিজেরাই মাঠে নামে।”

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য