‘আমরা শান্তি চাই'
৫ ডিসেম্বর ২০১৩ঢাকার মানুষ এখন রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে চরম শঙ্কা নিয়ে প্রতিটি দিন পার করছে৷ শুধু রাজধানী কেন, গোটা দেশের মানুষেরই এক অবস্থা৷ নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা করা তফসিল বাতিল এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট লাগাতার কর্মসূচি পালন করছে৷ তফসিল অনুযায়ী আগামী ৫ জানুয়ারি ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা৷ প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়েই নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ৷ শেষ পর্যন্ত কি ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হবে? এখন বিরোধীতা করলেও, কোনো কারণে কি বিএনপি নির্বাচনে আসবে? নাকি সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ আসন্ন? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের প্রায় প্রতিটি সাধারণ মানুষের মনে৷
অবরোধের কারণে নিজের বাহন বাদ দিয়ে মোহাম্মদপুর থেকে রিক্সায় কারওয়ান বাজারের অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম৷ রিক্সা চালকের নাম হাফিজুল ইসলাম৷ বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর৷ রিক্সায় যেতে যেতে গল্প জুড়ে দিলাম হাফিজুলের সঙ্গে৷ বিষয় তো এখন একটাই – নির্বাচন, রাজনীতি৷ ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হবে কিনা – এ বিষয়ে তাঁর মতামত চাইলাম, হাফিজুলের সাফ কথা, ‘‘ভাই, হোনেন (শোনেন) একদিন ইক্সা (রিক্সা) নিয়া না বারালি (বেরোলে) হামাগ (আমার) পেট চলে না৷ দুই বেটি (শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া) দ্যাশটারে (দেশটাকে) শ্যাষ (শেষ) কইরা দিল৷ মুই (আমি) রাজনীতি বুঝি না, দিন শ্যাষে (শেষে) চাল লইয়া (নিয়ে) বাসায় ফিরতে হয়৷ ঘরে খাওন (খাওয়া) না থাকলে কেউ দ্যায় (দেয়) না৷ ভাইজান, এসব (নির্বাচন) লইয়া ভাবি না, যা খুশি হোক, হামরা একটু শান্তিত থাকবার চাই৷'' আসলেই তো, দেশে হরতাল-অবরোধ হোক বা নির্বাচন, পেটের তাগিদে হাফিজুলদের তো পথে নামতেই হয়৷ ঘরে খাবার না থাকলে কে দেবে তাঁদের?
কারওয়ান বাজারে রিক্সা থেকে নামতেই এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা৷ তাঁকে সঙ্গে নিয়েই বসলাম পাশের একটি চায়ের দোকানে৷ সেখানেও চা খেতে বসা মানুষগুলোর আলোচনার বিষয়বস্তু আগামী নির্বাচন৷ আলোচনার মধ্যে অনেকটা অযাচিতভাবেই ঢুকে পড়লেন চা দোকানি আবদুর রহিম৷ চাঁদপুরের কচুয়ার এই মধ্য বয়সি দোকানি ঢাকা শহরে চা বিক্রি করেন ১৬ বছর ধরে৷ তিনি বলছিলেন, ‘‘শেখ হাসিনার তাড়া আছে, বঙ্গবন্ধুর বেটি তো, একবার যখন কইছে (বলেছেন) নির্বাচন হবে নির্বাচন কিন্তু করেই ছাড়বে৷ এতে কেউ আসুক আর না আসুক, গ্রহণযোগ্য হোক আর না হোক৷'' চায়ের দোকানে বসা অনেকে তাঁর সঙ্গে একমত হলেও বরিশালের এক সবজি বিক্রেতা আবু তালেব ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, ‘‘এভাবে যদি নির্বাচন অয় হেলে (তাহলে) আরো বহু মাইনষের প্রাণ দেতে (দিতে) অবে (হবে)৷ আর এই গণ্ডগোলে কোনো নেতা মরবে না, সাধারণ মাইনষেরই (মানুষেরই) মরতে অবে৷ মোরা (আমরা) মরমু (মরবো) আর ওরা ক্ষমতায় যাইয়া (গিয়ে) লুইড্ডাপুইড্ডা (লুটেপুটে) খাবে৷ এইডাই (এটাই) তো মোগো (আমাদের) দ্যাশ (দেশ)৷''
অফিসে যাবার তাড়া থাকায় ওই চায়ের দোকানে বেশিক্ষণ বসা হয়নি৷ অফিসে পৌঁছে ভাবছিলাম, রাজনীতির নামে নেতারা দিনের পর দিন জনগণকে জিম্মি করে রেখেছেন৷ সব দলের নেতারাই বলেন, জনগণ তাদের সঙ্গে আছে৷ আসলে যে জনগণ কার সঙ্গে আছে, তা তো শুধু জনগণই বলতে পারে৷ কিন্তু পাঁচ বছর পর একদিন ভোট দেয়া ছাড়া আর কিছু বলার সুযোগ থাকে না জনগণের৷ এক সময় মনে হলো, রিক্সা চালক, চা দোকানি আর সবজি বিক্রেতার বক্তব্য জানিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গেও একটু আলাপ করা দরকার৷ দেখি তাঁরা কী বলেন৷ প্রথমে ফোন করলাম বিরোধী দলীয় চীফ হুইপ জয়নুল আবদীন ফারুককে৷ দু-তিন বার চেষ্টার পর তিনি ফোনটা ধরলেন৷ নিজের পরিচয় দিয়েই রিক্সা চালক, চা দোকানি আর সবজি বিক্রেতার কথা বললাম তাঁকে৷ শুনে তিনি বললেন, ‘‘আওয়ামী লীগের দুঃশাসনে মানুষ অতীষ্ঠ৷ এখন সুযোগ পেলেই বিএনপিকে ভোট দিতে চায়৷ কিন্তু সরকার যেভাবে সবকিছু সাজিয়ে নির্বাচন করতে চায় তাদের সে ইচ্ছা কখনোই পূরণ হবে না৷ আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে৷ এভাবে কোনো নির্বাচন হবে না৷'' কিন্তু সাধারণ মানুষ তো সহিংসতা চায় না – এই মন্তব্যের জবাবে জয়নুল আবদীন ফারুক বললেন, ‘‘বিএনপিও এ সব চায় না, কিন্তু সরকার বাধ্য করছে৷''
বিএনপির এই প্রভাবশালী নেতা জনগণের মনের কথা কিছুটা অন্তত বুঝবেন এবং সে অনুযায়ী কথা বলবেন – এমনটাই আশা ছিল৷ হতাশ হলেও দেরি না করে একজন আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গেও কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলাম৷ ফোন করলাম আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফকে৷ তাঁকেও বললাম রিক্সা চালক, চা দোকানি আর সবজি বিক্রেতার কথা৷ দেশে এখন যা হচ্ছে সাধারণ মানুষ তা চায় না – এ কথা শুনে তিনি বললেন, ‘‘বিরোধী দল জনগণের ভাষা বোঝে না, জ্বালাও-পোড়াও করে ক্ষমতায় যেতে চায়৷ কিন্তু তাদের সে ইচ্ছা কোনোদিনই পূরণ হবে না৷'' কিন্তু সাধারণভাবে জনগণ তো চায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক – এমন মন্তব্যের জবাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় সংবিধানের গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বললেন, ‘‘আমাদের সংবিধানে যা আছে তাতে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই৷ গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যহত রাখতে হলে বিরোধী দলকে নির্বাচনে আসতেই হবে৷ যেভাবে তফশিল ঘোষণা হয়েছে সেভাবেই নির্বাচন হবে৷''
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, সরকার যেভাবে নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে তাতে যেনতেনভাবে একটা নির্বাচন করে ফেললেও সংকট নিরসন হবে না৷ বরং এভাবে চলতে থাকলে ‘অনির্বাচিত শক্তি' ক্ষমতায় চলে আসতে পারে৷ তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাজনৈতিক নেতারাই৷ তিনি বলেন, ‘‘এখনো সময় আছে, সবার সঙ্গে আলোচনা করে, সবাইকে নিয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন করতে পারলেই এই সংকট থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে৷''
আমারও তো সেই কথা৷ আমিও যে চাই দেশ সংকটমুক্ত হোক, শান্তি আসুক৷