করোনার গ্রাসে বাকি সব খবর
১৮ মার্চ ২০২০সংবাদমাধ্যমে এখন শুধুই করোনা। অন্য খবর হয় গুরুত্বহীন অথবা যাচ্ছেই না। অথচ, দিল্লি দাঙ্গার পরে এখনও গৃহহীন কয়েক হাজার মানুষ। ভারতীয় অর্থনীতি বিশবাঁও জলে। সিএএ-এর বিরুদ্ধে এখনও রাস্তায় শাহিনবাগের নারীরা। মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস সরকার ফেলতে মরিয়া বিজেপি। ঘোড়া কেনাবেচার রাজনৈতিক নাটক অন্তিম দৃশ্যে। পশ্চিমবঙ্গে পুরভোট। কাশ্মীরে জটিলবস্থা অব্যাহত। সংসদ চলছে। চলছে বাজেট নিয়ে বিতর্ক। এ সবই চলতি সময়ে গণমাধ্যমে খবরের শিরোনাম হওয়ার কথা ছিল। দেশ জুড়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা গ্রাস করে নিয়েছে সব। ভারতীয় গণমাধ্যম থেকে সোশ্যাল মিডিয়া, চায়ের টেবিল থেকে পাড়ার চায়ের দোকান-- করোনা ছাড়া কারও মুখে কোনও কথা নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, খবরের নিয়মই হল, তা এক বিষয় নিয়ে খুব বেশি দিন চলে না। সময়ের নিয়মেই একটি বিষয় অন্য বিষয়কে গ্রাস করে নেয়। তখন সেটিই হয়ে ওঠে সময়ের আখ্যান। মানুষের মুখে মুখে ফেরে সেই খবর। এই সময়ে যে জায়গাটি গ্রাস করে নিয়েছে করোনা ভাইরাস। শুধু ভারতে নয়, পৃথিবী জুড়ে আশঙ্কা, ভয়, ত্রাস, সংকটের নাম করোনা। চীনের উহান প্রদেশে কয়েক মাস আগে যা প্রথম সংক্রমিত হয়েছিল, আজ পৃথিবীর ১২০ টিরও বেশি দেশে তা ছড়িয়ে পড়েছে। মৃত্যু হয়েছে প্রায় আট হাজার মানুষের। আক্রান্ত প্রায় দুই লক্ষ। গোটা পৃথিবী জুড়ে বন্ধ স্কুল-কলেজ-অফিস কাছারি। মানুষ রাস্তায় বেরতে ভয় পাচ্ছেন। ফলে করোনাই যে এ সময়ের মুখ্য খবরের বিষয় হবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
কিন্তু তাই বলে তো জীবন বন্ধ থাকে না। রাজনীতি, খেলা, সমাজনীতি, যাপনের দৈনন্দিন বিষয়গুলিও বদলায় না। এমন নয় যে, করোনা এসেছে বলে রাতারাতি ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। সমস্ত ধর্ম, গোষ্ঠী, কৌম হাতে হাত রেখে সব ভেদাভেদ দূর করে দিয়েছেন। রাজনীতিকেরা হঠাৎই ধোয়া তুলসি পাতা হয়ে গিয়েছেন। রুপোলি পর্দার কুশিলবেরা প্রচার সর্বস্ব জীবনযাপন করছেন না। হচ্ছে, সবই হচ্ছে। কিন্তু শিরোনাম হচ্ছে না। বস্তুত, অনেক কিছু খবরই হচ্ছে না।
করোনা যদি শিরোনামে না থাকত, তা হলে আজ, বুধবার ভারতের প্রতিটি সংবাদমাধ্যমের হেডলাইন হতে পারত মধ্যপ্রদেশের রাজনৈতিক নাটক। গত এক সপ্তাহ ধরে যে নাটকের অভিনয় শুরু হয়েছে। প্রথমে দল ছাড়লেন বহু দিনের কংগ্রেস নেতা জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। যোগ দিলেন বিজেপিতে। তাঁর সঙ্গে বিদ্রোহী হলেন কংগ্রেস শাসিত মধ্যপ্রদেশ বিধানসভার একাধিক বিধায়ক এবং মন্ত্রী। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তাঁরা চলে গেলেন বিজেপি শাসিত কর্ণাটকে। সেখানে গিয়ে রাজনৈতিক আইসোলেশন নিলেন বিজেপির ছত্রছায়ায়। অন্য দিকে বাকি কংগ্রেস বিধায়কদের হাই কম্যান্ড পাঠিয়ে দিল আর এক কংগ্রেস শাসিত রাজ্যে। মামলা গড়াল সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত। বুধবার যার শুনানি চলছে। এই শুনানির পরে বিধানসভা বসলে জানা যাবে মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস সরকার ধরে রাখতে পারবে, নাকি বিজেপি দখল করবে। সুপ্রিমকোর্টে একদিকে যখন শুনানি চলছে, প্রবীণ কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিং তখন পৌঁছে গেলেন কর্ণাটকে। কিন্তু পুলিশের আপত্তিতে দেখা করতে পারলেন না বিক্ষুব্ধ দলীয় বিধায়কদের সঙ্গে। নিজেকে গান্ধীবাদী বলে একাধিক কেচ্ছায় জড়িত দিগ্বিজয় বসে পড়লেন ধরনায়। শেষে আটকও হলেন। ভারতীয় রাজনীতিতে এমন নাটক চলতেই থাকে। খবরের শিরোনামও হতেই থাকে। কিন্তু করোনা তা হতে দিল না।
শেয়ার বাজারে ধস অবশ্য খবরের শিরোনামে বার বার আসছে। যার মূল কারণ করোনা। গোটা বিশ্ব জুড়েই করোনার কারণে শেয়ার বাজারে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কমছে সোনার দাম। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা না হলেও ভারতীয় অর্থনীতিতে মন্দা অবশ্যম্ভাবী ছিল। গত ছয় বছরে বিজেপির সরকার অর্থনৈতিক বিপ্লবের নামে যা যা ঘটিয়েছে, তার প্রভাব ধীরে ধীরে পরিলক্ষিত হতে শুরু করেছে। কয়েকলক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। নতুন কাজের বাজার তৈরি হচ্ছে না। টাকার দাম কমছে। কমছে ব্যাঙ্কের সুদ। তারই মধ্যে কোটিপতি, প্রভাবশালী ঋণ খেলাপিদের তাণ্ডবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে ইয়েস ব্যাঙ্ক। বাকি ব্যাঙ্কগুলিও ধুঁকছে। সরকার বিক্রি করে দিচ্ছে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা। গত কয়েক মাস ধরে বার বার এ সবই উঠে এসেছে খবরে। কিন্তু করোনা তার থেকেও দৃষ্টি সরিয়ে দিয়েছে।
যেমন বহুদিন খবরে নেই কাশ্মীর। তার মানে সেখানে কিছু ঘটছে না, এমন নয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট চীন সফরে যাচ্ছেন। তা নিয়েও বিবৃতি দিয়েছে ভারত। অন্য সময় এ সব নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক হয় ভারতের গণমাধ্যমে। কিন্তু গত এক সপ্তাহে করোনা ছাড়া কোথাও কোনও চ্যাট শো হচ্ছে না।
আর দাঙ্গা! কয়েক সপ্তাহ আগেও দিল্লি খবরের শিরোনামে ছিল দাঙ্গার কারণে। তারও আগে থেকে প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজের প্রথম পাতা দখল করেছে দেশ জোড়া সিএএ বিক্ষোভ। বিক্ষোভ বন্ধ হয়নি। এ দিনও চেন্নাইতে বিপুল বিক্ষোভ হয়েছে। দাঙ্গার রেশও মোটেই কাটেনি। এখনও ত্রাণ শিবিরে হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু করোনার কারণে সেই সব খবরই তলিয়ে গিয়েছে অতল গভীরে। বিশেষজ্ঞদের যা আভাস, তাতে আগামী কয়েক সপ্তাহে এ পরিস্থিতির বদল হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।