কলকাতায় বিভিন্ন রাস্তায় জঞ্জাল জমে থাকে, ছড়াচ্ছে দূষণ
কলকাতা পুরসভার দাবি, তারা প্রতিদিন জঞ্জাল পরিষ্কার করে। তারপরেও সবসময়ই কলকাতার রাস্তায় জমে থাকে জঞ্জাল। কেন?
মাথাব্যথার কারণ
মূলত তিন ধরনের দূষণে জেরবার শহর কলকাতা। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ আর বর্জ্য থেকে দূষণ। এই তিনটির মধ্যে বর্জ্য থেকে দূষণ পুরসভার সবথেকে বেশি মাথাব্যথার কারণ হলেও এই বিষয়ে সচেতনতা তেমন একটা দেখা যায় না। দূষণ বন্ধের ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগের অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ।
আবর্জনাময় শহর
শহরের বস্তি অঞ্চলগুলিতে ঢোকার মুখে রাখা জঞ্জাল ফেলার ড্রাম উপচে পড়ছে। খাবারের খোঁজে কুকুর উঠে তা উল্টে ফেলেছে। ফলে গৃহস্থালির আবর্জনা রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এই দৃশ্য শহর কলকাতার অলিগুলি ঘুরলেই চোখে পড়বে। কলকাতাবাসীর কাছে এমন দৃশ্য বহুকাল ধরেই ‘স্বাভাবিক’।
পুরসভার দাবি
পুরসভা দাবি করে, শহরের জঞ্জাল দৈনিক নিয়ম করে পরিষ্কার করা হয়। শহরের একাধিক বড় রাস্তার চেহারা দেখে পুরসভার সেই দাবি মানা গেলেও গলিপথের চেহারা অন্য কথা বলে। কোথাও রাস্তার দু’পাশে আবর্জনার স্তূপ, কোথাও গলিপথের পাশের ফাঁকা জমি ভরেছে গৃহস্থালির উচ্ছিষ্টে। উপরের ছবিটি যদিও কলকাতার ‘রাজপথেরই’। এই রাজপথের নাম লেনিন সরণী, যা মৌলালি থেকে শুরু হয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলায় গিয়ে মেশে।
শহরবাসীর অভিযোগ
কিছু কিছু বিশেষ জায়গা বাদ দিলে সর্বত্রই প্রায় এক ছবি। এমনকি, বাড়ি বাড়ি গিয়ে আবর্জনা সংগ্রহ নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। আরও অভিযোগ, বড় আবাসনে নিয়মিত জঞ্জাল সাফাই হলেও বস্তি বা বাজার এলাকায় পুরসভার সাফাইকর্মীদের দেখা মেলে কদাচিৎ।
মুখ্যমন্ত্রীর 'ধমক' সত্ত্বেও
মুখ্যমন্ত্রীকে এক প্রশাসনিক বৈঠকে একবার খেদোক্তি করতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘কেন রাস্তা ঝাঁট দেওয়া হয় না? এ বার কি আমি ঝাঁট দেব?’’ প্রতি বছরই মশাবাহিত রোগের পাশাপাশি ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়ে শহরে। যার জন্য শহরের যত্রতত্র জল জমার পাশাপাশি, জঞ্জাল সাফাই না হওয়ার দিকেও আঙুল তোলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা।
জঞ্জাল পোড়ানোয় বিপদ
শহরে প্রতিনিয়ত সংগৃহীত বর্জ্যের বাইরেও বেশ কিছু বর্জ্য প্লাস্টিক-বন্দি অবস্থায় থেকে যায়। প্রায়শই রাতে বা ভোরের দিকে এই জমে থাকা বর্জ্যের স্তূপে আগুন ধরানো হয়। এ-হেন জঞ্জাল পোড়ানোয় বিপদ কত? তথ্য বলছে, জঞ্জাল থেকে নির্গত মিথেন গ্যাস বিশ্ব উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়েও একুশগুণ বেশি দায়ী।
উদ্বেগের আঁস্তাকুড়
শহরে দৈনিক যে পরিমাণ কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, তার বেশির ভাগটাই কোনও প্রক্রিয়া ছাড়াই আঁস্তাকুড়ে জমা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আবর্জনা খোলা জমিতে ফেলে রাখলে তার থেকে ভূগর্ভস্থ জলে দূষণ ছড়ানোর সম্ভাবনা। শহরের ভাগাড়গুলির স্তূপীকৃত জঞ্জালও দীর্ঘ দিন যাবৎ পরিবেশবিদদের উদ্বেগের কারণ।
পরিবেশ-বিজ্ঞানীর কথায়
পরিবেশ-বিজ্ঞানী তপন সাহা বললেন, “সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের যে স্বীকৃত নিয়মগুলি রয়েছে তা মেনে আমাদের শহরে শুধুমাত্র আবর্জনা সংগ্রহ করা হয় আর তা ভাগাড়ে ফেলে আসা হয়, তা ছাড়া আর কিচ্ছু হয় না। আবর্জনা তুলে ডাম্পিং গ্রাউন্ডে নিয়ে যাওয়ার সময়ও চলন্ত গাড়ি থেকে নোংরা ছড়াতে থাকে। বর্জ্য দিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যা যা করছে তার বিন্দুমাত্রও এখানে হয় না। পুরোটাই পরিকল্পনা আর সদিচ্ছার অভাব।”
মেয়র পারিষদ যা বললেন
কলকাতা পুরসভার জঞ্জাল সাফাই বিভাগের মেয়র পারিষদ দেবব্রত মজুমদার বলেন, “আবর্জনা পুনর্ব্যবহারে আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ করেছি। প্লাস্টিক দিয়ে এখন রাস্তা বানানো হচ্ছে। পাথুরিয়াঘাটায় কন্সট্রাকশন অ্যান্ড ডিমোলিশন ওয়েস্ট দিয়ে পেভার ব্লক তৈরি করছি। প্রযুক্তি উন্নত হচ্ছে। নতুন প্রস্তাব এলে অবশ্যই ভেবে দেখব।” উপরের ছবিটা রেলব্রিজে জমে থাকা জঞ্জাল, যা নিয়মিত পথচারীদের মাথায় পড়ে।
সচেতনতা ও জরিমানা
দেবব্রত মজুমদার আরো জানিয়েছেন, পুরসভার অধিকারিকরা রাস্তায় রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়ান। কেউ যত্রতত্র জঞ্জাল ফেললেই পদক্ষেপ করা হয়। তৎক্ষণাত জরিমানা করার ব্যবস্থাও রয়েছে। এছাড়াও, মানুষকে এ নিয়ে সচেতন করা হচ্ছে।
চল্লিশ লক্ষ টন বর্জ্য
শহর কলকাতার সিংহভাগ আবর্জনার গন্তব্য ধাপার ডাম্পিং গ্রাউন্ড। প্রতিদিন হাজার হাজার টন জঞ্জাল জড়ো হয় ধাপায়। প্রায় ৬০ একর জায়গা জুড়ে স্তূপীকৃত বর্জ্যের পরিমাণ চল্লিশ লক্ষ টনের মতো। এর মধ্যে বায়োরিমিডিয়েশন-এর মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণ করা সম্ভব হয় সামান্য পরিমাণ বর্জ্যের। অবশিষ্টাংশ দীর্ঘ দিন ধরে এলাকার তীব্র দূষণের কারণ। যে কোনও মুহূর্তে সেখানে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা।
মেডিক্যাল ওয়েস্ট
এছাড়াও রয়েছে মেডিক্যাল ওয়েস্ট। যে আবর্জনা সবথেকে বেশি ক্ষতিকর। ধাপায় চিকিৎসা-বর্জ্য ফেলার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ধাপার কাছেই এমন বহু ব্যবসা গড়ে উঠেছে যারা এই চিকিৎসা বর্জ্য বেআইনিভাবে কেনে এবং রিসাইকেলের সঠিক নিয়ম না মেনেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
নাগরিক দায়
এই জঞ্জালের পুরো দায় প্রশাসনের উপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয় বলে মনে করেন অনেকে। উল্টেডাঙ্গার বাসিন্দা দেবপ্রসাদ মিত্র জানিয়েছেন, এই কাজে নাগরিক সচেতনতা এবং সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন, যেটা বাস্তবে প্রায় দেখাই যায় না। অনেকে যত্রতত্র ময়লা ফেলাকে বদঅভ্যাস বলে মনে করেন না। পচনশীল এবং অ-পচনশীল বর্জ্য আলাদা করার জন্য বাড়িতে সবুজ এবং নীল বালতি দেয়া হয়েছিল, দেখা গিয়েছে, অনেক বাড়িতে বালতি গৃহস্থালির কাজে লাগছে।