‘চাকরির সুযোগ না বাড়িয়ে বয়স বাড়ানো কোনো সমাধান না'
১১ জুন ২০২১ডয়চে ভেলে : শিক্ষার্থীরা চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দাবি করছে, এই দাবি কি যৌক্তিক?
ফাহিম মাশরুর : বাংলাদেশের বর্তমান যে চাকরির বাজারের অবস্থা তাতে যারা গ্র্যাজুয়েট, তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে৷ বিভিন্ন গবেষণাও বলছে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে একটি৷ বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ থেকে প্রতি বছর যে গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে তার মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বেকার থাকছে৷ এটা সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে৷ এর কারণও আছে৷ আমাদের গ্র্যাজুয়েটদের জন্য যথেষ্ট চাকরির বাজার তৈরি হচ্ছে না৷ এখানে যত বেশি মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে, তত বেশি চাকরিহীন থাকছে৷ গত ১০ বছরে দুই-তিনবার সরকারি বেতন স্কেলে দুই থেকে তিনগুণ বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে৷ সেই অর্থে প্রাইভেট সেক্টরে বেতন অতটা বাড়েনি৷ কারণ, প্রাইভেট সেক্টরের ইনকাম ওই অর্থে বাড়েনি৷ গত ৫-৭ বছরে আমরা দেখেছি, বেসরকারি সেক্টরে চাকরির প্রতি আগ্রহ অনেক কমে গেছে৷ সবাই সরকারি চাকরি করতে চায়৷
চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর আন্দোলনকে আপনি কীভাবে দেখেন?
এটাকে আমি দেখি, অন্য সবকিছুর একটা বহিঃপ্রকাশ৷ কেউ হয়ত দুই-তিনবারেও বিসিএসে ঢুকতে পারলো না৷ সে মনে করছে, আরো হয়ত সুযোগ পেলে সে ঢুকতে পারবে৷ এই কারণে সে আন্দোলন করছে, সুযোগ চাচ্ছে৷ আমার মনে হয়, এটা দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান না৷ আমাদের আসলে গ্র্যাজুয়েটদের জন্য চাকরির সংস্থান করতে হবে৷ আমরা যদি প্রাইভেট সেক্টরে এই গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে এই ধরনের ডিমান্ড এমনিতেই কমে যাবে৷ আসলে যারা আন্দোলন করছে, সুযোগ বাড়লেই যে তারা চাকরি পাবে তার কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা নেই৷ এখানে সরকারি চাকরির জন্য যে আবেদন পড়ে সেটা পদের চেয়ে দুই-তিনশ' গুণ বেশি৷ বয়স বাড়ানো হলে দুই-তিনজনের হয়ত চাকরি হবে৷ বাকি ৯০ বা ৯৫ জনের কিন্তু চাকরি হবে না৷ ফলে বয়স বাড়ানো একমাত্র সমাধান না৷
এখন চাকরির বাজারের যে অবস্থা তাতে এটা করা হলে সংকট বাড়বে না কমবে?
আমার মনে হয়, বয়স বাড়ানো বা কমানোর উপর সংকটের সমাধান নির্ভর করে না৷ এটা হলে যেটা হবে, একজন শিক্ষার্থী এখন হয়ত দুই বা তিনবার বিসিএস দেওয়ার সুযোগ পায়, বয়স বাড়ানো হলে তারা হয়ত ৫ বার এই সুযোগ পাবে৷ তার মধ্যে হাতে গোনা সৌভাগ্যবান কয়েকজন এই সুযোগ পাবে৷ আসলে যে পরিমান আবেদন পড়ে বিসিএসের জন্য, তার চেয়ে চাকরি অনেক কম৷ চাকরির সুযোগ না বাড়লে বয়স বাড়িয়ে সমস্যার সমাধান হবে না৷
প্রতিবেশী দেশগুলোতে চাকরির বয়সসীমা কেমন? করোনা পরিস্থিতিতে তারা কি নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে?
প্রতিবেশী দেশগুলোতেও চাকরির বয়সসীমা আমাদের মতোই৷ আমি মনে করি, এখন তো মানুষের কর্মক্ষমতা বেড়েছে৷ অর্থাৎ, আগে যে বয়সে অবসরে যেতো, এখন সেই বয়সের পরও তার কর্মক্ষমতা থাকে৷ সেই অর্থে আমরা হয়ত বয়সসীমা বাড়াতে পারি৷ আগে কিন্তু সেশনজটের কারণে অনেকেই চাকরিতে ঢোকার সময় খুব বেশি পেতো না৷ এখন কিন্তু সেশনজট কমে গেছে৷ এতে ২৩-২৪ বছর বয়সেই পড়াশোনা শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ এরপর কিন্তু সে চাকরির জন্য বেশ কয়েক বছর সুযোগ পাচ্ছে৷ করোনা পরিস্থিতির কারণে সর্বোচ্চ এক বছর বয়স বাড়ানো যেতে পারে৷ খুব বেশি বাড়ানোর পক্ষপাতি আমি না৷
পাশ করার পর চাকরির জন্য একজন শিক্ষার্থীর কত বছর সুযোগ পাওয়া উচিত?
আমি মনে করি, পাশ করার পর সরকারি চাকরির জন্য সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৫ বছর তার সুযোগ পাওয়া উচিত৷ যে এই ৫ বছরে ঢুকতে পারবে না, তাকে যদি ১০ বছর সুযোগ দেওয়া হয় তারপরও তার সম্ভাবনা কম৷
বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কেমন?
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক বা আইএলও'র সমীক্ষা বলছে, প্রতি বছর ৫ থেকে ৬ লাখ গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বের হচ্ছে৷ এদের প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ বেকার থাকছে৷ সেই অর্থে প্রতি বছর ৩ লাখের মতো বেকার তৈরি হচ্ছে৷ এটা আশঙ্কাজনক৷ আমার হিসেবে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা পরিসংখ্যাগতভাবে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ৷ দেশে হয়ত সামগ্রিক বেকারের সংখ্যা ১০ শতাংশের কম৷ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা এখন সামাজিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে৷
এই সংকট সমাধানের উপায় কী?
আমরা যে প্রতি বছর ৫-৬ লাখ গ্র্যাজুয়েট বের করছি এটা আমাদের দেশের অর্থনীতির তুলনায় অনেক বেশি৷ কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় অনেক বেশি ছাত্র-ছাত্রীর আসা উচিত৷ যাতে সে টেকনিক্যাল বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারে৷ এদিকে আরো বেশি বিনিয়োগ ও মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে৷ যারা টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউশন থেকে বের হচ্ছে, তাদের মধ্যে কিন্তু বেকারত্ব অনেক কম৷ এখানে কিন্তু ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী চাকরি পেয়ে যায়৷ এটা একটা উপায়৷ আরেকটা হলো, যেহেতু আমরা একটা ইয়াং কান্ট্রি, সেখানে প্রতি বছর ২৪ লাখের মতো মানুষ চাকরির বাজারে আসছে৷ তাদের বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে৷ যেমন তাদের উদ্যোক্তা বানানোর ব্যাপারে আরো বেশি কাজ করতে হবে৷ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাই কিন্তু বেশি চাকরির ব্যবস্থা করে থাকেন৷ অনেক গ্রাজুয়েট কিন্তু এখানে আসছে৷ তারা কৃষি বা গরুর খামার করছে৷ তাদের সহায়তা করতে হবে৷
কারিগরি শিক্ষার দিকে সরকারের মনোযোগ কতটুকু?
গত ৫ থেকে ১০ বছরে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অনেক বেড়েছে৷ প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হচ্ছে৷ শুধু অবকাঠামো বানালে হবে না, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে ধরনের স্কিল দরকার সেই ধরনের করে তাদের তৈরি করতে হবে৷ আমাদের সোশ্যাল মাইন্ডসেট চেঞ্জ করতে হবে৷ আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণি মনে করে, তার ছেলে বা মেয়েকে গ্র্যাজুয়েট হতেই হবে৷ অথচ আমরা দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা একটা শিক্ষার্থীর ১০-১২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি হয় না৷ অথচ একটি পলিটেকনিক থেকে পাশ করে বেরিয়ে ১৫-২০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি পেয়ে যাচ্ছে৷ অভিভাকদের এটা বুঝতে হবে৷
দেশের চাকরির বাজারে কতভাগ সরকারি আর কতভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে?
আমাদের হিসাবে সরকারি চাকরির সংখ্যা খুবই কম৷ আমাদের যে ৫ লাখ শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েশন করে বের হচ্ছে, তার ১০ ভাগেরও কম, অর্থাৎ ৫০ হাজারেরও কম শিক্ষার্থী সরকারি চাকরিতে ঢুকছে৷ বাকি সাড়ে ৪ লাখ সরকারি চাকরিতে ঢোকার সুযোগই পায় না৷ প্রাইভেট সেক্টরে চাকরির জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান যেন আরো তৈরি হয় সেদিকে নজর দিতে হবে৷
সরকারি চাকরিতে বয়স বাড়ালে বেসরকারি সেক্টরে কোনো প্রভাব পড়বে?
আমার মনে হয় না কোনো প্রভাব পড়বে৷ তবে যেটা হয়েছে, গত ১০ বছরে সরকারি চাকরিতে বেতন তিনগুণ বেড়ে গেছে৷ সেটার প্রভাব প্রাইভেট সেক্টরে পড়েছে৷ এখন ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা প্রাইভেট সেক্টরে যোগ দিতে চায় না৷ সবাই সরকারি চাকরিমুখি হয়ে গেছে৷ এ কারণে আমরা দেখছি, প্রাইভেট সেক্টরে ট্যালেন্টেড লোক খুঁজে পাচ্ছি না৷ ট্যালেন্টেডরা আগে প্রাইভেট সেক্টরে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হলেও এখন আর হচ্ছে না৷ ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান যোগ্য লোক খুঁজে পাচ্ছে না৷ এখন তারা দেশের বাইরে থেকে বহু মানুষকে চাকরি দিচ্ছে৷ এতে একটা বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে৷
করোনা পরিস্থিতিতে তো পরীক্ষা না নিয়েই সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে৷ তাহলে এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার বিষয়টা আসছে কেন?
আমি মনে করি, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর খুব একটা ভিত্তি নেই৷ এখন যেটা আছে, ৩০ বছর সেটা যথেষ্ট বলেই আমি মনে করি৷ কোভিডের পরও কিন্তু একজন শিক্ষার্থী ২৪-২৫ বছরে সার্টিফিকেট পেয়ে যাবে৷ তারপরও সে ৫ বছর চাকরির পরীক্ষার সুযোগ পাবে৷ শিক্ষার্থীরা যে দাবিটা তুলছে, সেটা হয়ত তার দিক থেকে ঠিক আছে৷ কিন্তু সামগ্রিকভাবে যদি আপনি দেখেন, তাহলে এই দাবির যৌক্তিক ভিত্তি আছে বলে আমার মনে হয় না৷
এখন তো বিসিএসেও এক ধরনের জট লেগে গেছে, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের পথ কী?
করোনা পরবর্তী সময়ে এই জটগুলো ছোটানোর ব্যবস্থা করতে হবে৷ অল্প সময়ের মধ্যে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে৷ অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে৷ প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হয়৷ পাশাপাশি সরকারি চাকরির প্রতি সবাই যেন আগ্রহী না হয়ে প্রাইভেট সেক্টরেও যায়, সে ব্যাপারে প্রাইভেট সেক্টরকে প্রনোদনা দিয়ে তৈরি করতে হবে৷ এর আসলে সামগ্রিক সমাধান দরকার৷