ছাইমেঘের জন্য বিজ্ঞানীরা প্রস্তুত
১৬ মে ২০১০প্রেক্ষাপট
এইয়াফিয়াদলা৷ কি, শোনা শোনা মনে হচ্ছে নামটি? হ্যাঁ সত্যিই ধরেছেন৷ এটি একটি আগ্নেয়গিরি৷ তবে সাধারণ কোনো আগ্নেয়গিরি নয়৷ আইসল্যান্ডের এই আগ্নেয়গিরিটির কারণেই তো গত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে বিপদে পড়তে হয়েছিল লাখ লাখ বিমান যাত্রীকে৷ কারণ এইয়াফিয়াদলার অগ্ন্যুৎপাত৷ আর সেটা থেকে তৈরি হয়েছিল ছাইমেঘ৷ পাথর আর কাচের টুকরো ছিল ছাইমেঘে – যা বিমানের ইঞ্জিন আর জানালার কাচের জন্য ক্ষতিকারক৷ সেজন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বিমান চলাচল৷ পুরো ইউরোপ জুড়ে বাতিল করতে হয়েছিল প্রায় এক লক্ষ ফ্লাইট৷ আর এজন্য মাত্র ছয়দিনেই বিমান সংস্থাগুলোকে লোকসান গুনতে হয়েছিল প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের মতো৷
কিন্তু আসলেই কি ছাইমেঘ এতো ভয়ংকর? এর কারণে কি বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই? তাহলে তো এই ধরণের ঘটনা হরহামেশাই ঘটতে থাকবে৷ এইতো কিছুদিন আগেও, অর্থাৎ এমাসের প্রথম সপ্তাহে ছাইমেঘের কারণে এক-দুইদিনের জন্য ইউরোপের কয়েকটি বিমানবন্দর বন্ধ রাখতে হয়েছিল৷ তাহলে কি মানুষ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ছাইমেঘের কাছেও অসহায় হয়ে পড়ছে? এতোসব প্রশ্নের ভিড়ে কিছুটা আশার বাণী শুনিয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷ তাঁরা বলছেন, ছাইমেঘের প্রভাব নিয়ন্ত্রণে তাঁরা আগের চেয়ে এখন আরও ভালভাবে প্রস্তুত৷ কিন্তু কীভাবে? বিজ্ঞানীরা দুটি উপায় বের করেছেন৷ এর মধ্যে একটি হলো কম্পিউটার মডেলিং আর অন্যটি লেজার৷
ছাইমেঘের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ
প্রথমে জেনে নিই কম্পিউটার মডেলিং বিষয়টি কী এবং কীভাবে তা করা হয়? সোজা কথায়, এটি একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম, যার মাধ্যমে কোনো বিষয় সম্পর্কে আগে থেকেই জানা সম্ভব৷ বিজ্ঞানের বহু গবেষণায় আজকাল কম্পিউটার মডেলিং-এর সহায়তা নেয়া হচ্ছে৷ তেমনিভাবে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের পর ছাইমেঘ কোন দিক দিয়ে যাবে, ভূমি থেকে কতটা উচ্চতায় থাকবে – সব বলে দেয়া সম্ভব এই কম্পিউটার মডেলিং-এর সাহায্যে৷ এর জন্য যেটা জানা প্রয়োজন সেটা হলো, কী পরিমাণ ছাইমেঘ উৎপন্ন হয়েছে তার পরিমাণ৷ আর এই জায়গায়টাই গতবার ভুল করে ফেলেছিলেন আইসল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা৷ এর ফলে কম্পিউটার মডেলিং-এ সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন ইটালির ইনস্টিটিউট অব অ্যাটমোস্ফিয়ারিক সায়েন্স এ্যান্ড ক্লাইমেট-এর বিশেষজ্ঞ জান পাওলো গোবি৷ তিনি বলছেন, আইসল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা যেভাবে অগ্ন্যুৎপাত স্থলে ধোঁয়ার পরিমাণ নির্ণয় করেছিলেন, সেটা ছিল ভুল৷ এদিকে প্যারিসের এক আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ পিয়ের ফ্লামঁ বলছেন যে, ধোঁয়ার পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ণয় করা গেলে বিজ্ঞানীরা বাতাস প্রবাহিত হওয়ার দিকের উপর নির্ভর করে বলে দিতে পারবেন যে, ধোঁয়া ঠিক কোন্ দিক দিয়ে যাবে৷
একটি জার্মান বিশেষজ্ঞ দলও পরবর্তীতে এইয়াফিয়াদলার বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন৷ এ মাসেই গবেষণাটি করা হয়৷ সেখানে ভাল ফল পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে৷ ঐ গবেষণা অনুযায়ী, এইয়াফিয়াদলা থেকে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় তিন টন ধোঁয়া উৎপন্ন হয়েছিল৷ তবে ধোঁয়াতে যে শক্ত উপাদানগুলো ছিল সেগুলোর অধিকাংশই প্রায় সাত ঘণ্টা পর আবার ভূমিতে নেমে এসেছিল৷ জার্মান মহাকাশ সংস্থা ডিএলআর-এর ইনস্টিটিউট অব অ্যাটমোস্ফিয়ারিক ফিজিক্সের পরিচালক উলরিশ শুমান জানিয়েছেন এ তথ্য৷ তিনি বলেন মাটি, আকাশ ও স্যাটেলাইট থেকে পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি যদি কম্পিউটার মডেলিং-এর সহায়তা ঠিকমতো নেয়া যায়, তাহলেই আসল পরিস্থিতিটা জানা সম্ভব৷ ভিয়েনাতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে শুমান বলেন, বিজ্ঞানীরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রস্তুত৷
লেজার প্রযুক্তি
বিজ্ঞানীরা অন্য আরেকটি উপায়ও খুঁজে পেয়েছেন৷ আর সেটা হলো লেজার৷ ভূমি, বিমান বা স্যাটেলাইট থেকে লেজার প্রযুক্তি ব্যবহার করে বায়ুমণ্ডল সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া সম্ভব বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন৷ ‘রাডার' সম্পর্কে তো সবাই জানেন৷ কিন্তু ‘লিডার' সম্পর্কে কি কারও ধারণা আছে? না, হঠাৎ করে কোনো নেতার কথা বলছিনা৷ ‘লিডার' শব্দটি ভেঙে বললে দাঁড়ায় ‘লাইট ডিটেকশন এ্যান্ড রেঞ্জিং'৷ রাডারের মতোই কাজ করে লিডার৷ বাতাসের সঙ্গে থাকা বিভিন্ন উপাদান ভূমি থেকে ঠিক কতটা উপরে আছে, তা বের করা সম্ভব লিডারের সাহায্যে৷ ভূমি থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত কাজ করে লিডার৷ ফ্রান্সের গবেষক এমানুয়েল রোসঁশের বলছেন, বায়ুমণ্ডলে ছাইয়ের উপস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেতে লিডার বেশ সহায়ক৷ পুরো ইউরোপ জুড়ে এ ধরণের ২১টি লিডার স্টেশন রয়েছে৷
তাহলে কি এবার যাত্রীরা কিছুটা আশান্বিত হতে পারবেন? এর উত্তর ভবিষ্যতেই পাওয়া যাবে৷
প্রতিবেদন: জাহিদুল হক
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন