তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসার পথ সুগম হলো
১৭ ডিসেম্বর ২০২৪বিশ্লেষকদের কথা, এই ব্যবস্থা পুরোপুরি ফিরে আসতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের আদেশ তার রিভিউ নিষ্পত্তি হতে হবে৷ কারণ ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে৷ এবং ওই সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিলো৷ আর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়েছিলো৷
মঙ্গলবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ও গনভোট ফিরিয়ে এনে পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিক বাতিল করে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট৷ বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার আগামী জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন আদালত৷ সংসদ আইন অনুযায়ী জনগণের মতামত নিয়ে বিধানগুলো সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে বলে রায়ে উল্লেখ করে হাইকোর্ট৷ বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এ রায় দেন৷
২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাস হয়৷ ওই সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা৷ এর পর দেশে গত তিনটি নির্বাচন আওয়ামী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়৷ যেখানে দেশ তো বটেই আন্তর্জাতিক মহলেও এর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে৷ পঞ্চদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে গত ১৮ আগস্ট সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিট করেন৷ আদালত রুল জারি করলে এর সঙ্গে বিএনপি, গণফোরাম, জামায়াতসহ সংস্থা, ব্যক্তিসহ বেশ কয়েকজন যুক্ত হন৷
মঙ্গলবার পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে রায় ঘোষণা করলেন হাইকোর্ট৷ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫৪টি ক্ষেত্রে সংযোজন, পরিমার্জন ও প্রতিস্থাপন আনা হয়েছিল৷ রায়ে আদালত বলেছে, পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটা বাতিল করা হচ্ছে না৷
অন্যদিকে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদনের শুনানি হওয়ার কথা আগামী ১৯ জানুয়ারি৷ বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সুরাহা হবে৷
কীভাবে ফিরবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার?
পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের আবেদনের পক্ষের আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আজকের (মঙ্গলবার) রায়ের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসার অর্ধেক পথ সুগম হলো৷ পুরো ফিরে আসতে ত্রয়োদশ সংশোধনী রিভিউয়ের মাধ্যমে বহাল হতে হবে৷ আর তা হলে সংসদে আর আইন পাশ করতে হবে না৷ সংবিধানে সয়ংক্রিয়ভাবে ফিরে আসবে৷”
তার কথা, "তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দুইভাবে বাতিল হয়েছে৷ প্রথমত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন৷ দ্বিতীয়ত, ওই রায়ের আলোকে সংসদ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছিলো৷ সংসদ যে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করেছিলো সেটা আজকের রায়ের মধ্য দিয়ে বাতিল হয়ে গেল৷ এখন বাকি আছে বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ যে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ করেছিলো সেটা৷ ওই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করা হয়েছে৷ এখন রিভিউয়ে যদি আপিল বিভাগের রায় বাতিল হয় তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পথে আর কোনো বাধা থাকবেনা৷ তাহলে তত্ত্বাবধায়ক ফিরিয়ে আনতে সংসদে নতুন কোনো আইন এবং গণভোটের ব্যবস্থার প্রয়োজন হবেনা৷”
তবে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিষ্ট্রার জেনারেল ও সাবেক বিচারক ইকতেদার আহমেদ মনে করেন, "আপিল বিভাগ যদি রিভিউয়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী বহাল রাখে তারপরও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনতে সংসদে আইন পাশ করতে হবে৷ গণভোটের আয়োজন করতে হবে৷ কারণ বাস্তবে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নাই, অস্তিত্বহীন৷ সংবিধানে এটা আপনাআপনি ফিরে আসতে পারেন৷ ফলে আগামী সংসদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷ আর পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হওয়ার ফলেও একই পথ খুলে গেল৷ আগামী সংসদে গণভোটোর আয়োজনের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনা যাবে৷ তবে সেটার ফরম্যাট কী হবে তা সংসদই নির্ধারণ করবে৷”
তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘প্রশ্ন আছে সংসদ সার্বভৌম, না আদালত সার্বভৌম৷ জনগণের সার্বভৌমত্বের মধ্য দিয়ে আদালতের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়৷ আর সুপ্রিম কোর্ট যদি দেখে কোনো আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, যতটুকু সাংঘর্ষিক ততটুকুর ব্যাপারে তারা বলতে পারে৷ তারা যদি বাতিলও করে, যতক্ষণ পর্যন্ত সংসদ সেটার ব্যাপারে পদক্ষেপ না নেবে ততক্ষণ পর্যন্ত বাতিল হবেনা৷”
অন্তর্বর্তী সরকারই কি নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে?
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যদি উচ্চ আদালতের রায়ের ফলে সংবিধানে সরাসরি ফিরে আসে তাহলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান কী হবে? এই সরকারই কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসাবে কাজ করবে? অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এই প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, "অন্তর্বর্তী সরকারেরই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামকরণ হবে৷ এই সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রিনেমড হবে, যেমন, জেলা ও দায়রা জজের নাম শুনেছেন৷ একই ব্যক্তি যখন সিভিল মামলা করেন, তখন তাকে বলা হয় জেলা জজ৷ ওই একই ব্যক্তি যখন ক্রিমিনাল মামলা পরিচালনা করেন, তখন তাকে জেলা জজ বলা যায় না, তখন তিনি দায়রা জজ৷ এই ব্যক্তিরাই যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সিস্টেমে চলে যাবেন ওনারাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবেন৷ এটাতে সাংবিধানিক সাংঘর্ষিকের কোনো জায়গা নেই৷'' তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আপিল বিভাগে যে রিভিউ পেন্ডিং আছে তা বাইপাস করেই এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে৷”
তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, "বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার হওয়ার সুযোগ নাই৷ কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আগে যেভাবে সংবিধানে ছিলো, রায়ের ফলে সেভাবেই ফিরে আসবে৷ মেয়াদ তিন মাস৷ আর সেখানে রাষ্ট্রপতি কীভাবে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টা নিয়োগ দেবেন তার বিধান আছে৷ সর্বশেষ অবসর নেয়া প্রধান বিচারপতি, তা না হলে তার আগের জন, এইভাবে৷ আর সংবিধানে তো এই অন্তর্বর্তী সরকারের বিধান নেই৷”
"তারপরও রাষ্ট্রপতি যদি ওনাদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন, সেক্ষেত্রে তারা শুধু নির্বাচনটা পরিচালনা করতে পারবেন৷ আর সেটা হলে তারা নতুন দল গঠন বা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না৷ তখন যারা নির্বাচন করবেন তারা আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারে থাকতে পারবেন না৷ এর মধ্যে তো অনেক রাজনৈতিক কথা হচ্ছে৷ তারা দলও গঠন করবেন,” বলেন তিনি৷
তিনি বলেন, "সংবিধান মানলে তো ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হয় সংসদ ভেঙে দেয়ার পর৷ এরপর আরো ৯০ দিন পাওয়া যায় যদি দৈব দুর্বিপাক হয়৷ তারপর কী বলবেন? এখন তারা যা করছেন পরবর্তী সংসদ এসে যদি এর বৈধতা না দেয় তাহলে তাদের কাজ তো বৈধ হবেন৷”
রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, "পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিক বাতিল হয়েছে৷ কতটুকু বাতিল হয়েছে তা দেখতে হবে৷ যেমন এই সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্র পরিচলনার যে চার মূলনীতি তা ফিরে এসেছিলো৷ আমরা তো ওই মূলনীতি চাই৷ সেটা আছে কী নাই এখনো স্পষ্ট নয়৷ তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে বলতে পারি যে, দেশে একটি সঠিক নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে ওঠার আগ পর্যন্ত নির্বাচনের জন্য এই ব্যবস্থা চলতে পারে৷ আর অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সম্পর্ক আছে বলে আমি মনে করিনা৷ দুইটা দুই ব্যবস্থা,” বলেন তিনি৷
বার বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, "পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের রায় একটি ঐতিহাসিক রায়৷ এর মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে এলে জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে৷”
তার কথা, "ফ্যাসিবাদী আয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দেশের মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলো৷”
১৯৯০ সালে সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের পতনের পর চারটি সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে৷ ১৯৯১ সালে, ১৯৯৬ সালে ,২০০১ সালে ও ২০০৮ সালে তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়৷
এদিকে দেশে তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়৷ ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসন কার্যের বৈধতা দান প্রসঙ্গে গনভোট হয়৷ ১৯৮৫-তে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সমর্থন যাচাইয়ে অনুষ্ঠিত হয়৷ ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী আইন প্রস্তাব নিয়ে হয় তৃতীয় গনভোট৷