তরুণ ভোটারদের টানতে তারা কী করছেন?
১৭ ডিসেম্বর ২০১৮সম্প্রতি ‘লেটস টক উইথ শেখ হাসিনা' নামে একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তরুণদের তাঁর জীবনের গল্প শোনান৷ গল্প শোনান মুক্তিযুদ্ধের, ভাষা আন্দোলনের, তাঁর জীবন সংগ্রামের৷ তরুণদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন৷ জবাব দেন দেশের উন্নয়ন নিয়ে নানা প্রশ্নের৷ তিনি সেখানে তরুণদের নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথা বলেন৷ বলেন, ভবিষ্যৎ নেতাদের জীবন কেমন হবে তা নিয়ে৷আগে ধারণ করা এই অনুষ্ঠান কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার করা হয় ১৩ ডিসেম্বর রাতে৷ তিনি তরুণদের নিয়ে এই অনুষ্ঠানে প্রাণবন্ত এবং সাবলীল ছিলেন৷ তরুনরাও তাঁকে তাদের প্রশ্ন করেছেন অকপটে৷ তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটান যেন গল্পে গল্পে৷ তাঁরাও ছিলেন উচ্ছ্বসিত৷ প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে কখনো তাঁরা হেসে ওঠেন, কখনো করতালিতে ফেটে পড়েন৷
শেখ হাসিনা নির্বাচনের আগে এরকম ঘরোয়া পরিবেশে আর কাউকে সময় দেননি৷ সময় দিয়েছেন শুধু তরুণদেরই৷ আর এ থেকেও ধারণা করা যেতে পারে তরুণরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, কতটা কেন্দ্রে রয়েছেন তাঁরা৷ এবার শুধু আওয়ামীলীগই নয়, সব রাজনৈতিক দলই তরুণদের গুরুত্ব দিচ্ছে৷ যাঁরা এবার নতুন ভোটার হয়েছেন, তাঁদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে৷ কারণ, তরুণ ভেটাররাই এবার নির্বাচনে নিয়ামক ভূমিকা পালন করবেন৷ তাঁরা যেদিকে যাবেন, ভোটের ফল সেদিকেই যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা৷ সাবাই তাই চাইছেন তারুণ্যের প্রথম ভোট যেন তাদের পক্ষে আসে৷
চলতি বছরেই তরুণরা বড় দু'টি সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন৷ আন্দোলন গড়ে তুলেছেন৷ কোটা সংস্কার আন্দোলন যেমন জনসমর্থন পেয়েছে, তেমনি নিরাপদ সড়ক আন্দোলন দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ দু'টি আন্দোলনের প্রতিই সব শ্রেণির মানুষ সমর্থন দিয়েছে৷ সমর্থন দিয়েছে এই কারণে যে, তারা ব্যক্তিগত নয়, সবার স্বার্থে মাঠে নেমেছিলেন৷ এর আগে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চও ছিল তারুণ্যের সৃষ্টি৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলনও দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ কিন্তু এই তরুণরা সব সময় যে ভালো থেকেছেন তা নয়, তাঁরা সামাজিক আন্দোলন করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ জেলে গিয়েছেন৷ তারুণ্য অপমানিত হয়েছে৷ তারুণ্যের অবমাননা আর দেখতে চায় না এই প্রজন্ম৷ তারা চায়, তরুণবান্ধব এক দেশ, তারুণ্যবান্ধব সরকার ও রাজনীতি৷
৩১ জানুয়ারি সর্বশেষ ভোটার তালিকা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন৷ আর তাতে মোট ভোটার ১০ কোটি ৪১ লাখ ৪২ হাজার ৩৮১ জন৷ তাতে নতুন ভোটার যোগ হয়েছে ৪৩ লাখ ২০ হাজার৷ তবে নবম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা করার পর থেকে ১০ বছরে দেশে তরুণ ভোটার বেড়েছে দুই কোটি ২৫ লাখের মতো৷ তাঁদের অধিকাংশের বয়স এখন ১৮ থেকে ২৮ বছর৷ তাঁদের মধ্যে ১ কোটি ২১ লাখ ৩৪ হাজারেরও বেশি ভোটার এবারই প্রথম জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার পেয়েছেন৷
আর বাংলাদেশের মোট জনসংখার ৬৮ শতাংশ মানুষের বয়স ১৫ থেকে ৫৯-এর মধ্যে৷ জনমিতির পরিভাষায়, এরা হলেন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট জনগোষ্ঠী৷ তার মানে হলো, বাংলাদেশে এখন নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর চেয়ে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বেশি৷ এটা জনসংখ্যার সুসময়ের কাল৷
এই ডেমেগ্রাফিক ডিভিডেন্টকে ব্যবহারের মধ্যে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন নির্ভর করে৷ আর তা ব্যবহারের মানে হলো কর্মক্ষম জনগোষ্ঠিকে দক্ষ করে তুলে কাজে লাগাতে হবে৷ তার জন্য দরকার শিক্ষা সংস্কার এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মস্থান৷
সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিবছর নতুন করে ২২ লাখ কর্মক্ষম লোক চাকরি বা কাজের বাজারে প্রবেশ করে৷ কিন্তু কাজ পায় মাত্র সাত লাখ কর্মক্ষম মানুষ৷ দুই তৃতীয়াংশ কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ পায় না৷ আর সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, এ বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বেশি৷
তরুণ ভোটার সাইফুল বাতেন টিটো বলেন, ‘‘সবাই তরুণ ভোটারদের কথা বললেও নির্বাচনের আগে কোনো রাজনৈতিক দল তরুণদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি বা পরিকল্পনার কথা বলছে না৷ সবাই সাধারণ ও গতানুগতিকভাবে কর্মসংস্থান, শিক্ষার উন্নয়নের কথা বলছে৷ বলছে, আত্মকর্মসংস্থানের কথা৷ কিন্তু সেটা কিভাবে হবে, তা আমরা জানতে পারছি না৷ চটকদার স্লোগান আছে৷ যেমন, আওয়ামী লীগ বলছে, তারুণ্যের প্রথম ভোট নৌকায় হোক, তারুণ্যের প্রথম ভোট মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে হোক৷ বিএনপি হয়ত তরুণদের জন্য আরেকটি স্লোগান দেবে৷ কিন্তু সেটা আমার কাছে কার্যকর কিছু মনে হয় না৷''
টিটো বলেন, ‘‘একজন তরুণ ভোটার হিসেবে আমি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থারআমূল পরিবর্তন চাই৷ চাই নকল ও প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ হোক৷ আমি চাই কাজের নিশ্চয়তা৷ কথা বলার স্বাধীনতা চাই৷ তরুণরা নানা অনিয়য়ম-অব্যবস্থা নিয়ে আন্দোলন করেছে৷ তারা হয়রানি ও গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছে৷ এটা যেন আর না হয়৷''
তবে রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, তরুণদের জন্য তাদের অনেক পরিকল্পনা আছে, নির্বাচনি ইশতাহারেও তা থাকছে৷ তরুণদের প্রাধান্য দিয়েই তারা তাদের বড় বড় পরিকল্পনা করছেন৷ শিক্ষার উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, আত্মকর্মসংস্থান আর সৃজনশীল কাজের জন্য সহায়ক নানা প্রকল্প নেবেন তারা৷ প্রধানমন্ত্রী তাঁর ‘লেটস টক উইথ শেখ হাসিনা' অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘আমরা যা করছি, তা তরুণদের জন্যই করছি, কারণ তারাই দেশের ভাবিষ্যৎ৷ তারা শুধু চাকরি করবে না, চাকরি দেবে৷''
ওই অনুষ্ঠানেই কয়েক তরুণ নিজে প্রধানমন্ত্রী হলে কী করবেন– এমন প্রশ্নের জবাবে, ‘‘প্রধানত শিক্ষার উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, আত্মকর্মসংস্থান ও মানসিক চাপ মুক্তির কথা বলেছেন৷''
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ইশতাহারে এবার প্রচলিত প্রকল্পগুলোর সঙ্গে তরুণদের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে দু'টি প্রকল্প থাকছে৷ তার মধ্যে শিক্ষিত বেকারদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপযুক্ত কর্মসস্থানের একটি প্রকল্প এবং যাঁরা স্বল্পশিক্ষিত বেকার, তাঁদেরও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে লোন দিয়ে প্রধানত আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার ব্যাপারটিও রয়েছে৷
আওয়ামী লীগের ইশতাহার প্রনয়ন কমিটির সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের ইশতেহারে তরুণদের জন্য চমক থাকছে৷ তবে তা এখন প্রকাশ করা যাচ্ছে না৷ প্রধানমন্ত্রী যখন ইশতাহার প্রকাশ করবেন, তখনই কেবল জানা যাবে৷ তবে আমি কিছু ইঙ্গিত দিতে পারি৷ তথ্য প্রযুক্তির অগ্রগতি প্রমাণ করে, বাংলাঅদেশের তরুণরা মেধাবী৷ একটি পরিবারের একটি তরুণ চাকরি পেলে একটি পরিবারের লাভ হয়৷ কিন্তু একজন তরুণ উদ্যোক্তা হলে অনেক পরিবারের লাভ হয়, অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়৷ আমাদের এখন যে উন্নয়নের ধারা, সেটা আরো গতি পাবে৷ আর সেটা হবে তরুণদেরকে কেন্দ্র করে৷ আমরা উদ্যোক্তায় পরিণত হতে চাই৷ তরুণদের নিয়ে সেই পরিকল্পনাই নিয়ে আসা হচ্ছে৷''
বিএনপিও ইশতাহারে তরুণদের গুরুত্ব দিচ্ছে৷ তারাও তরুণদের আকৃষ্ট করতে নানা কৌশল নিচ্ছে৷ আর তাদের এই কৌশলে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে কোটা সংস্কার এবং নিরপাদ সড়ক চাই আন্দোলনের ইস্যুগুলোকে৷ বিএনপি'র প্রাধান্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবিগুলোর মধ্যে এই দু'টি ঘটনায় যাঁরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, আটক হয়েছে, তাঁদের মুক্তি এবং ক্ষতিপূরণের কথা বলা হয়েছে৷ বলা হয়েছে, তাঁদের দাবিগুলো বাস্তবায়নের কথা৷ বিএনপির ইশতাহার প্রনয়ন কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘চাকরিতে কোটা মেধা বিকাশের পথে অন্তরায়৷ আমরা তাই দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া আর সব ক্ষেত্রে কোটা রাখার বিরুদ্ধে ছিলাম৷ তরুণরাও তাই চেয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘তরুণরা যেন অপমানের শিকার না হয়, তাঁরা যাতে নিগ্রহের শিকার না হয় আমাদের নজর সেদিকেই৷ তাঁরাই সমাজ পরিবর্তন করে৷ আর এটা করতে গিয়ে তাঁরা যেন বাধার মুখে না পড়ে আমরা সেই পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি৷ তরুণদের সম্মান করতে হবে৷ আমরা তাঁদের সম্মান করতে চাই৷''
তিনি বলেন, ‘‘ইশতাহারে আমরা তরুণদের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা বলছি৷ তাঁদের শিক্ষার জন্য ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তাঁদের শিক্ষার খরচ কমানো, সৃজনশীল কাজ ও উচ্চশিক্ষায় সহায়তার প্রকল্প থাকছে৷ আর তাঁদের কর্মসংস্থানই শুধু নয় , তাঁরা যাতে নিজেরা উদ্যোক্তা হতে পারে, আত্ম কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে, সেজন্য বিশেষ প্রকল্প থাকবে৷ তরুণদের গবেষণা এবং সৃজনশীল কাজে আমরা অর্থসহ নানাভাবে সহায়তা করব, প্রয়োজন অনুযায়ী উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে পাঠাবো৷''
আওয়ামী লীগের এবার নির্বাচনি প্রচারের মূল সুর উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা৷ আর বিএনপি'র গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা৷ আওয়ামীলীগ উন্নয়নের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রাধান্য দিচ্ছে৷ বিএনপি বলছে, গণতান্ত্রিক চেতনার কথা৷ আর এর মধ্যে তরুণদের আকৃষ্ট করার উপাদান আছে বলে উভয় দলই মনে করে৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷