দুই মাসে ২৫টির বেশি অগ্নিকাণ্ড, কলকাতায় কেন এত আগুন লাগে?
নভেম্বর ও ডিসেম্বরে পঁচিশটিরও বেশি আগুন লাগে কলকাতা শহরে। কলকাতা কেন জতুগৃহ হয়ে উঠেছে?
বার বার বস্তিতে আগুন
গত সপ্তাহে চব্বিশ ঘণ্টার ব্যবধানে কলকাতার দুই জায়গায় বস্তিতে আগুন লাগে। তপসিয়ার পর নিউ আলিপুর। বারবার শহরের বস্তিগুলোয় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। কখনও উল্টোডাঙায়, কখনও কালিকাপুর বা প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের ঝুপড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে।
উদ্বিগ্ন মেয়র
বার বার শহরের ঝুপড়িগুলিতে আগুন লাগার ঘটনা নিয়ে উদ্বিগ্ন কলকাতার মেয়র তথা পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। শনিবার নিউ আলিপুরের দুর্গাপুর সেতুর নিচের বস্তিতে আগুন লাগার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছন তিনি।
১০ দিনে আঠেরোটি অগ্নিকাণ্ড
কখনও আবাসনের সিঁড়ির নিচে থাকা মিটার বক্স থেকে আগুন লেগে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। কখনও শীতের আগুন পোহাতে গিয়ে পুড়েছে ঘর-দোকান। রাস্তার ধারের গুমটি, দোকান বা কাঠের গুদামে অগ্নিকাণ্ড— কলকাতায় আগুন লাগার ঘটনা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। লালবাজার সূত্রের খবর গত নভেম্বরে পনেরো দিনের মধ্যে পঁচিশটি আগুন লাগে কলকাতা শহরে। তার মধ্যে আঠেরোটি অগ্নিকাণ্ড শেষ ১০ দিনের মধ্যে ঘটেছিল।
তপসিয়ার বস্তিতে আগুন
গত ২০ ডিসেম্বর সকালে তপসিয়ার বস্তিতে আগুন লাগে। শতাধিক ঝুপড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। দমকল পৌঁছতে দেরি করায় স্থানীয় লোকজন খালের জল বালতি করে তুলে নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে বলে অভিযোগ।
দমকলের পৌঁছাতে দেরি
দমকলের পৌঁছতে দেরি হওয়ার অভিযোগ বহু ক্ষেত্রেই থাকে। এক দমকল আধিকারিকের কথায়, ‘‘বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, সরু গলিতে বড় গাড়ি ঢোকার জায়গা খুঁজতে খুঁজতেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তা যাতে কোনও ভাবে না হয় এবং দ্রুত যাতে ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারে, তার জন্য মোটরবাইকগুলি মূলত কাজ করে।’’ এই জন্য আগুন নেভানোর পাশাপাশি বস্তি এলাকার বাসিন্দাদের সচেতনতা বাড়াতেও দমকলের তরফে জোর দেওয়া হচ্ছে।
পরপর দু-দিন
তপসিয়া অগ্নিকাণ্ডের ঠিক পরের দিনই আগুন লাগে নিউ-আলিপুরে দুর্গাপুর ব্রুজের নিচের বস্তিতে। স্থানীয়দের দাবি, আগুন লাগার জেরে সেতুটির গার্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই স্থানীয়েরা সেতুটির স্বাস্থ্য পরীক্ষার দাবি তুলতে শুরু করেছেন।
পুলিশের অনুমান
এর কয়েক দিন আগে কাঁকুলিয়া রোডেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। প্রাথমিক ভাবে জ্বলন্ত ধূপ থেকে সেই আগুন ছড়ায় বলে পুলিশের অনুমান। তারও আগের কয়েকদিনে যাদবপুরের লর্ডসের মোড় থেকে শুরু করে সার্ভে পার্ক, নারকেলডাঙা, মুচিপাড়া-সহ শহরের একাধিক থানা এলাকায় বার বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।
কখনো ধূপ কখনো সিলিন্ডার কখনো শর্ট সার্কিট
শীতে এমনিতেই শহরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বৃদ্ধি পায় বলে পুলিশ ও দমকলের দাবি। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে যত্রতত্র আগুন জ্বালিয়ে শরীর গরম করা, ঘরে মশার হাত থেকে বাঁচতে জ্বলন্ত ধূপ বহু ক্ষেত্রেই অগ্নিকাণ্ডের প্রাথমিক কারণ হয় বলে তারা মনে করেন। এ ছাড়া, শর্ট সার্কিট থেকে আগুন তো আছেই। শুকনো আবহাওয়ায় দ্রুত সেই আগুন ছড়ায়।
মানা হচ্ছে না বিধি
শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ—সর্বত্রই আগুন সংক্রান্ত বিধিনিষেধ না মেনে ব্যবসা চলছে বলে অভিযোগ। বারণ সত্ত্বেও যত্রতত্র ব্যবহার করা হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার। মধ্য কলকাতায় এমন অনেক বেকারি রয়েছে যেখানে এখনও মান্ধাতার আমলের চুল্লিতে আগুন জ্বালানো হয়। এইসব ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে।
নেই অগ্নিনির্বাপনের সঠিক ব্যবস্থা
কলকাতা শহরের বেশিরভাগ বাজারের অবস্থা খারাপ। আগুন নেভানোর ব্যবস্থা নেই, তার উপর বাজার এতটাই ঘিঞ্জি, যে আগুন লাগলে প্রাণ হাতে করে পালিয়ে আসাও কঠিন। উপরের ছবিটি পার্কসার্কাস রেল স্টেশনের পাশের বাজারের।
দমকলমন্ত্রীকে চিঠি
এই পরিস্থিতিতে দমকল বিভাগ যাতে কঠোর হয়, সেই কথা জানিয়ে সম্প্রতি কলকাতা পুরসভার তরফে চিঠি দেওয়া হয়েছে দমকলমন্ত্রী সুজিত বসুকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ঘিঞ্জি এলাকায় বার বার আগুন লাগা নিয়ে ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন।
আইন না-মানলে
শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় থাকা গুদাম, কারখানা থেকে শুরু করে শপিং মল এবং বহুতলে ফি বছর ফায়ার-অডিট বাধ্যতামূলক করতে চলেছে দমকল। আইন না-মানলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান চালাতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন সুজিত বসু। এক দিকে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হবে, অন্য দিকে কঠোর নিয়ম চালু করে আগুন রোখার যাবতীয় চেষ্টা সরকার করবে বলে জানিয়েছেন দমকলমন্ত্রী।
তারের জঙ্গল
শহরের বিভিন্ন জায়গায় এমন তারের জঙ্গল হয়ে রয়েছে। এক শহরবাসীর কথায়, কলকাতা শহরের, বিশেষত বস্তি অঞ্চলগুলোয় তার যেন মাকড়সার জালের মত বিছোনো। সরকার চাইলে আইন এনে এগুলো ঠিক করতে পারে। পাশের রাজারহাট নিউটাউনে কোনও ওভারহেড তার নেই, কলকাতা কি পারে না?