সার্নের গবেষণা
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২ইতিহাস
গত বছর সেপ্টেম্বরে ইউরোপের একদল বিজ্ঞানী বলেন, আলোর চেয়ে দ্রুত গতিতে চলে নিউট্রিনো৷ প্রায় তিনবছর গবেষণার পর এই তথ্য প্রকাশ করেন সার্নের বিজ্ঞানীরা৷ সার্ন হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বড় পদার্থবিজ্ঞান গবেষণাগার৷
বিজ্ঞানীদের এই তথ্য হুমকির মুখে ফেলে দেয় বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত সমীকরণ E=MC² অর্থাৎ আইনস্টাইনের ‘থিওরি অব স্পেশাল রিলেটিভিটি' বা বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে৷ কেননা এই তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, আলোর চেয়ে দ্রুতগতির আর কিছু নেই৷ আজ থেকে প্রায় ১০৬ বছর আগে আইনস্টাইন এই কথা বলেছিলেন৷ পরবর্তীতে অনেকবার পরীক্ষা করা হলেও আইনস্টাইনের কথাটাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়৷ বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের উপর ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে পদার্থবিজ্ঞানের অন্যান্য অনেক তত্ত্ব৷
সার্নের গবেষণা ফল প্রকাশিত হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেন বিশ্বের তাবৎ বিজ্ঞানী৷ তাদের বেশিরভাগই মনে করতে থাকেন যে, নিশ্চয় কোথাও গণ্ডগোল হচ্ছে! কেননা এতদিনকার একটা তত্ত্ব আজ হঠাৎ ভুল বলে প্রমাণিত হবে - সেটা মেনে নিতে পারছিলেন না তাঁরা৷ সন্দেহের মধ্যে ছিলেন খোদ গবেষকরাও৷ নিজেদের গবেষণার ফল নিজেদেরই বিশ্বাস হচ্ছিলনা! তাই বারবার একই পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে চেয়েছেন তাঁরা৷ কিন্তু সবসময় একই ফল পান গবেষকরা৷ এরপর যেদিন গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয় সেদিন তাঁরা এই বিষয়ে আরও গবেষণা করার জন্য বিশ্বের অন্যান্য বিজ্ঞানীদের আহ্বান জানান৷
কোথায় ত্রুটি?
সম্প্রতি অ্যামেরিকার বিখ্যাত জার্নাল ‘সায়েন্স ইনসাইডার'এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়৷ তাতে সার্নের বিজ্ঞানীদের গবেষণায় সম্ভাব্য দুটি ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়৷ এর একটি ‘লুজ' অর্থাৎ ঢিলা অপটিক্যাল ফাইবার কানেকশন - যে কারণে সময় গণনায় ভুল হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ আর আরেকটি ত্রুটি হতে পারে ‘অসিলেটর'এ৷ এটাও সময় গণনার একটি যন্ত্র৷
মার্কিন ঐ জার্নালের প্রতিবেদনের পর সার্নের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে৷ তাতে সম্ভাব্য ঐ দুটি ত্রুটির কথা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে৷ এবং বলা হয়েছে, আগামী মে মাসে তারা আবার নতুন করে গবেষণা শুরু করবেন৷
সার্নের মুখপাত্র জেমস গিলিস বলেন, গবেষণার ফল এখন সন্দেহের মুখে৷ আরেক মুখপাত্র আর্নড মার্সোলিয়ার বলেন, এটা একটা জটিল গবেষণা৷ অনেক কেবল আর যন্ত্র নিয়ে কাজটা করতে হয়েছে৷ পদার্থবিজ্ঞানীরা আবার সবকিছু পরীক্ষা করে দেখা শুরু করেছেন, এবং এটা চলবে৷
পূর্বের গবেষণা
সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের কাছে সার্নের ল্যাবরেটরি অবস্থিত৷ বিজ্ঞানীরা সেখান থেকে ৭৩০ কিলোমিটার দূরে থাকা ইটালির রোমের কাছে মাটির নীচের ‘গ্রান সাসো' ল্যাবরেটরিতে নিউট্রিনো পাঠান৷ এসময় তারা দেখতে পান যে, আলোর চেয়েও দ্রুতগতিতে লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে নিউট্রিনো৷ সংখ্যার হিসেবে, নিউট্রিনো আলোর চেয়ে ৬০ ন্যানোসেকেন্ড বেশি দ্রুতগতির৷ অর্থাৎ এক সেকেন্ডকে যদি একশো কোটি ভাগ করা হয়, তাহলে তার ৬০ ভাগ যতটুকু সময় হবে ঠিক ততটুকু সময় আগে নিউট্রিনো রোমের ল্যাবরেটরিতে গিয়ে পৌঁছে৷
সার্নের এই গবেষণা ফল নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সেসময়, বেঁচে থাকা পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত স্টিফেন হকিং, আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছিলেন৷ আরেক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের কণা-পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক জেফ ফোরশাও বলেছিলেন, সার্নের গবেষণার ফল যদি সত্যি হয় তার মানে হলো আজকের তথ্য পাঠিয়ে দেয়া যাবে অতীতে৷ অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন, ‘‘আমরা কল্পবিজ্ঞানে হরহামেশাই যে ‘টাইম ট্রাভেল'এর কথা পড়ি সেটা সত্যি হবে৷'' তবে সঙ্গে সঙ্গে তিনি এও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, তার মানে এই নয় আমরা খুব তাড়াতাড়িই টাইম মেশিন বানাতে যাচ্ছি৷
নিউট্রিনো কী?
সার্নের এক বিজ্ঞানীর মতে, নিউট্রিনো সাধারণত পরমাণু চুল্লিতে তৈরি হয়৷ ১৯৩৪ সালে প্রথমবারের মতো নিউট্রিনোর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এটা শুধু বিজ্ঞানীদের অবাকই করে যাচ্ছে৷ এ কারণে অনেকে নিউট্রিনোকে ‘ভুতুড়ে কণা' বলে থাকে৷
প্রতিবেদন: জাহিদুল হক
সম্পাদনা: রিয়াজুল ইসলাম