1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পরিচালকের দায়িত্বশীলতা বনাম পুলিশের ‘সম্মান'

সমীর কুমার দে ঢাকা
১ জানুয়ারি ২০২১

সম্প্রতি একটি অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে ‘নবাব এলএলবি'৷ সেখানে পুলিশকে হেয় করার অভিযোগে ছবির পরিচালক ও এক শিল্পীকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ একে বাকস্বাধীনতার হস্তক্ষেপ মনে করছেন অনেকেই৷

https://p.dw.com/p/3nQqC
Bangladesh Cinema
ছবি: DW/M. Mamun

গত ২৪ ডিসেম্বর রাতে তাদের গ্রেফতারের পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনারঝড় ওঠে৷ কেউ কেউ মনে করেন ‘আপত্তিকর' সংলাপ রাখা পরিচালকের ঠিক হয়নি৷ তবে বেশির ভাগ মানুষই পুলিশের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন৷ অনেকে এটাকে বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন হিসেবে দেখছেন

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান লিটন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি এই গ্রেপ্তার প্রক্রিয়াকে পরিস্কারভাবে বাক স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ হিসেবেই দেখি৷ এর আগে কখনো চলচিত্রের সংলাপের জন্য কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি৷ এর অর্থ হলো, এখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহনশীলতা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? মনে হলো, আর কাউকে গ্রেপ্তার করে ফেললো৷ পুলিশের উর্ধ্বতনরা কি বলতে পারবেন, তাদের বাহিনীর প্রতিটি সদস্য নিষ্কলুষ? পুলিশের কোনো সদস্য মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে না?''

তবে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘বাক স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়৷ আপনার বাক স্বাধীনতা থাকবে৷ কিন্তু আপনি সবকিছু বলতে পারবেন? এখন পুলিশকে নিয়ে যে সংলাপ উপস্থাপন করা হয়েছে, এটা এভাবে না করলেই ভালো হতো৷ আবার পুলিশ যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এটাও অন্যভাবে দেখানো যেতো৷ কে কিভাবে বিষয়টি সামলাবে সেটি তার ব্যাপার৷ এখন পুলিশ কি আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করেছে? উত্তর হবে- না৷ এদের গ্রেপ্তারের পর আদালতে পাঠানো হয়েছে, মামলার যদি যৌক্তিকতা না থাকতো তাহলে আদালত তাদের জামিন দিয়ে দিতো৷ কিন্তু আদালত তাদের কারাগারে পাঠিয়েছে৷ আবার তারা যে সংলাপ ব্যবহার করেছে আপনি কি সেটির সমর্থন করতে পারবেন? কোনভাবেই না৷''

‘‘পরিচালক যা বলবেন শিল্পী তাই করবেন সেটা হয় নাকি?’’: মুশফিকুর রহমান গুলজার

খ্যাতিমান পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরী মনে করেন, যা ঘটেছে পুরো বিষয়টি দুঃখজনক৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘সিনেমায় যেটা এসেছে সেটাও ঠিক হয়নি, আবার পুলিশ যেটা করেছে সেটাও ঠিক হয়নি৷ কেউই দায়িত্বশীল আচরণ করেননি৷ একজন পরিচালক হিসেবে আমি বিষয়টিকে দুঃখজনক ও বিরক্তিকর হিসেবেই দেখছি৷''

গত ২৪ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের পরিদর্শক নাসিরুল আমিন বাদী হয়ে রমনা থানায় পর্নোগ্রাফি আইনে একটি মামলা দায়ের করেন৷ এই মামলায় ‘নবাব এলএলবি' ছবির পরিচালক অনন্য মামুন, অভিনেতা শাহীন মৃধা ও অভিনেত্রী অর্চিতা স্পর্শিয়াকে আসামি করা হয়েছে৷ ওই দিন রাতেই অভিযান চালিয়ে মামুন ও শাহীনকে গ্রেফতার করা হয়৷ স্পর্শিয়াকেও খুঁজছে বলে দাবি করেছে পুলিশ৷

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ‘‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে ধর্ষণের শিকার এক নারী থানায় পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ করলে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রশ্নোত্তর দেখানো হয়েছে৷ সেখানে ধর্ষণের বর্ণনা ও জিজ্ঞাসাবাদ অত্যন্ত আপত্তিকর ভাষায় করা হয়েছে৷ তা সুস্থ বিনোদনের পরিপন্থী হওয়ায় পরিবার-পরিজনসহ একত্রে বসে দেখা সম্ভব নয়৷ যা জনসাধারণের মধ্যে পুলিশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করবে৷ এই ভিডিওটি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর জন্য অত্যন্ত মানহানিকর এবং ভিডিওর মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে জনসাধারণের সম্মুখে অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে৷''

চলচ্চিত্রের বিষয় নিয়ে একজন শিল্পীকে গ্রেপ্তারের বিষয়টিকে কিভাবে দেখছে শিল্পী সমিতি? সমিতির সাধারণ সম্পাদক চিত্রনায়ক জায়েদ খান বলেন, ‘‘প্রথমত শিল্পী শাহীন মৃধা আমাদের সমিতির সদস্য না৷ তাকে আমি চিনিও না৷ তারপরও আমি মনে করি, এই ধরনের সংলাপ বলা তার ঠিক হয়নি৷ আমি এজন্য পরিচালককে দায়ী করবো৷ কারণ, শিল্পীরা কাদামাটির মতো৷ পরিচালকরা তাদের দিয়ে যে সংলাপ বলায় সেই সংলাপই শিল্পীরা বলেন৷ আর এই ছবিটি সেন্সর বোর্ড দিয়ে যায়নি৷ ফলে পুরো দায়িত্ব পরিচালককেই নিতে হবে৷ বিষয়টি যেহেতু এখন আদালতে গড়িয়েছে, তাই বেশি কিছু বলা ঠিক হবে না৷''

চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদও মনে করেন, পুলিশের চরিত্রকে যেভাবে, যে ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে, সেটা ঠিক হয়নি৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘স্বাধীনতা মানে যা খুশি তাই নয়৷ একটি সিনেমা দেশকে রিপ্রেজেন্ট করে৷ ফলে পরিচালক কাজটি ঠিক করেননি৷''

তবে চলচিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার মনে করেন এক্ষেত্রে শিল্পীরও দায় এড়ানোর সুযোগ নেই৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘পরিচালক যা বলবেন শিল্পী তা-ই করবেন সেটা হয় নাকি? শিল্পীর বিচার বিবেচনা থাকবে না? পরিচালক বললেন, নগ্ন হয়ে অভিনয় কর, শিল্পী সেটা করবেন? আমি একটা উদাহরণ দেই, একবার একটি ছবিতে পরিচালক নায়িকা শাবনূরকে একটি ড্রেস দিয়ে সেটি পরতে বললো৷ অনেক খোলামেলা হওয়ায় শাবনূর সেটা পরেনি৷ পরে পৃথক ড্রেস তৈরি করতে হয়েছে৷ এতে কি শাবনূরের জনপ্রিয়তা কমে গেছে? আমি মনে করি, যে চলচ্চিত্রটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে তাতে যে ধরনের সংলাপ এসেছে সেটা আনা কোনোভাবেই উচিত হয়নি৷ আবার পুলিশ যেভাবে রিঅ্যাক্ট করেছে সেটাও এভাবে না হলেই হয়তো ভালো হতো৷ তবে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হয়েছে, অনলাইনে যে ছবিগুলো মুক্তি পাচ্ছে সেগুলো সেন্সরবোর্ড ছাড়াই মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলাম৷ অনেক তরুণ ভালো কাজও করছিল৷ এখন দু'একটি ঘটনার পর এগুলোও সেন্সরবোর্ড হয়ে যাওয়ার পক্ষে দাবি উঠছে৷ ফলে এগুলো সেন্সরবোর্ডে গেলে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ থাকবে না৷''

‘‘এই ধরনের সংলাপ বলা ঠিক হয়নি’’: জায়েদ খান

চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম খসরুও মনে করেন, ‘নবাব এলএলবি' চলচিত্রে যে ধরনের সংলাপ উপস্থাপন করা হয়েছে সেটা ঠিক হয়নি৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘যে ছবিগুলো সেন্সরবোর্ড হয়ে যায় সেগুলোর ব্যাপারেই শুধু আমরা বলতে পারি৷ অনলাইনে মুক্তি পাওয়া এই ছবিটির সঙ্গে প্রযোজক সমিতির কোনো সম্পর্ক নেই৷ আমি মনে করি, প্রতিটি ছবি সেন্সরবোর্ড হয়েই যাওয়া উচিত৷ তাহলে এই ধরনের কুরুচিপূর্ণ সংলাপ থাকতে পারতো না৷ কারণ, একটা ছবি পরিবারের সবাই মিলে দেখে৷ সেটা পরিচালকদের মাথায় রাখা উচিত৷''

পরিচালক ও শিল্পীকে গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গে অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনামুখর৷ তারা এই গ্রেফতার প্রক্রিয়াকে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসহিষ্ণু আচরণ হিসেবে দেখছেন৷ বাকস্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপও বলেছেন কেউ কেউ৷

তবে বিষয়টি এভাবে দেখতে রাজি নন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘সিনেমাটি আমি দেখিনি৷ ফলে এটা নিয়ে মন্তব্য করা কঠিন৷ তবে এটুকু বলতে পারি, আইনের ব্যত্যয় হলে অবশ্যই পুলিশ মামলা করতে পারে৷ এখন আপনি তো সিনেমায় যা খুশি তাই বলতে পারেন না৷ দেশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না৷''