বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের ধর্মঘটের ঘোষণা
২১ অক্টোবর ২০১৯বোর্ডের কাছে ১১ দফা দাবি জানিয়েছেন ক্রিকেটাররা। আর সে দাবি পূরণ হবার আগ পর্যন্ত সব ধরনের ক্রিকেটীয় কার্যক্রম বয়কটের ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা।
চলতি জাতীয় ক্রিকেট লিগ তাতে অনিশ্চয়তায় পড়ল। ঘোর অনিশ্চয়তায় জাতীয় দলের আসন্ন ভারত সফরও। সপ্তাহ দেড়েক পরই দুই টেস্ট এবং তিন টি-টোয়েন্টি খেলার জন্য ভারত যাবার কথা রয়েছে বাংলাদেশ দলের।
আজ দুপুরে শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে এসে ক্রিকেটাররা জানিয়ে যান এসব দাবি। তাতে সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদ উল্লাহসহ শীর্ষ পর্যায়ে প্রায় সব ক্রিকেটার উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় দলের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাই কেবল ছিলেন না।
সব ক্রিকেটারদের দাবির কথা মুখপাত্র হিসেবে তুলে ধরেন সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদ, নাঈম ইসলাম, এনামুল হক জুনিয়র, এনামুল হক বিজয়, জুনায়েদ সিদ্দিকী, নুরুল হাসান সোহানরা। বিপিএলে বিদেশী ক্রিকেটারদের সমান পারিশ্রমিক, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ‘প্লেয়ার্স বাই চয়েস’ বাদ দিয়ে ক্রিকেটারদের দল বেছে নেবার স্বাধীনতা, জাতীয় ক্রিকেট লিগের ম্যাচ ফি, ডেইলি অ্যালাউন্স বাড়ানো, ক্রিকেটারদের সংগঠন কোয়াবের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারির পদত্যাগ, ঘরোয়া ক্রিকেটের সুনির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার, ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রতিযোগিতা বাড়ানোসহ নানা দাবি তাঁদের।
অনেক দিন ধরেই ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ দানা বাঁধছিল ক্রিকেটারদের ভেতরে। বিশেষত এবারের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিসিবির আয়োজনের ঘোষণা দেবার পর। আর সেটি হলে যে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক অনেক অনেক কমে যাবে, সেটিও স্পষ্ট করে বলেছেন বোর্ড প্রেসিডেন্ট থেকে পরিচালকরা।
মাশরাফি-সাকিব-তামিম-মুশফিকদের ক্ষোভের বড় জায়গা এটিই। ক্ষোভের আরেক বড় কারণ চলতি জাতীয় ক্রিকেট লিগে পারিশ্রমিক না বাড়ানো। দেশের প্রথম শ্রেণির এই টুর্নামেন্টের প্রথম স্তরের চার দলের খেলোয়াড়দের ম্যাচ ফি ৩৫ হাজার টাকা; দ্বিতীয় স্তরের জন্য ২৫ হাজার টাকা। চার দিনের ম্যাচ খেলার পর এই অর্থ নিতান্তই অপ্রতুল বলে মনে করেন ক্রিকেটাররা। ট্র্যাভেল অ্যালাউন্সের ২৫০০ এবং ডেইলি অ্যালাউন্সের ১৫০০ টাকাও তাই। গতবারের এসব ফি বাড়ানোর প্রতিশ্র“তি ছিল এবার। সেটি হয়নি। যদিও দিন কয়েক আগের সংবাদ সম্মেলনে বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, ‘‘এবার ১০% বাড়ানো হয়েছে।’ এর কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। আর ১০ শতাংশ বাড়ানো হলেও তাতে ক্রিকেটাররা সন্তুষ্ট নয় বোধগম্য কারণেই।’’
সংবাদ সম্মেলনে প্রথম দাবি হিসেবে ক্রিকেটারদেরই সংগঠন কোয়াবের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারিসহ সবার পদত্যাগ দাবি নাঈম ইসলামের। ক্রিকেটারদের স্বার্থ নিয়ে সংগঠনটি কখনোই সরব নয় বলে। সবার প্রতিনিধি হয়ে মাহমুদ উল্লাহর কণ্ঠে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ আগের অবস্থায় ফেরানোর দাবি, ‘‘এখন যেভাবে ডিপিএল হয়, তাতে সব খেলোয়াড় অসন্তষ্ট। আগে আমরা দল বেছে নিতে পারতাম, পারিশ্রমিক নিয়ে আলোচনা করতে পারতাম। এখন তা হয় না। প্রিমিয়ার লিগ আগে যেভাবে চলত, সেটি যেন ফিরে পাই, এটি আমাদের দাবি।’’
মুশফিকুর রহিমের দাবিতে উঠে আসে বিপিএল, ‘‘এবার বিপিএল অন্য নিয়মে হচ্ছে। তা আমরা সম্মান করি। তবে আমাদের দাবি পরের বছর থেকে যেন আগের নিয়মে বিপিএল চলে। আর স্থানীয় ক্রিকেটাররা যেন বিদেশীদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ন্যায্য পারিশ্রমিক পায়, এটিও দাবি।’’ সাকিবের কণ্ঠে উঠে আসে মূলত ঘরোয়া ক্রিকেটের দাবিগুলো, ‘‘প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আমাদের ম্যাচ ফি করতে হবে এক লাখ টাকা। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের বেতন ৫০ শতাংশ বাড়াতে হবে। আমাদের অনুশীলন সুবিধা বাড়াতে হবে।
১২ মাস কোচ-ফিজিও-ট্রেনার অ্যাপয়েন্ট করতে হবে, যেন তারা সব ক্রিকেটারকে সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসে। আমরা মানসম্পন্ন বল চাই। ডেইলি অ্যালাউন্স ১৫০০ টাকার চেয়ে বাড়াতে হবে। ডেইলি অ্যালাউন্স ২৫০০ টাকায় হয় না। আমরা যেন ম্যাচ ভেন্যুতে বিমানে যেতে পারি, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আর মাঠে যে বাসে যাই, সেটি যেন মানসম্মন্ন হয়; অন্তত যেন এসি থাকে।’’
এনাম জুনিয়র তুলে ধরেন চুক্তিভুক্ত খেলোয়াড়দের সংখ্যা এবং তাঁদের বেতন বাড়ানোর দাবি। তামিম দাবি করেন, কোচ, আম্পায়ার, ফিজিও, ট্রেনার থেকে গ্রাউন্ডসম্যানসহ সবার বেতন বাড়ানো এবং সর্বত্র বিদেশীদের চেয়ে বাংলাদেশীদের অগ্রাধিকার। এনামুল হক বিজয় ডিপিএলের মতো আরেকটি ওয়ানডে টুর্নামেন্ট, বিপিএলের আগে আরেকটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট, জাতীয় লিগের সঙ্গে ওয়ানডে ম্যাচ রাখার দাবি জানান। নুরুল হাসানের দাবি ঘরোয়া ক্রিকেটর জন্য নির্ধারিত ক্যালেন্ডারের। সবার প্রতিনিধি হয়ে জুনায়েদ সিদ্দিকী বলেন, ডিপিএলের পারিশ্রমিক যেন ক্রিকেটাররা নির্দিষ্ট সময়ে পায়। আর বিদেশে দুটোর বেশি ফ্র্যাঞ্জাইজি খেলতে পারবে না বলে যে নিয়ম করেছে বিসিবি, সেটি বদলোনার দাবি জানান ফরহাদ রেজা।
দাবি জানানো শেষে ক্রিকেটারদের প্রতিনিধি হয়ে ক্রিকেটীয় কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা সাকিবের, ‘‘যত দিন পর্যন্ত আমাদের দাবি পূরণ না হবে, ততদিন কোনো ক্রিকেটীয় কার্যক্রমে জড়িত থাকতে চাইছি না। এর মধ্যে জাতীয় লিগ, জাতীয় দলের প্রস্তুতি, ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ম্যাচ সব অন্তর্ভুক্ত। শুধু অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিশ্বকাপ প্রস্তুতি চলছে বলে ওদের বাদ রাখছি। এর বাইরে সব ক্রিকেটারকে আমরা এর আওতায় আনছি।’’ দাবি মানার পরই ক্রিকেটীয় কার্যক্রমে ফিরে যাবার কথা জানান তিনি, ‘‘দাবীগুলো মানা হলে আমরা নিয়মিত কার্যক্রমে ফিরে যাবো। আমরা সবাই চাই, বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নতি হোক। এখানে যাঁরা আছি, তাঁরা তিন-পাঁচ-দশ বছর খেলবো। কিন্তু আমরা চাই, যাঁরা ভবিষ্যতে ক্রিকেটে আসবে, তাদের জন্য একটা ভালো পরিবেশ রেখে যেতে, যেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নতি হয়।’’
এক নজরে এগারো দফা...
- কোয়াবের বর্তমান কোনো কার্যক্রম না থাকায় বর্তমান কমিটিকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে৷
- প্রিমিয়ার লিগ আগের মত করতে হবে৷ নিজেদের ডিল করতে দিতে হবে৷
- এ বছর না হোক, তবে পরের বছর থেকে আগের মত বিপিএল হতে হবে, লোকালদের দাম বাড়াতে হবে৷
- প্রথম শ্রেণির ম্যাচ ফি এক লাখ, বেতন বাড়াতে হবে, বারো মাস কোচ ফিজিও দিতে হবে, প্রতি বিভাগে প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা করতে হবে৷
- বল ভালো করতে হবে, ডিএ ১৫০০ টাকায় কিছু হয় না, তাই বাড়াতে হবে, ট্রাভেল প্লেন ভাড়া দিতে হবে, হোটেল ভালো হতে হবে৷
- চুক্তিভূক্ত ক্রিকেটারের সংখ্যা ও বেতন বাড়াতে হবে৷
- দেশি সব স্টাফদের বেতন বাড়াতে হবে, কোচ থেকে গ্রাউন্ডস, আম্পার সবার বেতন বাড়াতে হবে৷
- ঘরোয়া ওয়ানডে বাড়াতে হবে, বিপিএলের আগে আরেকটি টিটুয়েন্টি খেলতে চাই৷
- ঘরোয়া ক্যালেন্ডার ফিক্স হতে হবে৷
- বিপিএলের পাওনা টাকা সময়ের মধ্যে দিতে হবে৷
- ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ দুটোর বেশি খেলা যাবে না, এই নিয়ম তুলে দিতে হবে৷ সুযোগ থাকলে সবাই খেলবে৷