বাম ভরাডুবির কারণ সন্ধান
৪ মে ২০২১বিজেপির তাবড় নেতা, অর্থবল, লোকবলের বিরুদ্ধে কেমন ‘একাই একশ’ হয়ে লড়ে গেলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি, সে নিয়ে কথা হচ্ছে অবশ্যই৷ কিন্তু তার থেকেও বেশি কথা হচ্ছে, এতদিন সঙ্ঘ পরিবারের প্রভাবমুক্ত এই রাজ্যে বিজেপির প্রধান বিরোধী দল হয়ে যাওয়া৷ কিন্তু তাকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে আলোচনা, যে এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বামফ্রন্ট বা কংগ্রেসের একজন বিধায়কও থাকবেন না, যারা এর আগে এই রাজ্যে ক্ষমতায় থেকেছে৷
কংগ্রেসের দিক থেকে এবারের বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে একটা গা–ছাড়া ভাব শুরু থেকেই ছিল৷ আব্বাস সিদ্দিকির ইন্ডিয়ান সেকুলার ফন্ট–এর সঙ্গে জোট বেঁধে, বামেদের সঙ্গে নিয়ে সংযুক্ত মোর্চা তৈরির পরও নজরে পড়েছে কংগ্রেসের উদ্যমহীনতা৷ জাতীয় স্তরের কোনো কংগ্রেসি নেতা প্রচারে আসেননি, এমনকি রাজ্যের নেতাদেরও সেভাবে দেখা যায়নি মিটিং-মিছিল করতে৷ জানা গিয়েছিল, সিদ্দিকির আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট নিয়ে কংগ্রেসের উচ্চতম নেতৃত্ব অস্বস্তিতে আছে৷
তুলনায় অনেক বেশি সমালোচিত হচ্ছে বামফ্রন্ট৷ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর, মাত্র ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে যাদের শক্তি শূন্যে গিয়ে ঠেকেছে৷ গত লোকসভা ভোটে বামেদের ভোট কমে ছয় শতাংশে দাঁড়িয়েছিল৷ এবার বিধানসভা ভোটে আরো কিছুটা কমে সেটা ৫.৫ শতাংশ৷ এর জন্য ফের সেই সিদ্দিকির দলের সঙ্গে জোট করার সিদ্ধান্তই সমালোচিত হচ্ছে৷ বলা হচ্ছে, নামে সেকুলার ফ্রন্ট হলেও অতীতে আব্বাস সিদ্দিকি যে ধরনের আপত্তিকর কথাবার্তা বলেছেন, তাকে ধর্ম নিরপেক্ষ বলা যায় না৷ তার সঙ্গে হাত মেলানোটা বাম ভোটাররা ভালোভাবে নেননি৷
নির্বাচনি সংখ্যাতত্ত্ববিদ বিশ্বনাথ চক্রবর্তী জোর দিয়ে বলছেন, এবার বামেদের এবং কংগ্রেসের ভোট নিশ্চিত তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে গেছে৷ তিনি বললেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে এবার ভোটের আগে যে ‘নো বিজেপি’ প্রচার হয়েছিল, এটা তারই ফল৷ বাম, কংগ্রেস, তৃণমূল, সেই সঙ্গে বুদ্ধিজীবীরা, বাম লিবারেলরা এই নো বিজেপি প্রচার চালিয়েছিল৷ তার সুফল পেয়েছে তৃণমূল৷ বাম এবং কংগ্রেসের প্রায় সমান সমান ভোট তৃণমূলের পক্ষে পড়েছে৷’’
সোমবার সংযুক্ত মোর্চার পক্ষে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুও কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন যে, মোর্চা যে ভোট পায়নি, সে ভোট সম্ভবত তৃণমূলের পক্ষেই গেছে৷ প্রাক্তন বিধায়ক, সিপিএম নেতা তন্ময় ভট্টাচার্য বলছেন, হতেই পারে৷ কিন্তু বুথভিত্তিক পরিসংখ্যান হাতে না এলে নির্দিষ্টভাবে তেমন কথা বলা যায় না৷ বামেরা যে ভোট পেয়ে আসছে, তার থেকে কত ভোট কমেছে এবং তৃণমূলের কোথায় কত ভোট বেড়েছে, সেটা মিলিয়ে দেখেই এরকম একটা সিদ্ধান্তে আসা যায়৷
কিন্তু বামপন্থিরা এবারের ভোটে নিজেদের হারানো জমি ফিরে পেতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছে৷ বেশ কয়েকজন নবীন বাম প্রার্থী এবার ভোটে দাঁড়িয়েছেন৷ তারা সারা রাজ্য ঘুরে প্রচার করেছেন৷ সোশাল মিডিয়াতেও তাদের পক্ষে জনসমর্থন দেখা গিয়েছে৷ তা হলে বামেরা শূন্যে গিয়ে পৌঁছল কেন? তন্ময় ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘তরুণ প্রার্থী দিলেই হয় না৷ পার্টির ভাবনায় তারুণ্য থাকতে হয়৷ আমি ১০টা তরুণ প্রার্থী দিলাম, কিন্তু আমরা তারুণ্যকে প্রাধান্য দিলাম না, আমার ভাবনাটা বৃদ্ধ থাকলো, তাহলে সেই তরুণরা যে ভাবনাগুলো মানুষের কাছে নিয়ে যাবে, তার মধ্যে আমার ভাবনাই প্রতিফলিত হবে!’’
তন্ময় ভট্টাচার্যের এই সোজাসাপ্টা কথা পশ্চিমবঙ্গের বাম রাজনীতিতে রীতিমতো আলোড়ন তুলেছে ভোটের পর৷ যেখানে তিনি সাফ বলছেন দলের উচ্চতর নেতৃত্বে বদলের কথা, যেখানে আদ্যিকালের রাজনৈতিক ধারণা নয়, আধুনিক ভাবনা গুরুত্ব পাবে৷ বিতর্ক শুরু হয়েছে৷ হতে পারে, এই বিরোধ থেকেই ভবিষ্যতে নতুন পথে হাঁটতে উৎসাহিত হবেন বাঙালি বামপন্থিরা৷