ভোটের সময় নন্দীগ্রাম নিয়ে মমতার বক্তব্য এবং বিভ্রান্তি
২ এপ্রিল ২০২১নন্দীগ্রামে ভোটের প্রচারে গিয়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিষ্ফোরক মন্তব্যনিয়ে তোলপাড় রাজ্য রাজনীতিতে৷ নির্বাচনে তার প্রতিপক্ষ, একদা বিশ্বস্ত সহযোগী শুভেন্দু অধিকারী এবং তার বাবা শিশির অধিকারী সম্বন্ধে মমতা ব্যানার্জির কটাক্ষ— ‘‘বাপ–ব্যাটা না চাইলে সেদিন নন্দীগ্রামে পুলিশ ঢুকতেই পারতো না!’’ অথবা চটি–পরা যে ‘পুলিশ’ সেদিন গুলি চালিয়েছিল, তারা সবাই অধিকারীদের লোক'- এমন গুরুতর অভিযোগও নেত্রী তুলেছেন৷
সিঙ্গুরের কৃষিজমিতে টাটাদের গাড়ি কারখানা তৈরির বিরোধিতা এবং নন্দীগ্রামের কৃষিজমিতে কেমিক্যাল হাব তৈরির প্রতিরোধ- এই দুই গণবিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েই নিজের পক্ষে জনমত টেনেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী৷ পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন৷ সেই নন্দীগ্রাম আন্দোলন নিয়ে হঠাৎ এরকম মন্তব্যের কারণ কী? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, স্রেফ হতাশা থেকেই৷ শুধু নন্দীগ্রাম আসন নয়, গোটা রাজ্যই হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে, এবারের বিধানসভা ভোটে এই প্রবল আশঙ্কার মুখে দাঁড়িয়ে মমতা ব্যানার্জি বেপরোয়া হয়ে গিয়েছেন৷
কিন্তু সিঙ্গুর–নন্দীগ্রামের সময় বাংলার যে বুদ্ধিজীবীরা আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, নন্দীগ্রামে গিয়ে বাম সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন, রাস্তায় নেমে মিছিল করে ‘পরিবর্তন’ চেয়েছিলেন— তারা কি এখন নিজেদের প্রতারিত ভাবছেন? যে, তৎকালীন বিরোধী নেত্রী সব জেনেশুনেই নন্দীগ্রামের ঘটনা ঘটতে দিয়েছিলেন এবং গণ আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের স্রেফ ব্যবহার করেছিলেন?
নাট্যকর্মী কৌশিক সেন, যিনি ওই পরিবর্তনকামী শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের প্রথম সারিতে ছিলেন, তিনি বললেন, ‘‘না, নিজেদের প্রতারিত মনে করছি না৷ এবং আমার মনে হয়, রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে মমতা ব্যানার্জি এখন মিথ্যে কথা বলছেন৷ কিন্তু সেসময় নন্দীগ্রামের সাধারণ গরিব মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, আমরা তার পক্ষে ছিলাম, কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থনে নয়৷’’ কৌশিকের বক্তব্য, বুদ্ধিজীবীদের সেই আন্দোলনে যারা সরকার বদল হওয়া, বা কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তার থেকে কী সুবিধে পাওয়া যাবে, তার প্রত্যাশী ছিলেন, তারা বরং এখন প্রতারিত বোধ করতে পারেন৷ কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া যারা সেদিন নন্দীগ্রামের মানুষের পাশে ছিলেন, তাদের প্রতারিত বোধ করার কোনো কারণ নেই৷
আর সংখ্যায় কম হলেও যে বুদ্ধিজীবীরা সেদিন বামফ্রন্ট সরকারের পাশে ছিলেন, যারা বলেছিলেন, মিথ্যে প্রচার করছে তৃণমূল, তারা এখন কী ভাবছেন? ‘‘ভিতরে একটা শান্তি অনুভব করছি, যে সত্যিটা অবশেষে সামনে এলো৷ অবশ্য সেই বিশ্বাস শুরু থেকেই ছিল,’’ বললেন চিত্র পরিচালক অনিন্দিতা সর্বাধিকারী, যিনি নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর ঘটনার পর মুভি ক্যামেরা হাতে সত্যিটা খুঁজতে গিয়েছিলেন৷ গিয়ে পাঁচ দিন ছিলেন নন্দীগ্রাম এলাকায়৷ অনিন্দিতার দাবি, শয়ে শয়ে শিশুর দুই পা ধরে চিরে দেওয়ার কথা, মানুষকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা— এ সবেরই প্রমাণ খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন তারা৷ কিন্তু যেখানেই গিয়েছিলেন, সবাই বলেছিল, না আমাদের গ্রামে কোনো শিশু নিখোঁজ হয়নি, ও অন্য জায়গায় ঘটেছে৷ আজ অনিন্দিতার বক্তব্য, ‘‘আমি শুধু নিজের চোখে দেখেছি তা নয়, ক্যামেরাও দেখেছিল সেসময়৷ ক্যামেরা তো মিথ্যে কথা বলতে পারে না৷ তা-ও সেদিন লোককে বিশ্বাস করানো যায়নি, যে ওসব মিথ্যে কথা৷’’ অনিন্দিতা অবশ্য পুলিশের বিষয়টি নিয়ে কিছু বলেননি৷
নন্দীগ্রামের ভোট নিয়ে এখন হাওয়ায় আরেকটা কথা ঘুরছে৷ যে, মমতা ব্যানার্জির ক্ষমতায় উত্থান নন্দীগ্রাম আন্দোলনের কারণে৷ ফের সেই নন্দীগ্রামই তার পতনের কারণ হতে চলেছে৷ এই জল্পনার সারবত্তা প্রমাণ হবে আগামী ২ মে, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোটের ফল ঘোষণার দিন৷