মাস্ক পরাতে আবার ভ্রাম্যমাণ আদালত
১৬ মার্চ ২০২১স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান বলেন, মাস্ক ব্যবহারে এখন ঢিলেঢালা ভাব এসে গেছে৷ অন্যদিকে করোনা সংক্রমণ আবার বেড়েছে৷ এই প্রেক্ষাপটে মাস্ক ব্যবহারে আগের নির্দেশনাগুলোই কঠোরভাবে পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ তিনি জানান, ‘‘আজকেই (মঙ্গলবার) ভ্রাম্যমাণ আদালত নামানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে প্রশাসনকে৷ দেশের সব জেলায়ই ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলবে৷ তারা জরিমানাও করবেন৷’’
ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ভাস্কর দেবনাথ বাপ্পি জানান, মঙ্গলবার থেকেই ভ্রাম্যমাণ আদালত নেমেছে ঢাকায়৷ ঢাকা শহর এবং ঢাকা জেলার পাঁচটি উপজেলায় ১৫ জন ম্যাজিষ্ট্রেট ১৫টি ভ্রাম্যামাণ আদালত পরিচালনা করেছেন৷ তারা ১৬৬ টি মামলা করেছেন৷ ২৬ হাজার ১০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে৷ বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে এক হাজার ২০০৷
জেলা প্রশাসকদের ১১ দফা নির্দেশনা জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে৷ এই নির্দেশনার মধ্যে আছে-
১. সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিসে কর্মরত কর্মকর্তা, কর্মচারী ও অফিসে আসা সেবাগ্রহীতারা বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহার করবেন৷
২. সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালসহ সব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে আসা সেবাগ্রহীতারা আবশ্যিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করবেন৷
৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির ও গির্জাসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে৷
৪. শপিংমল, বিপণি বিতান ও দোকানের ক্রেতা-বিক্রেতারা আবশ্যিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করবেন৷
৫. হাট-বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতারা মাস্ক ব্যবহার করবেন৷ মাস্ক পরা ছাড়া ক্রেতা-বিক্রেতারা কোনো পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করবেন না৷
৬. গণপরিবহনের (সড়ক, নৌ, রেল, আকাশপথ) চালক, চালকের সহকারী ও যাত্রীদের মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে৷
৭. গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিসহ সব শিল্পকারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে৷
৮. হকার, রিকশা ও ভ্যানচালকসহ সকল পথচারীর মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে৷
৯. হোটেল ও রেস্টুরেন্টে কর্মরত ব্যক্তি এবং জনসমাবেশে মাস্ক ব্যবহার আবশ্যিক ৷
১০. সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে৷
১১. বাড়িতে করোনা উপসর্গসহ কোনো রোগী থাকলে পরিবারের সুস্থ সদস্যেরা মাস্ক ব্যবহার করবেন৷
এই নির্দেশগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে৷ আর জেলা প্রশাসকদের সার্বিকভাবে মনিটরিং করতে বলা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য সচিব জানান৷
এর আগে গত নভেম্বরে জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোারেশন এবং বিআরটিএ মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে সড়কে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে৷ মাস্ক ব্যবহার না করলে জরিমানা করা হয় এবং তাদের মধ্যে মাস্ক বিতরণ করা হয়৷ কিন্তু এক মাসের বেশি এই কার্যক্রম চলেনি৷ তখন প্রধানমন্ত্রী নিজে ঘোষণা করেন, ‘‘নো মাস্ক নো সার্ভিস৷’’
কিন্তু ডিসেম্বরের পর থেকে করোনা সংক্রমণ কমে আসায় সরকারের কড়াকড়িও উঠে যায়৷ সাধারণ মানুষও মাস্ক ব্যবহারে অনীহা দেখায়৷ আর সামাজিক দূরত্বের বিষয়টিও উধাও হয়ে যায়৷ এখন গণপরিবহণে যাত্রীরা তেমন মাস্ক পরেন না৷ বাজার হাট বা জনসমাগমস্থলে মানুষ ইচ্ছেমত ভিড় করেন মাস্ক ছাড়াই৷ সভা-সমাবেশেও একই অবস্থা৷ ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্যাহ বলেন, ‘‘করোনার সংক্রমণ কমে আসায় যাত্রীরা এখন আর মাস্ক পরতে চায় না৷ পরিবহণ শ্রমিকদের মধ্যেও অনীহা৷ আমরা মাস্কের কথা বললে তারা বিরক্ত হয়৷’’
তিনি বলেন, আবার গণপরিবহণে মাস্কের ব্যাপারে সরকারের আদেশ মেনে আমরা কঠোর হচ্ছি৷ বিআরটিএ মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ আমরা তাদের সহায়তা করব৷
করোনা সংক্রান্ত জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘করোনা নিয়ে আমরা এখানে এখনো একটা খেলা খেলা ভাব লক্ষ্য করছি৷ এই ভাইরাসটির ভয়াবহতা সম্পর্কে নাগরিকদের আসলে প্রকৃত অর্থে সচেতন করা হয়নি৷ মাস্ক ব্যবহারের নির্দেশনা আগে থেকেই তো আছে৷ তাহলে নতুন করে নির্দেশ লাগবে কেন? লাগছে এই কারণে যে আসলে এটাকে কেউ গুরুত্বের সাথে নেয়নি৷ মোবাইল কোর্ট চালু হলো৷ আবার বন্ধ হয়ে গেল৷ এটা কেন বন্ধ হয়ে গেল তার কোনো জবাবদিহিতা আছে? আর দায়িত্বশীলরা সংবাদ মাধ্যমে এখন মাস্ক ছাড়া কথা বলছেন৷ এটা ভুল বার্তা দেয়৷ একই সঙ্গে আগে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অনেকে বলেছেন, টিকা না আসা পর্যন্ত মাস্ক ব্যবহার করুন৷ টিকা দিলে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে না, এটা তারা কোথায় পেলেন?’’
তিনি জানান, আবার লকডাউনের কথা হচ্ছে৷ এটা কেন করা হবে? এটা নাগরিকদের কষ্ট বাড়ানো ছাড়া আর কিছু করে না৷ দরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা৷ কিন্তু সেটার জন্য কোনো সিরিয়াস উদ্যোগ নাই৷ কোনো মনিটরিং নাই৷ দায় দায়িত্ব নাই৷
করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণ নিয়ে এই ভাইরোলজিস্ট বলেন, ‘‘বাংলাদেশে শীতে অন্যান্য ভাইরাস করোনা ভাইরাসকে শরীরে প্রবেশে বাধা দেয়৷ আর অন্যান্য যে ভাইরাস আছে তার প্রতিরোধ ক্ষমতা আমাদের আছে৷ এখন শীত চলে গেছে করোনার সংক্রমণ তাই বাড়ছে৷’’
আফ্রিকা ও যুক্তরাজ্যের নতুন স্ট্রেইন বাংলাদেশেও পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, সে কারণে করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেছে তার কোনো প্রমাণ নেই৷ কারণ ওই স্ট্রেইন ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে৷ আগের ভাইরাসই এখনো প্রবলভাবে বিস্তৃত হচ্ছে৷ শীতের কারণে সংক্রমণ তেমন হয়নি৷
করোনার ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত আছে৷ মঙ্গলবার গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে করোনায় ২৬ জন মারা গেছেন৷ নতুন করে এক হাজার ৭১৯ জন সংক্রমিত হয়েছেন৷ সোমবারও ২৬ জনের মৃত্যু এবং এক হাজার ৭৭৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন৷ গত ১ মার্চ করোনায় মারা যান আট জন৷ আর আক্রান্ত হন ৫৮৫ জন৷ দুই সপ্তাহে সংক্রমণ বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি আর মৃত্যু তিন গুণের বেশি৷
বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী পাওয়া যায় গত বছরের ১৮ মার্চ৷ এপর্যন্ত পাঁচ লাখ ৬০ হাজার ৮৮৭ করোনা আক্রান্ত সনাক্ত হয়েছে৷ মারা গেছেন আট হাজার ৫৯৭ জন৷ ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে এখানে ব্যাপক ভিত্তিক টিকা দেয়া শুরু হয়৷