1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে করিমগঞ্জের নামবদল

বিশ্বকল্যাণ পুরকায়স্থ শিলচর
২১ নভেম্বর ২০২৪

আসামে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে করিমগঞ্জের নাম পাল্টে শ্রীভূমি রাখা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।

https://p.dw.com/p/4nEuf
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সাংবাদিক সম্মেলন করছেন।
করিমগঞ্জের নাম বদল করে রবীন্দ্রনাথের দেয়া শ্রীভূমি রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা।ছবি: IANS

গত মঙ্গলবার রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, ‘‘একশ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ এই ভুমিকে শ্রীভূমি অর্থাৎ মা-লক্ষ্মীর ভূমি বলেছিলেন। আমরা জনগণের আবেগকে সম্মান জানিয়ে করিমগঞ্জ জেলার নাম শ্রীভূমি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"

সরকারের এই সিদ্ধান্তের পর জেলার বিভিন্ন এলাকায় মঙ্গলবার অনেক রাত পর্যন্ত বাজি ফাটিয়ে উৎসব পালন করেছেন কিছু মানুষ। অনেকে সামাজিক মাধ্যমে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বলেছেন, '‘এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে কোথাও অসমিয়া বনাম বাঙালি আবেগ নেই। এই এলাকার মূল সংস্কৃতিকে সম্মান জানিয়ে আমরা নাম পরিবর্তন করেছি।‘‘

এই কাজটা করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে। করিমগঞ্জ হলো আসামের বাঙালিপ্রধান এলাকা। শিলচর, করিমগঞ্জ গেলে মনে হবে, পশ্চিমবঙ্গের কোনো জায়গায়  চলে এসেছেন। এখানে সিংহভাগ মানুষ বাংলায় কথা বলেন, দোকান-পাটের নামও বাংলায়। সর্বত্র বাঙালি খাবারের রেস্তোরাঁ।  তাই সেখানকার নাম পরিবর্তন গিয়ে রবীন্দ্রনাথের দেয়া নাম রাখা হয়েছে বলে সরকার জানাচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথ এবং করিমগঞ্জ

বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন-সহ আসামের বহু সংগঠন এই বিষয়টিকে সমর্থন জানিয়েছে। বরাক-বঙ্গের করিমগঞ্জ শাখার তরফে সব্যসাচী রায় ডিডাব্লিউকে বলেছেন, '১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ শিলং থেকে সিলেট যাওয়ার পথে করিমগঞ্জে কিছুটা সময় ছিলেন। তিনি পরবর্তীতে এই ভূমিকে শ্রীভূমি বলে উল্লেখ করেছিলেন। ২০১৯ সালে আমরা রবীন্দ্রনাথের করিমগঞ্জ আসার ১০০ বছর উদযাপন করেছিলাম এবং তখন থেকেই নাম পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছি। ১০৫ বছর আগে কবিগুরু যে নাম দিয়েছিলেন এবার সেই নামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে সরকার। এতে আমরা আনন্দিত।'

সব্যসাচী করিমগঞ্জের ইতিহাস নিয়ে বহু বছর ধরে কাজ করছেন এবং তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৭ সালে যখন ভারত স্বাধীন হয়,  করিমগঞ্জ তিন দিনের জন্য পূর্ব-পাকিস্তানের অংশ ছিল। সেই বছর ১৪ অগাস্ট করিমগঞ্জের কিছু কিছু এলাকায় পাকিস্তানের পতাকা তোলা হয়েছিল। পরবর্তীতে ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয় এবং এর পিছনে অন্যতম কারণ ছিল ত্রিপুরার ভারতের অংশ হওয়ার প্রক্রিয়াটি। করিমগঞ্জে প্রথমবারের মত স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল ১৭ আগাস্ট।

স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯ সালে নভেম্বর মাসে শিলং থেকে গুয়াহাটি হয়ে সিলেট যাওয়ার পথে করিমগঞ্জে এসেছিলেন। গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান এবং সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার বিজয়ী গবেষক ঊষারঞ্জন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে জানান, ''করিমগঞ্জ স্টেশনে সেদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল এবং নিয়ম ভেঙে সেদিন ২৮ মিনিট স্টেশনে দাঁড়িয়েছিল ট্রেনটি।''

ভারতের ‘সিলেট’ থেকে

তিনি জানান, ''শিলচরের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কামিনী কুমার চন্দের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের ভালো সম্পর্ক ছিল। করিমগঞ্জ স্টেশনে যেখানে তিন মিনিট থামার কথা ছিল ট্রেনটির, সেটি ২৮ মিনিট থামানোর ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন কামিনী কুমার। করিমগঞ্জের শিক্ষাবিদ ভারত চৌধুরীর উদ্যোগে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এরপর ট্রেনটি চলে যায় কুলাউড়া, যেখানে ফাস্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্টে রাত কাটান কবিগুরু। পরের দিন চলে যান সিলেটে এবং সেখানে তিন দিন থাকার পর আগরতলার যান। তার সঙ্গে ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী।''

উষারঞ্জন জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ সিলেটে বহু অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন এবং তখন হয়তো শ্রীভূমি শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তবে যে কবিতার কথা উল্লেখ করা হচ্ছে, সেটা ১৯৩২ সালের পরে লেখা। কারণ কবিতার নিচে কবিগুরুর যে সই রয়েছে, সেখানে শ্রী বর্জিত। ১৯৩২ সালের আগে রবীন্দ্রনাথ নামের আগে শ্রী ব্যবহার করতেন। তাই তার ধারণা, নির্বাসিতা তুমি সুন্দরী শ্রীভূমি কবিতাটি ১৯৩৫ সালের কাছাকাছি লেখা হয়েছিল এবং তিনি শান্তিনিকেতন বা কলকাতায় এটি লিখেছিলেন। উষারঞ্জন বলেন, 'রবীন্দ্রনাথ যে শ্রীভূমির কথা বলেছেন সেটা শুধুমাত্র সিলেটের একটা অংশ নয় বরং একটা বড় ভূখন্ডকে সম্বোধন করা হয়েছিল।'

করিমগঞ্জ নামের পিছনে

করিমগঞ্জ নামের ইতিহাস নিয়ে বেশ কয়েকটি তথ্য রয়েছে। করিমগঞ্জ কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদের কিছু লেখা অনুযায়ী, ওই এলাকার জমিদার করিম মিঁয়া এবং তার ভাই জকি মিয়াঁর নাম ধরেই সুরমা নদীর দুই ধারের জায়গার নাম করিমগঞ্জ এবং জকিগঞ্জ হয়েছিল। ইতিহাসবিদ তথা লেখক বিবেকানন্দ মহন্ত করিম মিয়াঁর কথা উল্লেখ করে জানান, প্রথমে একটা বাজারের নাম করিমগঞ্জ রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, '১৮৬০ এর কাছাকাছি ওই বাজারের নামকরণ হয়েছিল। ১৮৭৪ সালে বেঙ্গল প্রভিন্সের প্রশাসনিক ইউনিটের অংশ হয় এই এলাকা এবং সিলেটের ১৬টি থানার মধ্যে একটি ছিল করিমগঞ্জ। ১৯৭৮ সালে করিমগঞ্জ স্বাধীন মহাকুমা হয় এবং ওই সময় থেকেই প্রশাসনিক কাজের ক্ষেত্রে একটা বড় অংশের নাম করিমগঞ্জ ছিল। দেশভাগের পর এর কিছুটা অংশ পূর্ব-পাকিস্তানের চলে যায়।'

বিতর্ক হচ্ছে

হঠাৎ করে করিমগঞ্জ জেলার নাম শ্রীভূমি রাখার সিদ্ধান্তকে  অনেকে সমর্থন করেছেন, তবে কেউ কেউ একে নিরর্থক বলেও আখ্যা দিয়েছেন। গৌহাটি হাইকোর্টের আইনজীবী তথা কংগ্রেস দলের সদস্য হাফিজ রশিদ আহমেদ চৌধুরী মনে করেন, ''এটি বিজেপির ধর্মীয় মেরুকরণের আরেক নিদর্শন। তিনি বলেন, 'বিজেপি এই জেলার উন্নতির কাজ করতে পারেনি এবং জনগণের কাছে এব্যাপারে তাদের কোনও উত্তর নেই। অযথা একটা বিষয়কে সামনে এনে হিন্দু বনাম মুসলমান আবেগকে আবার উসকে দেওয়া হচ্ছে।''

বিজেপি-র বিরুদ্ধে এই অভিয়োগ নতুন নয়। এলাহাবাদকে প্রয়াগরাজ করা, মুঘলসরাইয়ের নাম পরির্বর্তন করার মতো একাধিক ক্ষেত্রে এই অবিযোগ উঠেছে। 

সাংবাদিক অরূপ রায় জানান, ''এই নাম পরিবর্তনের দাবি বহু পুরনো। তার মতে, শ্রীভূমি নামের সঙ্গে কোনও ধর্মীয় আবেগ নেই। এই নামের বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে জেলায় এবং অনেকেই নিজেদের শ্রীভূমির বাসিন্দা বলতে পছন্দ করেন। তাই সরকারের এই সিদ্ধান্তকে বেশিরভাগ লোকেরাই সমর্থন করছেন।''

তবে তরুণ প্রজন্মের কিছু মনে করেন করিমগঞ্জ নামের সঙ্গে একটা ধর্মীয় আগ্রাসনের ইতিহাস জড়িয়ে ছিল। জেলার পাতারকান্দি এলাকার যুবক পৃথ্বীশ দাস বলেন, ''সিলেটের নাম শ্রীহট্ট করেছিল মোগল শাসন। মা ঢাকেশ্বরীর কাহিনী অবলম্বনে প্রথমে এই এলাকার নাম ছিল শ্রীহস্ত, অর্থাৎ ঈশ্বরীর হাত। মোগল শাসকরা সেটা পাল্টে দিয়েছিল। করিমগঞ্জের নামও এভাবেই রাখা হয়েছিল। এবার আমরা সেই নাম থেকে মুক্তি পেয়েছি।''

এই বিতর্কের মধ্যে একাধিক মানুষ বলছেন, এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকে সামনে রাখাটা হিমন্তের একটা বড় কৌশল। কারণ, রবীন্দ্রনাথকে সামনে রাখলে বাঙালি নাম পররিবর্তনের বিশেষ প্রতিবাদ করবে না।