রেটিং এজেন্সিগুলিকে বশে আনতে ইউরোপের উদ্যোগ
২০ নভেম্বর ২০১১রেটিং এজেন্সিগুলির ভূমিকা
কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের আর্থিক অবস্থার উপর নির্ভর করে, সে কত ঋণ নিতে পারে, সেই ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতাই বা কতটা৷ এক ঋণ শোধ করতে আরেক ঋণ নিতে হচ্ছে কি না, বেড়ে চলা ঋণের ভারে সে ক্রমশঃ আরও অসহায় হয়ে পড়ছে কি না, সেদিকেও নজর রাখতে হয়৷ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঋণের ভার সামলাতে না পারলে হয় বাইরে থেকে সাহায্য আসে, অথবা সে দেউলিয়া হয়ে পড়ে৷ বিষয়টির সেখানেই ইতি ঘটে৷ কিন্তু রাষ্ট্র কোনো দোকান নয়, যা দেউলিয়া হয়ে ঝাঁপ বন্ধ করে দিতে পারে৷
গোটা বিশ্বে রাষ্ট্রের আর্থিক কার্যকলাপের দিকে নজর রাখে তিন প্রবল পরাক্রমশালী রেটিং এজেন্সি৷ তিনটিই বেসরকারি, তিনটিরই সদর দপ্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে৷ ফলে তারা কতটা নিরপেক্ষতার সঙ্গে কোনো রাষ্ট্রের মূল্যায়ন করে, তা নিয়ে বার বার প্রশ্ন তোলা হয়৷ কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, তাদের মূল্যায়নের ভিত্তিতেই কোনো রাষ্ট্রের ‘ক্রেডিট রেটিং' স্থির করা হয়৷ অর্থাৎ বেশি পয়েন্ট পেলে কম সুদে ঋণ পাওয়া যায়, পয়েন্ট কমে গেলে চড়া সুদ গুনতে হয়৷
তিন প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া আধিপত্য
‘স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুয়র' তিন রেটিং এজেন্সির মধ্যে অন্যতম৷ কয়েক দিন আগে তারা ভুল করে কিছুক্ষণের জন্য ফ্রান্স'এর ক্রেডিট রেটিং কমিয়ে দিয়েছিল৷ ব্যস, তাদের সেই ভুল হাতেনাতে ধরে ফেলে চারিদিকে উঠলো সমালোচনার ঝড়৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক রাজনৈতিক নেতাই বেশ কিছুকাল ধরেই রেটিং এজেন্সিগুলির তৎপরতার সমালোচনা করে আসছিলেন৷ তাদের কার্যকলাপের উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে চলছিল নানা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগও৷
এবার ইইউ কমিশন এই উদ্দেশ্যে এক আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছে৷ ইউরোপীয় পার্লামেন্টে জার্মানির খ্রীস্টীয় গণতন্ত্রী শিবিরের সাংসদ মার্কুস ফ্যার্বার এবিষয়ে বললেন, ‘‘রেটিং এজেন্সি'গুলি কীভাবে ইচ্ছা করে কিছু দেশের ঋণ সংকটকে উসকে দিয়ে তাদের ইউরো এলাকার সাহায্য কর্মসূচির আওতায় আসতে বাধ্য করেছে, সেটা আমরা দেখেছি৷ আয়ারল্যান্ড ও পর্তুগালের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছিল৷ আর এখন ইটালির ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে যে বাজারের বিশ্লেষকরা নয় – সেই রেটিং এজেন্সি'গুলিই সেদেশের উপর চাপ সৃষ্টি করছে৷''
স্বচ্ছতা আনার স্পষ্ট পরিকল্পনা
ফ্যার্বার এপ্রসঙ্গে ইইউ'র অভ্যন্তরীণ বাজার সংক্রান্ত কমিশনর মিশেল বার্নিয়ে'র সংস্কারের পদক্ষেপকে স্বাগত জানান৷ বার্নিয়ে অবশ্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন, যে কোনো আদর্শগত অবস্থান থেকে নয়, বাস্তব পরিস্থিতির আলোকেই তিনি বিষয়টিকে বিবেচনা করছেন৷ তাঁর মতে, খারাপ খবর আনে যে দূত, তাকে খুন করে কোনো লাভ হয় না৷ সবার একটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত, আর সেটা হলো কোনো দেশের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে উচ্চ মানের, স্বচ্ছ ও প্রয়োজনীয় মূল্যায়ন পাওয়া৷
বার্নিয়ে চাইছেন, রেটিং এজেন্সিগুলির কাজকর্মে আরও স্বচ্ছতা আনা হোক৷ তারা কীভাবে কাজ করে, কীভাবেই বা কোনো দেশের অবস্থা সম্পর্কে তারা কোনো সিদ্ধান্তে আসে, তা খুলে বলা হোক৷ তাছাড়া শুধু অ্যামেরিকা ভিত্তিক তিনটি বেসরকারি সংস্থা তাদের আধিপত্য চালিয়ে যাবে, সেটাও মেনে নেওয়া যায় না৷ তাঁর দাবি, শুধু রাষ্ট্র নয় – ব্যাংকগুলির অবস্থারও নিয়মিত মূল্যায়ন করা হোক, বাজারে তাদের রেটিং ঠিক করে দেওয়া হোক৷ তাছাড়া অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের রেটিং এজেন্সিগুলিকে আরও শক্তিশালী করা উচিত৷
শুধু তাই নয়, ইইউ'র অভ্যন্তরীণ বাজার সংক্রান্ত কমিশনর আরও একধাপ এগিয়ে গোটা প্রক্রিয়ার মধ্যেও গতি আনতে চান, যাতে স্থায়ী নির্ভরতা সৃষ্টি না হয়৷ এর আওতায় কোনো এজেন্সি একটি দেশের বন্ড বা একটি সংস্থার শেয়ার বড়জোর ৩ বছর একটানা মূল্যায়ন করার অধিকার পাবে৷ তারপর অন্য কোনো এজেন্সির হাতে সেই দায়িত্ব তুলে দিতে হবে৷ এমন ‘রোটেশান' ব্যবস্থার ফলেও গোটা কাঠামোয় স্বচ্ছতা আনা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন৷
রেটিং এজেন্সিগুলির বিশাল ক্ষমতা
রেটিং বা মূল্যায়নের ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় বিপদ হলো একটি মাত্র ভুলের মারাত্মক পরিণতি হতে পারে৷ শেয়ারের মূল্য হু হু করে পড়ে যেতে পারে, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র জোরালো সংকটের মুখে পড়তে পারে৷ তাই ইউরোপীয় কমিশন চায়, এমন ভুল করলে রেটিং এজেন্সিগুলিকে তার দায়দায়িত্বও কাঁধে নিতে হবে৷ এমনকি মিশেল বার্নিয়ে চাইছিলেন, যে কোনো আর্থিক সংকট মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছলে সেসময়ে রেটিং বা মূল্যায়নের ফলাফল প্রকাশ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক৷ এত ব়্যাডিক্যাল প্রস্তাবের পক্ষে অবশ্য সমর্থন জোগাড় করা কঠিন৷ কারণ জোর খাটিয়ে বাজারের কাছে কোনো তথ্য গোপন করলেই সন্দেহ দেখা দেবে, যার ফল আরও মারাত্মক হতে পারে৷ তখন ফাটকাবাজি আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের অনেক সদস্য৷
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাংসদরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার পর ইউরোপের ক্ষমতার অন্য দুই কেন্দ্র – অর্থাৎ কমিশন ও মন্ত্রী পরিষদকেও বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে৷ তারপর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তের অপেক্ষা৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক