লেবাননি সঙ্গীতের নবযৌবন ‘মাশরু-থ্রি লায়লা’
১২ মার্চ ২০১০দেশের মাটিতে বেড়ে ওঠা এই তরুণ সঙ্গীতপ্রতিভাধরেরা আরব তারুণ্যের কণ্ঠস্বরকে ধারণ করে লেবাননের সঙ্গীতাঙ্গনে সূচনা করেছে এক নবযৌবনের৷
লেবাননি সঙ্গীত ধারার রয়েছে দীর্ঘ গৌরবময় ইতিহাস৷ লেবাননের রাজধানী বৈরুতের অনেক আগে থেকেই এজন্য খ্যাতি থাকলেও বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরের সময়টাতে সঙ্গীত, শিল্পকলা এবং বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয় এই নগরী৷ কিন্তু ১৫ বছরব্যাপী গৃহযুদ্ধের সময়ে অনেক খ্যাতনামা জ্ঞানীগুণির সঙ্গে কায়রো কিংবা প্যারিসে পাড়ি জমান বৈরুতের সঙ্গীত তারকারাও৷ ১৯৯২ সালের দিকে পাশ্চাত্য ধারার সঙ্গীদ জনপ্রিয় হতে শুরু করলে সেখানে একটি নতুন ধারা বিকাশের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়৷ কিন্তু, একেবারেই নিজস্বতা নিয়ে দেশের মাটি আর দেশের তারুণ্যকে ধারণ করতে পারে এমন সাফল্য সাম্প্রতিক সময়ে ‘মাশরু-থ্রি লায়লা' ছাড়া আর কেউই দেখাতে পারেনি৷
২০০৮ সালে বৈরুতের অ্যামেরিকান ইউনিভার্সিটির একটি ‘মিউজিক ওয়ার্কশপ' থেকে জন্ম নেয় ‘মাশরু-থ্রি লায়লা'৷ স্থাপত্য আর ডিজাইন বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের সবার জন্য ওই ওয়ার্কশপ উন্মুক্ত ছিল৷ শব্দ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং নানা বিচিত্র শব্দকে শ্রবণযোগ্য করে তোলায় মত্ত ছিল এখানকার তরুণেরা৷ এখানেই জোট বেঁধে ‘মাশরু-থ্রি লায়লা' দল গঠন করে হাইগ পাপাজিয়ান, কার্ল গার্জেস, হামেদ সিন্নো, ওমাইয়া মালিব, আন্দ্রে শেদিদ, ফিরাস আবু ফাখের এবং ইব্রাহিম বদর৷
গৃহযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক বিভাজন এবং সহিংসতায় অস্থিতিশীল সমাজে তারুণ্যের কণ্ঠস্বর তুলে ধরতেই ব্যন্ড গঠন করেছিল করেছিল এই তরুণেরা৷ ‘মাশরু-থ্রি লায়লা' ব্যান্ডের ভায়োলিন বাদক হাইগ পাপাজিয়ান বলেন, ‘‘২০০৫ সালের পর যখন আমরা মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করলাম, বলা যেতে পারে আমাদের মধ্যে এক ধরণের উপলব্ধি হল যে আমাদের রাষ্ট্রে কোথায় যেন একটা গোলমাল আছে, কিছু একটা ভুল হচ্ছে৷ আমি জানি না, চারদিকে যতো নিরাপত্তা কড়াকড়ি, সেনা টহল আর একের পর এক ঘটতে থাকা সব বোমা হামলায় সব চেনা জায়গাগুলোকেও অন্যরকম মনে হতে লাগলো৷''
পাপাজিয়ান আরও বলেন, ‘‘অনেক মানুষই একসময় রাজনীতির সঙ্গে খুবই ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল, রাজনীতির প্রশ্নে তাদের মধ্যে একটা প্রবল আবেগ লক্ষ্য করা যেত৷ কিন্তু আপনি জানেন যে, বিষয়টা এখন আর তেমন নেই৷''
এক সময়ের সঙ্গীত-শিল্পকলার তীর্থ বৈরুতে সমাজ জীবন দিন দিন ভিন্ন ধারায় পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিল৷ আর নাগরিকদের প্রতিদিনের আটপৌরে জীবনেও এসে লাগছিল সহিংস রাজনীতির উত্তাপ৷
‘মাশরু-থ্রি লায়লা' ব্যান্ডের কিবোর্ড বাদক ওমাইয়া মালিব বলেন, ‘‘আমাদের প্রাত্যহিক জীবনই যেন বদলে গেল৷ হঠাৎ করেই অনেক জায়গায় আমাদের যাতায়াত রুদ্ধ হয়ে গেল৷ স্থপতি হিসেবে আমাদের অনেক প্রকল্প এলাকায় জরিপ চালাতে হয়, সেখানকার ছবি তুলতে হয়, কিন্তু বহুবারই আমাদের আটকে দেওয়া হয়েছে, আমাদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছে তোমরা এখানে কি করছো, অনেকবার আমাদের ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আমাদের ছবি মুছে ফেলা হয়েছে এবং বহুবারই আমাদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছে৷ আমাদের প্রত্যেকেরই এমন অভিজ্ঞতার গল্প আছে৷ এমনকি সাধারণভাবে রাস্তাঘাটে চলাফেরাটাও সমস্যা হয়ে গেল৷ আমরা জানি পাবলিক প্লেসে চলাফেরাটা আইনগতভাবে জনগণের মৌলিক অধিকার৷ কিন্তু সেটাও যেন আর থাকলো না৷''
ওমাইয়া মালিব আরও বলেন, ‘‘আমরা এই গানটা বানাই ২০০৮ সালে৷ যখন আকস্মিকভাবেই ১০ দিনের এক সংঘাতে অবরুদ্ধ হয়ে যায় লেবানন৷ বিষয়টি এমন ছিল যে আবার যেন একটা গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল৷ লেবাননের সবাই ছুটছিল, রাস্তায় রাস্তায় চেকপোস্ট, একজন বলছে, ও তুমি এদিক দিয়ে যেও না, আরেকজন বলছে ওই গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাও, তো আরেকজন বলছে তুমি এদিক দিয়ে পার হতে পারবে না৷ এটা ছিল একটা ছোটখাটো গৃহযুদ্ধ এবং বিনা কারণে বহু মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল৷''
হাইগ পাপাজিয়ান বলেন, ‘‘আমরা গৃহযুদ্ধের সময় জন্মাইনি তাই ঠিকমতো জানি না আসলে তখন কি হয়েছিল৷ আমরা সেই সময়ের মানুষদের কাছে তখনকার কথা শুনেছি, কিন্তু একেক জনের ভাষ্য একেক রকম৷ এসব নিয়ে অনেক দ্বন্দ্ব আছে৷ কিন্তু ২০০৫ সালের পর আমরা নিজেরাই যেন গৃহযুদ্ধের সময়ে জীবনযাপন করতে শুরু করলাম৷ আমাদের কাছে মনে হচ্ছিল আমরা যেন আমাদের আগের প্রজন্মের কাছ থেকে শোনা অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি৷ গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যেন একই সমস্যা চলছে৷ ওই একই সব নাম আর পক্ষ-বিপক্ষ৷ লেবাননে যেন ইতিহাস পুনরআবর্তিত হচ্ছে৷''
লেবাননের এই সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যেই তরুণদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ আর তাদের স্বপ্নকে কথা সুরে ধারণ করার চেষ্টা করে ‘মাশরু-থ্রি লায়লা'৷ দ্রুততম সময়ের মধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে তাদের খ্যাতি৷ ২০০৮ সালের ‘মিউজিক ওয়ার্কশপ' থেকে শুরু করে প্রথম বছরেই স্টেজ শো শুরু এই ব্যান্ডের৷ পরের বছরই অর্থাৎ ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ করে তারা৷ অ্যালবামের নাম ব্যান্ডের নামেই, ‘মাশরু-থ্রি লায়লা'৷ ৯টি গানের এই অ্যালবাম প্রকাশ উপলক্ষ্যে বড়সড় স্টেজ শো আয়োজন করা হয়৷ তবে তা কোনো প্রথাগত কনসার্ট হলে নয় বেইরুতের একটি বিশাল ইস্পাত কারখানার উন্মুক্ত পরিসরে৷
অ্যালবাম প্রকাশের সময় এই দলের সাত সদস্য নিজেদের মধ্য বাজি ধরেছিলেন কতো কপি ডিভিডি বিক্রি হবে তা নিয়ে৷ সবচেয়ে আশাবাদী ছিলেন কিবোর্ড বাদক মালিব৷ তিনি আশা করেছিলেন বিক্রি হবে ৮০০ কপি৷ কিন্তু প্রকাশনার শোতেই এক ঘণ্টার মধ্যে অ্যালবাম বিক্রি হয়েছিল ১,০০০ কপি৷ বহু ভক্তই খালি হাতে ফিরে যান ‘মাশরু-থ্রি লায়লা' কিনতে না পেরে৷ অর্থাৎ প্রথম প্রকাশনার সব কপিই শেষ হয়ে গিয়েছিল ওই শোতেই৷
কারা ‘মাশরু-থ্রি লায়লা'র গান শুনছে এমন প্রশ্নের জবাবে ভায়োলিন বাদক হাইগ পাপাজিয়ান বলেন, ‘‘ব্যক্তিগতভাবে আমি জানি না তারা কোন রাজনৈতিক দলের অনুসারী৷ অথবা তারা আদতে কোনো রাজনৈতিক দলেরই সমর্থক কি না৷ কিন্তু এতে আমার খুব বেশি কিছু আসে যায় না৷ অনেক তরুণ-তরুণীই আছে যারা পরিবর্তন চায়৷ কিন্তু, আমি মনে করি যতোদিন এই শাসকরা ক্ষমতায় থাকবে এবং সবকিছুর ওপরে তারা নিজেদের কর্তৃত্ব চাপিয়ে দিতে থাকবে, ততোদিন পর্যন্ত এই পরিবর্তন সম্ভব হবে না৷''
প্রতিবেদন : মুনীর উদ্দিন আহমেদ
সম্পাদনা : দেবারতি গুহ