সম্প্রীতির নন্দীগ্রামে এখন মেরুকরণই বাস্তব
২৯ মার্চ ২০২১নন্দীগ্রামের সেই জায়গাগুলি একই আছে। সামসাবাদ, তেখালির মোড়, গড় চক্রবেড়িয়াকে বাইরে থেকে দেখলে কিছুই বোঝা যাবে না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে বয়ে যাচ্ছে অন্য এক স্রোত। বিভাজনের স্রোত। যে নন্দীগ্রামে জমিদখলের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম একজোট হয়ে লড়াই করেছিল, সেখানে আজ বিভাজন বড়ই স্পষ্ট। বাস্তব হলো, সামসাবাদের মুসলিম অভিযোগ করছে, হিন্দুরা এখানে বিজেপি-কে ধরে নিয়ে এসেছে। আর গড় চক্রবেড়িয়ার হিন্দুর অভিযোগ, তৃণমূলের স্থানীয় মুসলিম নেতারা এখানে দাদাগিরি করছে। আর এই বিভাজনই পশ্চিমবঙ্গের এবারের বিধানসভা ভোটে সব চেয়ে চিত্তাকর্ষক লড়াইকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
তাই নন্দীগ্রামে একই সঙ্গে দুইটি লড়াই হচ্ছে। একটা লড়াই ভোটের, যেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে লড়ছেন একদা তারই লেফটন্যান্ট শুভেন্দু অধিকারী। গত দশ বছর এই শুভেন্দুর হাতেই তো নন্দীগ্রামের দায়িত্ব তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে ছিলেন মমতা। দ্বিতীয় লড়াইটা হিন্দু বনাম মুসলিমের। গত দুই-এক বছরে যে লড়াই ঘিরে সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে নন্দীগ্রামে।
দুই পক্ষের নেতারাই এই বিভাজনের কথা মেনে নিচ্ছেন, কিন্তু প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করছেন না। স্থানীয় মানুষের কাছে এই মেরুকরণ ঘোর বাস্তব। আর এটাও ঘটনা, এই মেরুকরণের জন্যই মমতা বনাম শুভেন্দু লড়াইটা অন্য মাত্রা পেয়েছে। তার প্রাক্তন সহকর্মী এবং বিজেপি-কে চ্যালেঞ্জ জানাতে মমতা নন্দীগ্রাম থেকে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এটা তার কাছে একেবারেই কেকওয়াক নয়। বরং রীতিমতো কঠিন ঠাঁই। সে জন্যই নন্দীগ্রামে মমতাকে ভালোরকম প্রচার করতে হচ্ছে। সোমবারও দিনভর তিনি নন্দীগ্রামে রোড শো, জনসভা সবই করেছেন।
আর এজন্যই নন্দীগ্রামে মনোনয়নপত্র পেশ করার আগে ও পরে মমতা হিন্দু তাসও খেলেছেন। চণ্ডী পাঠ করেছেন। প্রচুর স্তোত্র বলেছেন। একগুচ্ছ মন্দির দর্শন করেছেন। মমতার পায়ে যে চোট লেগেছে, তাকে যে পায়ে প্লাস্টার লাগিয়ে, হুইল চেয়ারে বসে প্রচার করতে হচ্ছে, সেই দুর্ঘটনাও ঘটেছিল, নন্দীগ্রামে মন্দির দর্শনপর্বেই। ক্ষুব্ধ হিন্দু ভোটকে নিজের কাছে আনার জন্য চেষ্টার কসুর করছেন না মমতা।
অন্যদিকে শুভেন্দুও বসে নেই। তিনি নিয়ে এসেছিলেন যোগী আদিত্যনাথকে। শুভেন্দু জানেন, এর ফলে মেরুকরণ বাড়তে পারে। আর তাতে তিনিই লাভবান হবেন। অমিত শাহও নন্দীগ্রামে জনসভা করে গেছেন। ফলে দুই পক্ষই এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই নিজেদের জয়ের জন্য ঘুঁটি সাজাচ্ছেন।
নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় যেখানে গুলি চলেছিল, সেই ভাঙাবেড়া সেতুর পাশে দাঁড়িয়ে অধিকারী পাড়ার স্বপন অধিকারী ডিডাব্লিউকে বললেন, ''কে বাইরে তৃণমূল ও ভিতরে বিজেপি এবং কে বাইরে বিজেপি, ভিতরে তৃণমূল তা বোঝা দায়। হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণ এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে, ভোটের ফল কী হবে তা বলা মুশকিল।''
নন্দীগ্রামে ৩০ শতাংশ মুসলিম আছেন। তৃণমূলের বড় ভরসা তারাই। সেই সঙ্গে মমতা অন্তত ২০ শতাংশ হিন্দু ভোট পেতে চাইছেন। সেই কৌশল নিয়েই তিনি এগোচ্ছেন। অন্যদিকে শুভেন্দুর পুরো আশাই টিকে আছে ওই বিভাজনের উপর।
মমতা শুক্রবারও নন্দীগ্রামে বলেছেন, ''আমি তো বাংলার যে কোনও জায়গা থেকে দাঁড়াতে পারতাম। কিন্তু আমি নন্দীগ্রামে এলাম, কারণ এটি আন্দোলনের ভূমি। আমি আন্দোলনকে, লড়াইকে স্যালুট করতে চাই। এটা আমার প্রিয় ও পবিত্র জায়গা।'' একদিন আগেই মমতা নাম না করে বলেছিলেন, শিশির অধিকারী ও শুভেন্দু অধিকারীই ছিলেন নন্দীগ্রামে গুলিচালনার ঘটনার নেপথ্যে। মমতার এই কথা থেকেই প্রমাণ, শুভেন্দু লড়াইয়ে আছেন। ভালো করেই আছেন। তাই এই রকম আক্রমণ করতে হচ্ছে তাকে।
শুভেন্দুও বলছেন, তিনি নন্দীগ্রামের মাটিতে মমতাকে হারাবেনই।
দশ বছর আগে এই নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুর বামেদের ৩৪ বছরের শাসন শেষ করে মমতাকে ক্ষমতায় আনার পিছনে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। দশ বছর পরে এসে এই নন্দীগ্রামই আবার বিধানসভা ভোটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে চলেছে। নন্দীগ্রামের লড়াই যেমন চিত্তাকর্ষক, তেমনই জোরদার।