সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় জনৈক তৌফিক নামক এক ছেলের ২৩ লাখ টাকা দামের কোরাবানির ছাগলের ছবি৷ ছবির সূত্র ধরে অনুসন্ধান চলে ছবিটি কার,কী তার অর্থের উৎস, যা দিয়ে এই দেশে কোরবানির জন্য ২৩ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কেনা যায়! সন্ধান মিলে ছেলেটি এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তা মতিউর এর পুত্র৷
জনতা জনার্দনের আগ্রহ উৎসাহ তো বাঁধভাঙা স্রোতের মতো, যেখানে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন বঞ্চিত৷ মুষ্টিমেয়র করায়ত্ত সম্পদের ঝাঁঝ দূর থেকে দেখে সহ্য করে যাওয়াই যাদের নিরুপায় আক্ষেপ৷ তারা যখন বাগে পায়, তখন এই ঝাঁঝ উত্তাপের অসহনীয় আঁচ থেকে কিছুটা স্বস্তির আশায় এর শিকড় বাকড় খুঁজে বের করে৷ নিজ দায়িত্বেই করে৷ এবার একে একে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ থেকে বের হতে লাগলো তার ক্যানাডায় বসবাসরত কন্যা আর কন্যার রাজপ্রাসাদ৷ ইতিউতি নয়ছয় করে ফেলে রাখা হাজার কোটি টাকা৷ একাধিক বিয়ে, ঔরস অস্বীকার! কী নয়? একটা থ্রিলিং আখ্যানের প্রায় সব উপাদান৷ সততার নিখুঁত মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল চেহারা উন্মোচিত হয়ে পড়ার ঘটনা অবশ্য কালেভদ্রে ঘটে৷ আর যদিও এই দুয়েকজন দুয়েকটা ছাগলের ম্যা ম্যা ফাঁক গলে বিশাল উপাখ্যান উলঙ্গ হয়ে পড়ে, বেশিরভাগ রাঘব বোয়ালেরাই থাকে অধরা৷ সিস্টেমের কোথাও কোন চাপ পড়ে না, জনতা জনার্দনের ভাগ্যও বিশেষ বদলায় না৷
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে প্রায় সব তথ্য উন্মুক্ত ও সর্বজনীন হয়ে উঠলে উন্মোচনের সম্ভাবনাটি খুব সহজ হয়ে উঠে৷ প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে স্বল্পজ্ঞান, বৃহৎ জ্ঞান,বিশেষজ্ঞ মোটামুটি সবাই সবার মতামত প্রকাশ করার একটি ক্ষেত্র পেয়ে যায়, তা সে মত ন্যায্য হোক কিংবা অন্যায্য, যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক৷ ফলত ‘ফেসবুক ইস্যুর’ আয়ু বড়জোর ২৪ ঘণ্টা৷ এই ফেসবুক গুজব ছড়িয়ে যতো সহজে হাঙ্গামা বাধাতে পারে, গণসচেতনতা তৈরি করে বৃহৎ কোনো অর্জনে এখনো পর্যন্ত তেমন কোনো ফলপ্রসূ কার্যকরিতা দেখা যায়নি৷ যেহেতু সেন্সরহীন এই মাধ্যমে যার যা খুশি বলতে পারে, সেহেতু এর উপর পরিপূর্ণ ভরসা রাখা কিংবা শতভাগ গ্রহণযোগ্য হিসাবে মেনে নেয়া কঠিন৷
এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উন্মুক্ত হওয়ার আগে মানুষ তবে অন্যায়ের মুখোশ উন্মোচনের জন্য কীসের উপর ভরসা রাখতো? সংবাদপত্রের উপর৷ সংবাদপত্রকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ৷ আইন, বিচার ও শাসন এই তিন গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের পর সংবাদ মাধ্যম একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম৷ সম্পাদক, সম্পাদকীয় নীতি, সাংবাদিক সব মিলিয়ে একটি পরিপূর্ণ প্রস্তুতি৷ সমাজের এবং রাষ্ট্রের অসঙ্গতি তুলে ধরা৷ দুর্নীতি, অন্যায়,অবিচারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী হওয়া৷ এমন সময় এদেশে খুব কাছাকাছি সময়েও ছিলো যে সাংবাদিকদের ভয়ে ভীত থাকতো দুর্নীতিবাজ, অন্যায়কারীরা৷
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে সামরিক জান্তার শাসন পর্যন্ত এদেশে জনসচেতনতা তৈরি সহ সকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে সংবাদপত্র৷ তখনো ইলেকট্রনিক মিডিয়া যাত্রা শুরু করেনি৷ সাংবাদিক মানে তখনো আদর্শের পরকাষ্ঠা৷ সাংবাদিক মানে অন্যায়কারী, দুর্নীতিবাজদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক৷ সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে, রাজাকার বিরোধী জনমত তৈরিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সংবাদপত্র তথা সাংবাদিকেরা৷
সম্প্রতি মতিউরের স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চেয়ারম্যান লায়লা ছাগলকাণ্ডের সূত্র ধরে মন্তব্য করেছেন, তিনি সাংবাদিকদের কিনে এসেছেন৷ কাজেই সব চাপা পড়ে যাবে৷
সব চাপা পড়বে বটেই৷ নইলে লোম বাছতে কম্বল উজাড় হয়ে পড়বে৷ এই সিস্টেম চক্রব্যূহর মতোই দুর্ভেদ্য৷ কিন্তু এই যে সাংবাদিক কেনা! শোনেই সবাই যেনো চমকে উঠলেন,নাকি চমকে উঠার ভান করলেন৷ স্পর্শকাতর বিষয়, যাদের ক্ষেপালে আপনার ভয় আছে৷ মান সম্মান হারানোর,যে কোনো বিপদে পড়ার আশঙ্কা আছে৷ তারা চাইলেই যাকে তাকে বিপদে ফেলতে পারেন৷ কিন্তু যাকে বিপদে ফালানোর কথা তার কেনা গোলাম হয়ে থাকেন৷ এ নিয়ে মুখ খোলাও মুশকিল৷
নইলে গত দুই দশক আগেও কেমন ছিলো সাংবাদিকদের জীবন যাপন? সত্যিকার অর্থেই আদর্শিক প্রণোদনায় কাজ করতেন তারা৷ কাজ করতেন জাতির বিবেকের৷ অন্যায়,অবিচার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলো তাদের কলম৷ নিপীড়িত মানুষ সাংবাদিকদের ভাবতেন আশ্রয়৷ দুর্নীতিবাজেরা সাংবাদিকদের ভয় পেতেন৷ আর কোনো অনিয়ম,অন্যায়ের খবর পত্রিকার পাতায় ছাপা হওয়া মানে এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করা প্রায় সমার্থক৷
দুই দশকে সাংবাদিকদের জীবন মানের দৃশ্যমান উত্তরণ ঘটেছে বহুগুণে৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় এর সবটুকুই তাদের সৎ রোজগারে নয়৷ একটা সিস্টেম যখন শেকড় থেকে পচে যায়, তখন সেই পচন থেকে ডাল-পাতা কিছুই বাঁচানো যায় না৷
সাংবাদিকেরা, এদেশে এরা গোড়া পচনের সংক্রমণে সংক্রামিত হয়েছে৷ ফলে নিপীড়িত, নির্যাতিতদের পক্ষে এরা আর কথা বলেন না৷ এরা ক্ষমতাবান,বিত্তবানদের ধ্বজা ধরেন৷ ক্ষমতা আর বিত্ত আবার পরস্পর সম্পর্কযুক্ত৷
প্রথম,দ্বিতীয়, তৃতীয় স্তম্ভ সব যখন ক্ষমতাবানদের করায়ত্ত হয়,বাকি থাকে চতুর্থ স্তম্ভ, তাও যখন পথভ্রষ্ট সত্যিকার অর্থে এই জনপদে অসহায়ের জন্য কেউ আর নেই৷
এদেশে সবাইকে কেনা যায়৷ রাষ্ট্রীয় অর্থের নয়ছয় এমনই লাগামহীন যে এর হিসাব রাখা যায় না৷ এ যে কখন কাকে কীভাবে কিনে টেরই পাওয়া যায় না৷ টাকার বিনিময়ে সব সেক্টর এখানে সহজলভ্য৷
বিলাস ব্যসনের হাতছানিতে সাংবাদিকেরা পিছিয়ে থাকবেন কেন? চারদিকে অবৈধ অর্থের ঝনঝনানিতে বিত্ত বৈভব অগ্রাহ্য করে সততার পরীক্ষা দেয়ার মতো আদর্শিক অবস্থান রক্ষা করা মানব সন্তানের পক্ষে বড়োই কঠিন৷ সাংবাদিকেরা শুধুমাত্র এই ব্যবস্থা ব্যবচ্ছেদের বিবেক হওয়ার বদলে উপজাত হয়ে উঠেছে৷
মফস্বলে দেখেছি সাংবাদিক নামধারী কিছু লোকের চাঁদাবাজি, নিউজ করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায়৷ মান সম্মান রক্ষার্থে কিংবা আত্মরক্ষার তাগিদে মানুষ বাধ্য হয়েই দেয় এবং এই টাকাই তাদের একমাত্র আয়ের উৎস৷ এই সাংবাদিক নামধারীদের চাঁদাবাজি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধানী রিপোর্ট হতে পারে৷ নিরীহ জনতা ভয়ে যাদের নাম দিয়েছে ‘সাংঘাতিক’৷ কিন্তু কে রিপোর্ট করবে? আনভীর সোবহানের টাকায় বুর্জ খলিফায় আতিথ্য নেয়া সাংবাদিকেরা, তার হাত থেকে পুরস্কার নেয়া সাংবাদিকেরা৷ না নষ্ট সমাজে তাদের দোষ দিয়ে কী লাভ! এই পাখা গজানো টাকার রাজ্যে কেনো কেউ সুযোগ পেয়ে নিজেকে বঞ্চিত করবে?
অন্তত দুই দশক আগে থেকে এই অবস্থার সূত্রপাত৷ লায়লা একটা ওপেন সিক্রেটকে ওপেন করে দিয়েছে কেবল, এর বেশি কিছু নয়৷