সিনেমা হলে বিবাহ বার্ষিকী, জন্মদিনের পার্টি!
১৯ ডিসেম্বর ২০২০দক্ষিণ কলকাতার হার্দিক জৈন লকডাউনের পর এই প্রথম সিনেমা হলে গেলেন৷ স্ত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে তিনি মাল্টিপ্লেক্সে বড় পর্দার সামনে জন্মদিনের পার্টির আয়োজন করেছিলেন৷ আত্মীয়-স্বজন কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন৷ কেক কাটার পাশাপাশি হার্দিকের স্ত্রী আইনক্সের ভিডিও জকির কাছ থেকে বার্থডে মেসেজ পেয়ে খুব আশ্চর্য হলেন৷ তিনি বলেন, ‘‘বড় পর্দায় পুরোনো সিনেমা দেখার মধ্যে দিয়ে আমার আলাদা অভিজ্ঞতা হয়েছে৷ জন্মদিনে একেবারে অন্যরকম অনুভূতি৷'' একই অভিজ্ঞতা জিতেন্দ্র ভাটিয়ার৷ তিনি বিবাহবার্ষিকী উদযাপনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন সল্টলেকের কার্নিভাল সিনেমাকে৷ চলচ্চিত্রের পাশাপাশি রুপোলি পর্দায় তাঁদের একান্ত ব্যক্তিগত প্রাক-বিবাহ ভিডিও দেখানো হয়৷ তা দেখে সস্ত্রীক ভাটিয়ার মতো অনেক দম্পতি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছেন৷ যেমন নিখিল ভেঙ্কটেশ ও সাই মনভিতা৷ তাদের বিবাহ সংক্রান্ত ভিডিও বড় পর্দায় দেখে আত্মীয়রাও খুব খুশি৷
এমন অনেকে জন্মদিন বা বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনের জন্য বেছে নিচ্ছেন কলকাতার খ্যাতনামা মাল্টিপ্লেক্সগুলিকে৷ পিভিআর, আইনক্স বা কার্নিভাল এভাবেই নতুন বিনোদনের সুযোগ এনে দিচ্ছে দর্শকের সামনে৷ দামও একেবারে নাগালের মধ্যে৷ এক হাজার ৯৯৯ টাকা দিলেই পিভিআর প্রাইভেট স্ক্রিনিংয়ের জন্য বুক করা যেতে পারে৷ অন্যদিকে আইনক্সে দুই হাজার ৯৯৯ টাকা খরচ করলে ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া পাওয়া যাবে৷ কার্নিভাল-এর ক্ষেত্রে এই খরচ এক হাজার ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত৷ সিনেমা দেখার পাশাপাশি অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে খাওয়াদাওয়ারও যথেষ্ট আয়োজন রয়েছে৷
আইনক্স-এর মার্কেটিং অফিসার সৌরভ বর্মা বলেন, ‘‘বিভিন্ন জায়গায় আপনি নানা রকম ট্রেন্ড দেখবেন৷ কোথাও রজনীকান্তের ছবি দেখতে দেখতে একজন তার প্রেমিকাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল৷ আবার দক্ষিণ কলকাতায় পরিবারের অনেকে পুজোর উৎসবে প্রাইভেট স্ক্রিনিং উপলক্ষে জমায়েত করে আনন্দে মাতছেন৷’’
মাল্টিপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ এই প্রাইভেট স্ক্রিনিং নিয়ে আশাবাদী৷ নভেম্বরে বুকিং শুরু হওয়ার পরপরই প্রতি সপ্তাহে বেশ ভালো বুকিং হচ্ছে৷ কার্নিভাল সিনেমার কুণাল সাহানি বলেন, ‘‘আনলক পিরিয়ডে যখন হলগুলি নতুন করে খুলতে শুরু করল, তখনই এই ট্রেন্ডটা চোখে পড়েছিল৷ নতুন বাংলা ছবির বুকিংয়ের ক্ষেত্রে ১৮-২০ জন একসঙ্গে ব্যক্তিগত বুকিং করেছিলেন৷’’
সন্দেহ নেই যে, এই প্রাইভেট স্ক্রিনিং সিনেমাপ্রেমীদের কাছে বিনোদনের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে৷ যথাযথ স্যানিটাইজেশনের সঙ্গে দূরত্ববিধি বজায় রেখে জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী বা যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান এভাবে উদযাপন করা কার্যত লকডাউনের ফসল৷
নতুন বাংলা ছবি আসার পরেও হলগুলির লোকসান দূর হয়নি৷ যেখানে প্রিয়া, প্রাচী, অশোকা, ইন্দিরা, মেনকার মত সিঙ্গল স্ক্রিন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেখানে এই প্রাইভেট স্ক্রিনিং কি সিনেমা ব্যবসার হাল ফেরাতে সাহায্য করবে?
চলচ্চিত্র সমালোচক, সাংবাদিক নির্মল ধর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের দেশের মানুষের যা অর্থনৈতিক সামর্থ্য তাতে তিন বা পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে হল ভাড়া করা সম্ভব? আর তাতে পাবলিক বিনোদন বলে কিছু হচ্ছে না৷ মাল্টিপ্লেক্সের সঙ্গে শপিং মল আছে৷ কিন্তু সিঙ্গল স্ক্রিনের ক্ষেত্রে সেটা নেই৷ সিঙ্গল স্ক্রিনে এমন প্রাইভেট স্ক্রিনিং করা সহজ নয়, আর তাতে নিয়মিতভাবে দর্শকও পাওয়া যাবে না৷’’
প্রাইভেট স্ক্রিনিং সিনেমা হলের দশা ফেরানোর সঠিক সমাধান বলে মনে করেন না নির্মল৷ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজ-এর অধ্যাপক মানস ঘোষ বলেন, ‘‘কলকাতার বিত্তশালীদের জীবন এখন অনেকটা সঞ্জয় লীলা বনসালির ছবির মতো হয়ে গিয়েছে৷ তাই এই প্রাইভেট স্ক্রিনিংয়ে মানুষ উৎসাহ পাচ্ছে৷’’ কিন্তু তাতে আদতে সিনেমার কিছু ভালো হবে না বলেই অধ্যাপকের মত৷ তিনি বলেন, ‘‘ওয়েব সিরিজের জন্য অডিটোরিয়ামে যাওয়ার প্রবণতা কমে গিয়েছে৷ এটা অস্বীকার করার উপায় নেই৷ সামগ্রিকভাবে বাজারের অনেক ক্ষতি হয়েছে৷ সিনেমা হলের যে গণতান্ত্রিক পরিসর ছিল, তা প্রাইভেট স্ক্রিনিংয়ের ফলে ব্যাহত হবে৷’’ অধ্যাপকের বক্তব্য, ‘‘বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিপরীতেই ছিল সিনেমা হলের অবস্থান৷ সিনেমা হলে একসঙ্গে বসে সব ধর্ম-বর্ণ-জাতি-লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষ ছবি দেখতে পারে৷ প্রাইভেট স্ক্রিনিংয়ের এই ট্রেন্ড বিভাজন তৈরি করবে বলেই আমার ধারণা৷’’