অন্তরার সেরা হওয়ার গল্প
৬ ডিসেম্বর ২০১৯ডয়েচে ভেলে : কারাতে খেলায় আপনার আগ্রহ হলো কিভাবে?
হুমায়রা আক্তার অন্তরা : কারাতে হচ্ছে মার্শাল আর্ট৷ মেয়েদের জন্য জরুরি৷ এটি আত্মবিশ্বাস বাড়ায় যে, নিজে চলতে-ফিরতে পারবো৷ পাশপাশি এটি একটি খেলা৷ এসএ গেমসে স্বর্ণপদক জিতে নিজেকে তুলে ধরারও সুযোগ রয়েছে৷ এই দুটো জিনিস মিলিয়েই আমি কারাতেকে ভালোবাসি৷ ২০১০ এসএ গেমসে সান-মুনরা স্বর্ণপদক পান৷ তাঁদের দেখেই আমার কারাতেতে আসা৷
তখন আপনার বয়স কেমন?
১৩ বছর৷
ওই অল্প বয়সেই সান-মুনদের এসএ গেমসে স্বর্ণপদক পাওয়া দেখে কারাতের প্রেমে পড়ে গেলেন!
হ্যাঁ৷
বাসা থেকে কেমন সমর্থন পেয়েছেন?
আমার বাসা থেকে সবাই সমর্থন দিয়েছেন৷ তাতে কোনো সমস্যা হয়নি৷ তবে পড়াশোর জন্য চাপ ছিল৷ সেখানে ভালো করার কথা সব সময় বলা হতো৷ কিন্তু আমি সব সময় খেলাধুলাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছি৷
বাংলাদেশের প্রেক্ষোপটে খেলায় প্রাধান্য দেয়া মেনে নেয়া পরিবার খুব একটা দেখা যায় না৷ বিশেষত তা যদি কারাতের মতো ইভেন্ট হয়...
কারাতেতে আমি সব সময় ভালো করতাম৷ আমার ছোট দুই বোনও কারাতে করে৷ তবে বয়সের কারণে ওরা এবারের গেমসে সুযোগ পায়নি৷ আর সান-মুন সেনসি (শিক্ষক) ছোটবেলা থেকেই আমার শিক্ষক৷ ওনারা সব সময় অনুপ্রেরণা দিতেন, যে কারণে অনেক বাধা থাকা সত্ত্বেও আমরা কারাতেতে চলে এসেছি৷
আপনার পড়ালেখা এখন কোন পর্যায়ে?
এ বছর ইন্টারমেডিয়েট পাস করেছি৷
কারাতে নিয়ে এরপর আপনার স্বপ্ন কী?
পরের এশিয়ান গেমসে ভালো ফল করতে চাই৷
স্বর্ণপদক জিততে চান?
স্বর্ণপদকের কথা বললে ভুল হবে, যেহেতু এশিয়ান গেমস৷ কিন্তু দেশের জন্য ভালো ফল করতে চাই৷
আবার দেশের নাম তুলে ধরতে চাই৷
এসএ গেমস খেলার জন্য এবার যখন নেপাল যান, তখন কি স্বপ্নের আকাশ এত বড় ছিল যে, স্বর্ণপদক জিততে পারবেন?
না, এটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার৷ স্বপ্নের মতো৷ এ স্বপ্ন দেখে দেখে আমি বড় হয়েছি৷ তা যে এত সহজে পাবো, সে বিশ্বাস ছিল না৷ এমনিতে সবাই আমার প্রতি বিশ্বাস রেখেছিলেন যে, আমি পারবো৷ কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সাফল্য পাবো, এটি অবিশ্বাস্য৷
আপনি স্বর্ণপপদক পাবার পর পরিবারের প্রতিক্রিয়া কী? মা-বাবার সঙ্গে নেপাল থেকে নিশ্চয়ই কথা হয়েছে?
হ্যাঁ৷ তাঁরাও আমার মতো বিশ্বাস করতে পারছেন না৷ সবাই খুবই খুশি; খুবই আনন্দিত৷ তাঁরা অনেক দিন ধরেই আশা নিয়ে ছিলেন যে, আমি কিছু একটা করবো৷ সেটি করতে পেরেছি বলে তাঁরা অনেক বেশি আনন্দিত৷
এখন আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বা স্বপ্নের পুরোটাই কি কারাতে ঘিরে? নাকি পড়াশোনার দিকেও মনোযোগ দিতে চান?
পড়াশোনা তো অবশ্যই করতে চাই৷ খেলার পাশাপাশি আমি পড়ালেখা চালিয়ে এসেছি৷ এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ পেয়েছি৷ এইচএসসিতে জিপিএ ফোর পেয়েছি৷ এবার ফর্ম ফিলাপ করেছিলাম; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া আমার মূল লক্ষ্য ছিল৷ কিন্তু ঠিক সে মুহূর্তে আমাদের কারাতের ক্যাম্প চালু হয়৷ আমি তাই পড়াশোনা ও খেলাধুলা একসঙ্গে চালাতে পারিনি৷ শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে পড়াশোনা ছাড়তে হয়েছে৷ সেজন্য অনেক কষ্ট হয়েছে৷ এবারের এসএ গেমসে খেলার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার মধ্যে একটা কষ্টের অনুভূতি ছিল৷ মনে হয়েছিল, যদি পদক না জিততে পারি! অথচ এই কারাতের জন্য আমি পড়াশোনা ছেড়ে এসেছি৷ এখন আমার বন্ধুরা সবাই ভালো ভালো জায়গায় পড়াশোনা করছে৷ সেজন্য কষ্ট লাগছিল৷
আগে তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলোয়াড় কোটায় ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির সুযোগ ছিল৷ এখন তা সেভাবে নেই৷ সেটি আবার চালু হলে নিশ্চয়ই আপনার মতো যাঁরা খেলাকে প্রাধান্য দেন, তাঁদের জন্য ভালো হয়?
অবশ্যই অবশ্যই৷ আমরা যাঁরা খেলাধুলা করি, তাঁদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়৷ এটিকে শুধু খেলাধুলা বললে ভুল হবে৷ আমরা দেশের পতাকা ধরি, আমরা দেশকে প্রতিনিধিত্ব করি৷ এর সম্মানটা অনেক বেশি৷ পাশাপাশি আমরা পড়াশোনাও করতে চাই৷ কিন্তু খেলার পাশাপাশি পড়াশোনা অনেক সময় চালাতে পারি না৷ অনেকে অনেক মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসেন৷ তাঁদের পক্ষে দুটো একসঙ্গে চালানো সম্ভব হয় না৷ আমাদের জন্য তাই যদি খেলোয়াড় কোটার ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে মনে হতো, আমরা দেশের জন্য যে সম্মান এসেছি, দেশও আমাকে সেই সম্মান দিচ্ছে৷ খেলার পাশাপাশি সেভাবে পড়াশোনা চালাতে পারাটা হবে খুবই সম্মানের বিষয়৷
সাক্ষাৎকারে আপনি বারবার দেশের কথা বলছেন৷ ঠিক যে মুহূর্তে এসএস গেমসে স্বর্ণপদক জিতলেন, মঞ্চে গেলেন, জাতীয় পতাকা উড়ছে, জাতীয় সংগীত বাজছে, ঠিক সে মুহূর্তে আপনার অনুভূতি কেমন ছিল?
আসলে সে মুহূর্তটা বলার আগের সময়টার কথা আগে বলতে চাই৷
প্লিজ...
প্রথম যেদিন খেলা ছিল, সেদিন সবাই ব্রোঞ্জ পেয়েছিলাম৷ আমিও নিজের ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পাই৷ তখন অন্যান্য দেশের জাতীয় সংগীত বাজছিল, সেসব দেশের পতাকা সবচেয়ে উপরে উড়ছিল৷ আমার নিজের ভেতরে তখন এত কষ্ট, এত আক্ষেপ ছিল, মনে হচ্ছিল, কেন বাংলাদেশের পতাকা ঠিক ওই জায়গায় সবচেয়ে উঁচুতে ওড়াতে পারছি না৷ ভাবছিলাম, সেখানে বাংলাদেশের পতাকা থাকা দরকার; আমাদের জাতীয় সংগীত শোনানো দরকার৷ পর দিন আমি যখন খেলতে নামি, তখন সে কথাটাই সবচেয়ে বেশি করে মাথায় ছিল৷ আমি নিজের জন্য না, দেশের জন্য খেলছি৷ আমি যে খেলছি, সেটি দেশের লড়াই চলছে৷ এরপর তো মঞ্চে উঠে দেশের জন্য স্বর্ণপদকই নিলাম৷