অশান্তি, রক্তপাতে পশ্চিমবঙ্গের শেষ দফার ভোট
১ জুন ২০২৪সপ্তম তথা শেষ দফায় পশ্চিমবঙ্গে নয়টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হল শনিবার। ১৯ এপ্রিল নির্বাচন শুরু হয়। সাতটি দফায় ৪২টি কেন্দ্রে ভোট হয়েছে।
এদিন ভোট ছিল কলকাতা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও উত্তর ২৪ পরগনার নয়টি কেন্দ্রে। উত্তর কলকাতা, দক্ষিণ কলকাতা, দমদম, বারাসত, বসিরহাট, ডায়মন্ড হারবার, জয়নগর, মথুরাপুর, যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে ভোট নেয়া হয়। ভোটগ্রহণ করা হয়েছে বরানগর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে। বিভিন্ন কেন্দ্রে সারাদিন ছিল উত্তেজনা।
রণক্ষেত্র ভাঙড়
পঞ্চায়েত নির্বাচনে রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়। লোকসভা নির্বাচনেও সহিংসতার ছবি দেখা গেল যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত এই এলাকায়।
ভাঙড় বিধানসভায় ২০২১ সালের ভোটে জেতেন বাম ও কংগ্রেস সমর্থিত আইএসএফ প্রার্থী নওশাদ সিদ্দিকী। তাদের প্রার্থী থাকলেও যাদবপুর কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী সায়নী ঘোষের মূল লড়াই সিপিএমের সৃজন ভট্টাচার্য ও বিজেপির অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে।
যদিও ভাঙড় এলাকায় দিনভর যুযুধান তৃণমূল ও আইএসএফ। সবচেয়ে বেশি গণ্ডগোল হয় ফুলবাড়ি ও সাতুলিয়াতে। দুটি জায়গাতেই বোমাবাজি হয়। দুই পক্ষের সমর্থকরা বাঁশ, লাঠি নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে দুই পক্ষের কয়েকজন আহত হয়েছে।
আইএসএফের অভিযোগ, বিভিন্ন জায়গায় তাদের ভোটারদের ভয় দেখিয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দিয়েছে তৃণমূলের বাহিনী। হাতিশালায় আইএসএফ এজেন্টকে অপহরণের অভিযোগ ওঠে। নলমুড়িতে বুথে যাওয়া অনেক ভোটার আক্রান্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ। শাসকদলের দাবি, ভোট শান্তিতেই হয়েছে। গণ্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করেছে আইএসএফ।
একাধিক জায়গায় জমায়েত সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। লাঠি থেকে বাঁচতে এক নাবালক পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। লাঠির ঘায়ে আহত হয়েছেন প্রবীণরাও। একটি শিশুকে ভয়ে বিদ্যুতের খুঁটির আড়ালে লুকোতে দেখা যায়। এলাকায় মিলেছে তাজা বোমা।
সন্দেশখালি উত্তপ্ত
এই লোকসভা নির্বাচনের অন্যতম বড় ইস্যু সন্দেশখালি। সেখানকার নারীরা নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছেন তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। শেখ শাহজাহান সহ তৃণমূলের কয়েকজন নেতা এখন জেল। এই পরিস্থিতিতে শনিবার ভোট গ্রহণ করা হয় বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের অধীন সন্দেশখালি এলাকায়।
রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যায় বয়রামারিতে। বিজেপির অভিযোগ, তৃণমূলের বাইক বাহিনী এই এলাকায় হামলা চালায়। কয়েকজন বিজেপি কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মারধর করে। ভোটের আগের দিন রাতে বিভিন্ন জায়গায় বিজেপি সমর্থকদের শাসানো হয় বলে অভিযোগ। নারীরা রাত জেগে গ্রামের বিভিন্ন এলাকা পাহারা দিয়েছিলেন। তাদের দাবি, পুলিশের পোশাকে তৃণমূলের বাহিনী এসে নারীদের মারধর করেছে।
সন্দেশখালিতে এক তৃণমূল কর্মীকে বিজেপি মারধর করে বলে অভিযোগ। খুলনা এলাকায় বিজেপি কর্মীদের উপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। ভোটদানে বাধা দেয়ারও অভিযোগ করেছেন গ্রামবাসী। বিভিন্ন জায়গা থেকে একই ধরনের অভিযোগ এসেছে। যদিও পরে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে গ্রামবাসী দলবদ্ধ ভাবে বুথে গিয়ে ভোট দিয়েছেন কোথাও কোথাও। অভিযোগ অস্বীকার করেছে শাসক দল।
বসিরহাটে বিজেপি প্রার্থী করেছে সন্দেশখালি আন্দোলনের অন্যতম মুখ রেখা পাত্রকে। তার বিরুদ্ধে তৃণমূলের প্রার্থী, সাবেক সাংসদ হাজি নুরুল ইসলাম।
শেষ বেলায় তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয় বাসন্তী হাইওয়ে লাগোয়া সরবেড়িয়ায়। পুলিশ কাছাড়িপাড়া গ্রামের তরুণদের আটকে রেখেছে, এই অভিযোগে গ্রামবাসী সড়ক অবরোধ শুরু করেন। পুলিশ অবরোধ তুলতে এলে তাদের লক্ষ করে ইটবৃষ্টি করা হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ।
পুকুরে ইভিএম
গতবছরের পঞ্চায়েত নির্বাচনে একাধিক জায়গায় দেখা গিয়েছিল, ক্ষুব্ধ জনতা ভোট দিতে না পেরে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নিয়েছে। কোথাও তা পুকুরে ফেলে দেয়া হয়। লোকসভা নির্বাচনেও ফিরল সেই ছবি।
জয়নগর লোকসভা কেন্দ্রের অধীন কুলতলির মেরিগঞ্জে ভোটারদের ভয় দেখানোর অভিযোগ ওঠে। গ্রামবাসীর দাবি, শাসক দলের বাহিনী ভোট দিতে বাধা দিচ্ছে। এরপর দলবদ্ধ ভাবে বুথে অভিযান করেন গ্রামবাসী। ইভিএম বা ভোটযন্ত্র তুলে ফেলে দেয়া হয় পুকুরে। পরে নতুন ইভিএম এনে ভোটগ্রহণ শুরু করা হয়। তৃণমূল অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
দুই প্রার্থীর অ্যাকশন
এদিনের ভোটপর্বে নজর কাড়লেন উপনির্বাচনের দুই বিরোধী প্রার্থী। বরাহনগর বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায় পদত্যাগ করে যোগ দেন বিজেপিতে। উত্তর কলকাতায় তিনি এবার পদ্মফুলের প্রার্থী। সে কারণে এই বিধানসভায় উপনির্বাচন।
বরাহনগরের সিপিএম প্রার্থী তন্ময় ভট্টাচার্য বিকেসি কলেজে গেলে তৃণমূল কর্মীরা তাকে বাধা দেয়। স্থানীয় এক তৃণমূল কাউন্সিলরের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়েন তন্ময়। দুজনের মধ্যে হাতাহাতি হয়। তৃণমূল নেতার কলার ধরে টানেন বর্ষীয়ান তন্ময়।
এই কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী সজল ঘোষ বুথে বুথে ঘুরে বেড়িয়েছেন। রবীন্দ্র ভবনে গিয়ে তিনি রীতিমতো তাড়া করে একজন ভুয়া ভোটারকে পাকড়াও করেন। আরো বুথে ভুয়া ভোটার ধরেছেন তিনি।
বিক্ষিপ্ত উত্তেজনা
শেষ দফার জন্য পশ্চিমবঙ্গে ৯৬৭ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। তৈরি রাখা হয়েছিল দুই হাজার কুইক রেসপন্স টিম। কিন্তু তা সত্ত্বেও গন্ডগোলের ছবি দেখা গিয়েছে গোটা দিন।
ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী অভিজিৎ দাস দফায় দফায় বিক্ষোভের মুখে পড়েন। তাকে রুখতে ফলতায় পথ অবরোধ করেন তৃণমূল সমর্থকরা। অভিজিৎ ছাড়াও এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছেন সিপিএমের যুব নেতা প্রতীক উর রহমান।
প্রতীক একটি বুথে গিয়ে ভুয়া এজেন্ট চিহ্নিত করেন। তাকে হাতেনাতে পাকড়াও করলে দৌড়ে চম্পট দেয় সে। সিপিএম প্রার্থী বলেন, "কমিশন যতটা গর্জে ছিল, তার কিছুটা বর্ষালে ভালো হত। ডায়মন্ড হারবারের ৫০ শতাংশ আসনে বিরোধী এজেন্টের বার করে দেয়া হয়েছে।"
দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী সায়রা শাহ হালিম পিকনিক গার্ডেনের একটি বুথে ভুয়া এজেন্ট ধরেন। সিপিএমের সাবেক রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের কন্যা রোশেনারা অন্য একটি বুথে হালিমের এজেন্ট ছিলেন। তাকে তৃণমূল হেনস্থা করে বলে অভিযোগ।
যাদবপুরে ১০২ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএমের ছটি ক্যাম্প অফিস ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। গন্ডগোলে নাক ফেটেছে এক নারী বাম কর্মীর।
শনিবার গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ জমা পড়েছে নির্বাচন কমিশনে। দুপুর একটা পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৯০০ অভিযোগ জমা পড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগকারী বিজেপি ও সিপিএম।
ভোটের গণ্ডগোলের আঁচ লেগেছে সংবাদকর্মীদের গায়ে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ে দুই পক্ষের মাঝে পড়ে আঘাত পেয়েছেন টিভি চ্যানেলের চিত্র সাংবাদিক। বরাহনগরে একটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক কেন্দ্রীয় বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হন।
ভোটদানের হার
দেশজুড়ে সাতটি দফায় ৫৪২টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা হয়েছে। ভারতের অন্যত্র বিভিন্ন দফায় ভোটদানের হার মোটের উপর কম হলেও পশ্চিমবঙ্গে যথেষ্ট ভালো। শনিবারও এর ব্যতিক্রম হল না। সপ্তম দফায় বিকেল তিনটে পর্যন্ত, নির্বাচন কমিশনের হিসেব অনুযায়ী ভোট পড়েছে ৫৮ শতাংশের কিছু বেশি।
এর মধ্যে দমদমে ৫৩, বারাসতে ৫৯, বসিরহাটে ৬৬ শতাংশ ভোট পড়েছে। জয়নগরে ৬২, মথুরাপুরে ৬৩, ডায়মন্ড হারবারে ৬১, যাদবপুরে ৫৬ শতাংশ হার ভোটদানের। মহানগরে ভোট দেয়ার উৎসাহ কম। দক্ষিণ কলকাতায় ৫০ ও উত্তর কলকাতায় ৫১ শতাংশ ভোট পড়েছে। কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনের বুথে এদিন ভোট দেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বরাহনগর বিধানসভা উপনির্বাচনে বিকেল তিনটে পর্যন্ত ভোটদানের হার ৫৩ শতাংশ।
শেষ পর্বের নয়টি আসনের সবকটিতেই গত লোকসভা নির্বাচনে জিতেছিল তৃণমূল। শনিবারও শাসক দলের দাপট দেখা গেল দিকে দিকে। সাংগঠনিক ক্ষমতায় বিজেপি ও সিপিএম যে এখনো অনেকটা পিছিয়ে, তা বোঝা গেল। বিরোধীদের দাবি, তৃণমূল পুলিশ ও প্রশাসনের সহযোগিতা পেয়েছে। এমনই দাবি বাম আমলে শোনা যেত তৎকালীন বিরোধী তৃণমূলের মুখে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী বলেন, "বামপন্থিদের যে সংগঠন ছিল, তা তৃণমূলের দিকে চলে এসেছে অনেকটাই। তৃণমূল আগের মডেল অনুকরণ করছে। নেতারা পাড়া নিয়ন্ত্রণ করছেন। একই সঙ্গে তৃণমূলের নেতারা আর্থিক যোগাযোগ গড়ে তুলেছেন। যাবতীয় ব্যবসা থেকে তাদের রোজগার হয়। পুরোপুরি সরকারি অনুগত্যে এই সংগঠন তৈরি হয়েছে। পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন বুঝে গিয়েছে, বিরোধীদের ক্ষমতা কম। তাই তাদের শাসক দলকে খুশি রাখলেই চলবে।''