1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
বিচার ব্যবস্থাবাংলাদেশ

'আইনজীবীদের, অভিযুক্তদের ওপর হামলা মানবাধিকারের লঙ্খন'

হারুন উর রশীদ স্বপন (ঢাকা)
২৫ অক্টোবর ২০২৪

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন বর্তমান বিচার ব্যবস্থা ও বিচার বিভাগের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে।

https://p.dw.com/p/4mE4H
মনজিল মোরসেদকে দেখা যাচ্ছে পেছনে বইয়ের তাকের সারির সামনে দাঁড়ানো৷
বাংলাদেশের আইনজীবী ও অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ৷ছবি: Sazzad Hossain /DW

ডয়চে ভেলে: দেশে তো একটি ‘বিপ্লব' হয়েছে। বিচার বিভাগের সংস্কার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে। তাহলে আন্দোলন ও সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাওয়ের মাধ্যমে বিচারপতিদের পদত্যাগে বাধ্য করা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কতটা নিশ্চিত করবে?

মনজিল মোরসেদ: এভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতের কোনো সুযোগই নাই। কারণ, যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আছে, সেটাকে পাশ কাটিয়ে আপনি যখন ঘেরাও করে বলবেন ‘চলে যেতে হবে'- তার ফল যে কী হবে বুঝতে পারবেন। আজকেও (বুধবার) দেখেছেন যারা পাস করেনি, তারা সচিবালয়ে ঢুকে বলছে, ‘পাস করিয়ে দিতে হবে।'একই কাজ তারা এর আগেও করেছে। লালবাগ থানা মামলা নিচ্ছিলো না। তারা বলেছে, ‘মামলা নিতে হবে।' চট্টগ্রামের আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট বাদীকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আপনার আসামিদের নাম কী?' সে আসামিদের নাম বলতে পারেনি। এই প্রেক্ষিতে আদালত আদেশ দিতে চাননি। কিন্তু সরকার সমর্থক আইনজীবীরা তখন তারা আদালতকে চাপ দিলো আদেশ দিতে। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এটা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

প্রধান বিচারপতির ভূমিকা কী? তিনি যদি বিচারকদের চায়ের দাওয়াত দিয়ে ছুটিতে পাঠিয়ে দেন... তারও তো একটা ভূমিকা থাকবে?

আমার ধারণা ছিল প্রধান বিচারপতি যখন শপথ নিয়েছেন, তিনি নিজেই প্রধান উপদেষ্টা ও আইন উপদেষ্টাকে বলবেন, ‘‘আপনারা আমাকে নিয়োগ করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিষয় থাকলে আমাকে বলবেন। আইনত কিছু করার থাকলে আমি করবো। কিন্তু আপনারা আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না।'' এটা আমার প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু হয়নি। কিন্তু যেটা হয়েছে, আগের দিন ঘোষণা দেয়া হয়েছে, পরের দিন ঘেরাও করলে তিনি সমন্বয়কদের নাম দেয়া ৩০ জনের মধ্যে ১২ জনকে চলে যেতে বলে ঘেরাওকারীদের আশ্বস্ত করেছেন। বিচার বিভাগকে রক্ষা করা বা এগুলো যে খারাপ উদাহরণ হবে- এই ব্যাপারে তার অবস্থান  যেভাবে প্রদর্শন করা দরকার ছিল, সেটা তিনি যে-কোনো কারণে হোক করেননি।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস কিন্তু বলেছিলেন, বিচার বিভাগে কোনো হস্তক্ষেপ করা হবে না এবং বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকবে। তার দিক থেকে কি সেই চেষ্টা দেখছেন?

বিচার বিভাগটা এদেশে আছে। সবকিছু আছে। দেখতে হবে রাষ্ট্রের নেতৃত্বে কে আছে। রাষ্ট্রের নেতা কে? ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিশ্ব তাকেই চেনে। তাকেই নেতা হিসাবে ধরা হচ্ছে। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে অনেক উপরে তার অবস্থান মানুষ হিসাবে। কিন্তু উনি এখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ওনার নেতৃত্বে দেশ থাকার পরও বিভিন্ন জায়গায় জোর জবরদস্তি, বৈষম্য, নির্যাতন, বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চলছে। এর মাধ্যমে ওনার ভাবমূর্তি কিন্তু ক্ষুন্ন হচ্ছে। এটা ওনার সতর্কভাবে দেখা দরকার। শেখ হাসিনা সরকারের সময় ন-র্যাতন নিপীড়নের দায়িত্ব কিন্তু শেখ হাসিনাকেই নিতে হচ্ছে।

ড. ইউনূস বললেই কিন্তু হয়ে যায়। রাষ্ট্রকে সঠিক পথে চালানো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টি কিন্তু তাকেই দেখতে হবে।

নতুন যে ২৩ জন বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়েছে সেখানে কি কোনো নীতিমালা মানা হয়েছে?

না, মানা হয়নি। ৮ আগস্টের পরে প্রথমে যখন প্রশ্ন এসছিল, তখন আমি আশাবাদী ছিলাম যে, সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার করা যাবে। এটা এক মাসের মধ্যেই সম্ভব ছিল।  কথা ছিল তারা প্রথমে বিচারপতি নিয়োগের আইনটি ফাইনাল করবেন। ফাইনাল করলে আজকে এই সমস্যা হতো না। বারের প্রেসিডেন্ট তো বিএনপি করেন। এরকম অনেকে বিএনপি সমর্থিত। নিরপেক্ষ লোকজনও তো আছে। অনেকেই কিন্তু বলছেন, নিয়োগ যথাযথ হয়নি। কেন হয়নি? কারণ, নিয়োগের আইন না করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আইন উপদেষ্টা এই যে নিয়োগের আইনটা করলেন না, এটা তার আরেকটা ব্যর্থতা। বিচার বিভাগ স্বাধীন করার জন্য যে কাজ, তার মধ্যে এটাকে আমি একটা ব্যর্থতা হিসাবে দেখছি।

বিরোধী মতের আইনজীবীদের ওপর আদালত এলাকায় হামলা, আসামিদের পক্ষে আইনজীবী দাঁড়াতে না দেয়া- এই বিষয়গুলোকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

প্রথমত, এটা বেআইনি এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এরই মধ্যে কিছু লোক কিন্তু প্রশ্ন করা শুরু করেছে যে, আপনারা তো পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন, আইনের শাসনের কথা বলেছিলেন, এটা কি আপনাদের আইনের শাসন? একজনকে যখন আপনি গ্রেপ্তার করবেন, তখন তার নিরাপত্তার দায়িত্ব আপনার। যদি কেউ আক্রমণ করে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এরশাদের সামরিক শাসনের সময় এরকম হয়নি। আওয়ামী লীগের সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় খান সাইফুর রহমান ছিলেন আসামির আইনজীবী। তিনি কোনো বাধা ছাড়াই মামলা পরিচালনা করেছেন। তার ওপর বা তার বাড়িতে কিন্তু কোনো হামলা হয়নি। আওয়ামী লীগের যারা পালিয়ে গেছেন, গ্রেপ্তার হয়েছেন, আত্মগোপনে আছেন, নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে অপরাধী আছেন। কিন্তু অপরাধের বিচার আপনি আইন অনুযায়ী করতে দিন। বিচার যদি আপনি নিজে করেন, তাহলে সেটা হবে খারাপ উদাহরণ। এটা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে আপনিও কিন্তু এই অবস্থার শিকার হবেন। ইতিহাস সেটাই বলে।

‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টি কিন্তু ড. ইউনূসকেই দেখতে হবে’

আদালত এলাকায় হামলার ব্যাপারে আদালত বা ওই এলাকার পুলিশ কি ব্যবস্থা নিতে পারতো না?

পুলিশ পারতো। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন আসছে যে, এখন যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তারা কি স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন? তারা কি ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠে দায়িত্ব পান করতে পারছেন?  বিচারকের ক্ষমতা আছে। তারা কয়েক জায়গায় এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা পারেননি। আইন উপদেষ্টা ও রাষ্ট্র কিন্তু ওই বিচারকদের পাশে দাঁড়ায়নি। তারা যদি দাঁড়াতো. তাহলে আজকে এই অবস্থা হতো না। পুলিশ পারবে না। কারণ, পুলিশের মূল যে স্পিরিট- সেটা তো কিছুটা ধ্বংস হয়ে গেছে। সেটা ফিরে আসতে তো সময় লাগবে।

যাকে খুশি তাকে মামলার আসামি করা হচ্ছে। অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্নাকে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। মামলার ক্ষেত্রে কি নৈরাজ্য হচ্ছে? এখানে কি বিচার বিভাগ কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে?

এই সরকার পরিবর্তনে অনেক বুদ্ধিজীবী, যারা ভূমিকা রেখেছেন, তারাই তো এখন বলছেন যে এগুলো কোনোভাবেই আইনের মধ্যে পড়ে না। যে মামলা করা হচ্ছে সেই মামলা যদি এইভাবে ত্রুটিপূর্ণ হয় তাহলে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভিকটিম বিচার পাবেন না। এইসব মামলার মাধ্যমে আসলে বিচার প্রার্থীরও ক্ষতি করা হচ্ছে। বিচার বিভাগ স্বাধীন হলে তারও বিষয়গুলো দেখতে পারতো। পুলিশেরও একটা দায়িত্ব আছে। কিন্তু তারাও তো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেনা।

শেষ পর্যন্ত এই অবস্থা চলতে থাকলে আপনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার আইনের শাসন নিয়ে কতটা আশাবাদী?

যেকোনো সময় কিন্তু টার্ন আউট করা যায়। গাড়ি যে গতি পথে যাচ্ছে তা পরিবর্তন করা যায়। রাষ্ট্র চাইলে এখন যা হচ্ছে তা থামাতে পারে। গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে। এখন পর্যন্ত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সংস্কার এগুলোর জন্য তেমন কিছুই করা হয়নি। বিচারক নিয়োগের আইন, হাইকোর্ট থেকে আপিল বিভাগে কীভাবে বিচারক নিয়োগ করা হবে-এসবের কিছুই হয়নি। এগুলো করতে তো তেমন সময় লাগে না। তারা তো করছেন না। হয়তোবা তারা এক সময় করবেন। দুই বছর, তিন বছর পর। কিস্তু আমাদের তো আশা ছিল দ্রুত করার- এখনই করার। সেটা করলে আমরা আশ্বস্ত হতে পারতাম।