আইনের ফাঁক-বিচারের ফাঁক
১৯ নভেম্বর ২০২১ভীষণ শখ করে আইন পড়তে এসেছি৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে সুযোগ পাওয়ার পর মনে হয়েছিল জীবন পুরো সার্থক৷ সেখানে কি না কেউ একজন টিপ্পনি কাটছে৷ বড় ভাই হলেও এসব ইগোর জায়গায় ছেড়ে দেয়া যায় না৷
ক্ষুব্ধ গলায় বললাম, ‘আইনে পড়ি৷ কাজেই আইনই তো শিখব৷ বেআইনি কিছু তো শিখতে পারি না৷’
তিনি হাসলেন, ‘আইন শিখে লাভ নেই রে৷ শিখতে হবে আইনের ফাঁক৷ ভালো আইনজীবী সে-ই হয় যে আইনের ফাঁকটা শিখতে পারে৷’
সব ইচ্ছা পূরণ হয় না৷ অনেক শখ করে, পরিবারের সঙ্গে অনেক লড়াই করে যে আইন পড়েছিলাম সেটা পূর্ণতা পায়নি৷ ডিগ্রি নিলেও প্র্যাকটিসে যাওয়া হয়নি সাংবাদিকতা আর লেখালেখির নেশায়৷ কিন্তু বন্ধু বান্ধবের বেশিরভাগই আইন পেশার সঙ্গে জড়িয়ে বলে আজও আইন-বিচার অঙ্গনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ৷ দূরে থেকেও জায়গাটা যেন নিজেরই৷ তাই আইন বা বিচারব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে পড়লে বিষণ্ণ হই৷ এবার তো রীতিমত বিপন্ন বোধ করছি৷ একজন বিচারক, যিনি আবার নারী, তিনি কী করে এই কথা বলতে পারেন যে, ‘ধর্ষণের ক্ষেত্রে ৭২ ঘণ্টা পর মামলা নেয়া উচিত না৷’ পরে দেখছি লিখিত রায়ে সেটা নেই কিন্তু একজন বিচারক এমন বিশ্বাসের কথা মুখে বলতে পারেন এটা মাথায় আসলেই মুখ লুকাতে ইচ্ছে করে৷
যা বলছিলাম, আইনের ফাঁক৷ সেটার কথা সবাই জানে৷ এর পাশাপাশি গত কয়েক বছরে বিচারের ফাঁক বলে একটা ব্যাপারও কি সমান্তরালে চালু হয়ে যাচ্ছে না! পরীমনির রিমান্ডের ঘটনা নিয়ে বিচারকেরা বাড়াবাড়ি করলেন, খোদ সুপ্রিম কোর্টই বলছে৷ এর আগে তারেক রহমানের মামলায় একজন বিচারক বিচার করে বিদেশে পাড়ি দিলেন৷ অসাধারণদের ক্ষেত্রে বিচারের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সাধারণ ক্ষেত্রে যে কত কী হয়ে চলছে! সেসব আমরা খুব খেয়াল করি না৷ করলে জানতাম বিচারের ফাঁকটা দিনে দিনে এত বড় হয়েছে যে সে-ই ফাঁক দিয়ে ক্ষমতাবানেরা হাত-পা সব ঢুকিয়ে দিব্যি দোল খেয়ে বেড়াচ্ছে৷
বিচারের ফাঁক বা ফাঁকি নিয়েও একটা গল্প মনে পড়ছে৷ এক চেনা বন্ধুর বক্তব্য, তার আত্মীয়রা নাকি একবার একটা মামলায় পড়েছিল৷ একজনের ঘর ভেঙ্গে নেয়ার অভিযোগ৷ আমাদের গ্রাম-মফস্বলের মানুষেরা মনে করে একটা মামলায় কাজ হবে না৷ ওরা দুটো মামলা করে দিল৷ ঘর ভাঙার সত্য অভিযোগ তো আছেই৷ সঙ্গে ধান কেটে নেয়ার আরেকটা মামলা৷ দীর্ঘ জেরা, লম্বা সাক্ষী-পাল্টা সাক্ষীর পর শেষে রায় বেরোল একদিন৷ দেখা গেল, ঘর ভাঙার অভিযোগটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে৷ বেকসুর খালাস৷ আবার ধান কেটে নেয়া, যার কোনো বাস্তবতা নেই বলে ওর দাবি, সেটা সত্য বলে গণ্য হয়ে সবার জরিমানা হয়েছে৷ তারা এই বিচারে স্তম্ভিত৷ অবাক করা ব্যাপার হল, তাদের আইনজীবী আপিলে খুব আগ্রহী নন৷ বললেন, ‘ফল একই হবে৷’
কেন? এই নিরুৎসাহের কারণটা তারা ঠিক ধরতে পারেন না৷
আইনজীবী বুঝিয়ে বললেন, ‘আদালতের বিচারক তো আর ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকেন না৷ তিনি কাজ করেন সাক্ষ্যের ভিত্তিতে৷ এই মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণে যা পাওয়া গেছে তাতে এমনটাই হওয়ার কথা৷’
ওরা তখন ভেবে দেখল, সত্যিই ওদের পক্ষে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ লোক সাক্ষ্য দিতে আসেননি৷ আর ভুয়া মামলাটায় ওরা এমন আত্মবিশ্বাসী ছিল যে সাক্ষীদের হাজির করার ক্ষেত্রে নিজেদের দিক থেকেও খুব তৎপরতা দেখায়নি৷ সত্যি বললে, এই সাক্ষী ব্যাপারটা বিচারে সত্যের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷ এবং আমাদের বেশিরভাগ সাক্ষী আদালতে আসতে চান না৷ কেন আসবেন বলুন৷ ধরুন, ঢাকার কোনো একটা মামলায় একজন সাক্ষী থাকেন মিরপুরে, তিনি চাকুরীজীবী, এখন কোনো একটা ওয়ার্কিং ডে-তে তার পক্ষে কি জ্যাম ঠেলে পুরান ঢাকায় যাওয়া সম্ভব! সম্ভব অবশ্যই, মানুষ এর চেয়েও অনেক দুর্গম জায়গায় যায়, যদি তার নিজের তাগিদ থাকে৷ মামলায় সাক্ষীর তো সরাসরি কোনো প্রাপ্তির সুযোগ নেই৷ কেন যাবেন! সময় নষ্ট করে, পকেটের টাকা খরচ করে৷ সাক্ষীদের আনার জন্য সমন-টমন ইত্যাদি জারি করা হয়৷ কখনো কখনো ওয়ারেন্টও কিন্তু এরচেয়েও বেশি বোধহয় দরকার তার জন্য অন্য কোনো প্রণোদনার৷ যাতে তিনি উৎসাহ বোধ করে৷ এবং সবচেয়ে ভালো হয় সাক্ষ্য আইনটা নিয়েই ভাবলে৷ আমাদের সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ সালের, বৃটিশ বোধ দ্বারা তৈরি৷ সেই ১৮৭২, যখন পৃথিবীর অনেক দেশে নারীকে অর্ধেক মানুষ মনে করা হত, অনেক জায়গায় ভোটাধিকার ছিল না, সন্তান উৎপাদন আর লালনকেই ধরা হত তাদের একমাত্র প্রয়োজনীয়তা৷ মানুষের বোধ-বিবেচনার কি বিবর্তন হয়নি৷ সেই সময় যা ছিল আধুনিকতা আজ এর বেশিরভাগই সমাজের অন্য ক্ষেত্রে বর্জিত৷ তখনকার পোশাকের ধরণ বাতিল, সামাজিক যোগাযোগের প্রক্রিয়া এখন অচল, মানুষের চিন্তার ছবিই বদলে গেছে৷ বদলায়নি অনেক আইন৷ যে আইনে আজও ভিডিও বা ফোনালাপ ঠিক সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়৷ পুলিশ শুধু এগুলোর ভিত্তিতে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারে মাত্র৷
এই আইনের দুটো ধারা নিয়ে রিটও হয়েছে সম্প্রতি৷ একটা ধারা ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে খুব প্রাসঙ্গিক৷ যেখানে এটা অনুমোদিত যে প্রয়োজনে বাদীকে এমন প্রশ্ন করা যাবে যাতে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়৷ এর মানে হল, তার চরিত্র নিয়ে আপত্তিকর প্রশ্ন করা যাবে৷ ভাবা যায়, একজন নির্যাতিতাকে আরেক দফা প্রকাশ্য নির্যাতনের একরকম আইনি অনুমোদনও আছে৷ কেন যে এত বছরে এগুলো বদলায়নি এটা ভেবেই বিস্মিত বোধ করি৷ হয়ত এবার তৎপরতা বাড়বে৷ বতর্মান প্রতিবাদী পরিস্থিতি অনেককে উৎসাহিত করবে আপত্তিকর এসব ধারা রদে ভূমিকা রাখতে কিন্তু আইন সংস্কারের জন্যও যদি প্রতিবাদ-প্রতিরোধ লাগে তাহলে তো মানতেই হবে আইন আসলে ঠিক পথে চলছে না৷ এবং প্রতিবাদে আইন সংশোধনের মানে কিন্তু প্রচলিত আইনের প্রতি একরকমের অনাস্থাও৷ আইন প্রণেতা- আইন বিশেষজ্ঞরা একটু ঘুম থেকে জাগুন৷ না হলে কিন্তু এরকম ধাক্কার চোটে বিছানা-বালিশও খোয়াবেন৷
বিচারক আরও বিস্মিত করে এমন ধারণা দিয়েছেন যে এরা স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক করেছেন৷ খুব ভালো কথা৷ করেছেন৷ তার মানে কি এই যে, একবার যদি কেউ স্বেচ্ছায় শরীরের সম্পর্কে যায় তাহলে পরে তাকে ধর্ষণ করার অধিকার জন্মে যায়৷ বিচারকদের বাস্তব কারণে জাগতিকতা থেকে একটু দূরে থাকতে হয়৷ কিন্তু তারা কি এত দূরে চলে যান যে মানুষ আর সমাজের আওয়াজই ওখানে পৌঁছায় না৷ গত কয়েক বৎসরে বলিউডে ঠিক এরকম বিষয় নিয়ে দুটো ছবি তৈরি হয়েছে৷ পিংক আর সেকশন থ্রি সেভেনটি ফাইভ৷ সেরকম প্রতিষ্ঠিত এবং ক্ষমতাবান মানুষদের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ৷ পিংকে তো, ব্যপারটা অবিকল এরকম৷ স্বাধীন চেতা কিছু মেয়ের ক্ষেত্রে প্রায় এই বিষয়টা প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছিল যে ওরা নিজেরাই শারীরিক সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করেছিল৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়, সে যে-ই হোক, যেমনই হোক, তার আপত্তি মানেই সেটা ধর্ষণ৷ ব্যস৷ ‘না মানে না' বিপক্ষ আইনজীবী অমিতাভ বচ্চনের এই উচ্চারণ কিন্তু আমাদেরও ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে৷ বুঝলাম এই বিচারকের কাছে পৌঁছায়নি৷ এবং কে জানে হয়ত আরও অনেকের কাছে পৌঁছায়নি৷
একটা সময় নিম্ন আদালত পুরোটাই ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণে৷ সরকারি ম্যাজিস্ট্রেটরা নানান প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কোর্টে বসে বিচারক হয়ে যেতেন, ফৌজদারি বিচার কাজ করতেন৷ এখনও কিছু ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের বিচারকদের আইন মন্ত্রণালয় বা সরকারের কাছে দায়বদ্ধতা আছে তবু জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন চালুর পর সিংহভাগ ক্ষেত্রেই স্বাধীনতার চর্চা করার সুযোগ আছে৷ সুপ্রিম কোর্টের কাছেই তারা দায়বদ্ধ৷ তাহলে সমস্যাটা ঠিক চাকরির নয়, সমস্যাটা বোধের৷ চিন্তায়৷ আর তাই মনে হয়, এই জায়গাতেও বোধহয় সংস্কারের চিন্তা জরুরি৷ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আইনে অনার্স করে ২৫-২৬ বছর বয়সে একজন বিচারক হয়ে যাচ্ছেন৷ সেটা কি বিচার করার জন্য যথেষ্ট পরিণত বয়স! ধরলাম, বয়স কোনো বাধা নয় কিন্তু অভিজ্ঞতা! বন্ধুদের মধ্যে যারা প্র্যাকটিস করেন তারা বলেন, ৪-৫ বছর অনার্স-মাস্টার্স করে যা শেখে আদালতে ৪-৫ মাসের অভিজ্ঞতায় সেটা শেখা হয়৷ আইন পাঠেও পুরনো-অপ্রায়োগিক প্রচুর ব্যাপার আছে, দেশে প্রচলিত নয় এমন অনেক বিষয় অকারণে কোর্সভুক্ত৷ টর্ট আইন কি বাংলাদেশে আছে? কিংবা রোমান আইন৷ অথচ সেগুলোর নাম্বার দিব্যি যোগ হয়ে একজনকে ফার্স্ট ক্লাস পর্যন্ত পাইয়ে দেয়৷ সময় বোধ হয় এসেছে পুরো বিষয়টা নিয়ে একটা সামগ্রিক ভাবনার৷ আচ্ছা, উচ্চ আদালতের মতো নিম্ন আদালতেও কি বিচারক হওয়ার জন্য অন্তত ৩-৫ বছর আইনজীবী হিসাবে অভিজ্ঞতা বাধ্যতামূলক করা যায় না!
বিশ্লেষক-বিশেষজ্ঞরা ভাববেন নিশ্চয়ই৷ আমি অভিজ্ঞতা থেকে আরেকটা গল্প বলি৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিকে পরিচিত একজনের প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে একটা মামলার খোঁজ নিতে গেছি৷ পাশে বসে আমাদের কাণ্ড কারখানা গভীরভাবে খেয়াল করছিলেন এক আইনজীবী৷ একসময় ডাকলেন৷ ভাবলাম, অল্পবয়সি অর্বাচীনদের অসহায়ত্ব দেখে বোধহয় মায়া হয়েছে৷ সহযোগিতা করতে চান৷
‘ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন আগে?’
‘জি না৷’
‘এখানে মামলার কিছু নিয়ম-কানুন আছে৷’
‘কী নিয়ম কানুন?’
‘মামলা জিততে হলে সরকারি আইনজীবীকে হাত করতে হয়৷’
‘হাত করতে হয়...কীভাবে?’
‘বয়স কম তো৷ কিছুই বুঝেন না৷ টাকা দিতে হয় আর কী?’
‘আমাদের এই মামলায় সরকারি আইনজীবী কে?’
‘আমি’
‘আপনি?’
‘হ্যাঁ৷ আমাকে কিছু দিন৷ আমি বাধা দেব না৷ মামলা জিতে যাবেন৷’
ঘুস দেয়ার হাত থেকে বাঁচতেই সম্ভবত পরিচয় দিলাম, ‘আমরা আইনে পড়ি৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে...’
এতে তার একটু দ্বিধা করার কথা৷ তিনি করলেন অন্য কাজ৷ বললেন, ‘তাহলে কিছু কনসেশন পাবেন৷’
আমরা স্তম্ভিত৷ এদেশে পাথরও ঘুস চায় জানি কিন্তু এত প্রকাশ্যে, এমন বীরের মতো ঘুস খাওয়ার আবদার আর কোথাও শুনিনি৷
প্রাসঙ্গিক কি না জানি না তবু বলে রাখি সঙ্গে থাকা বন্ধুটি আজ সর্বোচ্চ আদালতের প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী৷ মাঝে মধ্যে এই অভিজ্ঞতা নিয়ে হাসাহাসি করি৷
কিন্তু এখন আর বিষয়টা হাসাহাসিতে নেই৷ সিরিয়াস দিকে চলে যাচ্ছে৷ দেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত নৈতিক স্খলনের দায়ে অভিযুক্ত৷ বিচারিক আদালতে তো একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে৷
আগায়-গোড়ায়-লতায়-পাতায় সব জায়গায় ক্ষয়রোগের চিহ্ন৷ আইন আর বিচারের ফাঁকটা এত বড় হচেছ যে সেটা না হাঙ্গরের হা হয়ে একদিন সবকিছু গিলে নেয়৷