1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আত্মহত্যার দায় কার?

৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাংলাদেশে অল্প সময়ের ব্যবধানে কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনা মানুষকে নাড়া দিয়েছে৷ আর সর্বশেষ চট্টগ্রামে এক চিকিৎসকের আত্মহত্যা নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা৷ এই ঘটনায় তার স্ত্রী এখন কারাগারে৷ তাই প্রশ্ন উঠেছে আত্মহত্যার দায় কার?

https://p.dw.com/p/3Ce23
ছবি: vkara - Fotolia.com

চট্টগ্রামে চিকিৎসক মোস্তফা মোরশেদ আকাশের আত্মহত্যার প্ররোচনার দায়ে তার স্ত্রী তানজিলা হক চৌধুরী মিতু এখন কারাগারে৷ মিতু নিজেও একজন চিকিৎসক৷ এই ঘটনায় আরো ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে৷ আকাশ ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন৷ সেখানে কিছু ছবি আর ভিডিও আপলোড করেছেন৷ তার এই পোস্ট থেকে আত্মহত্যার কারণ প্রাথমিকভাবে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক বলে ভাবা হচ্ছে৷

এই মাসেই সিলেটে আত্মহত্যা করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও প্রযুক্তি (জিইবি) বিভাগের শিক্ষার্থীর মো. সাইফুর রহমান প্রতীক৷ তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল বিভাগের ২০১১-১২ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন৷ শিক্ষকের অবহেলা, কম নাম্বার দেয়া এবং তাকে মাস্টর্সে কোর্স সুপারভাইজার না দেয়াকে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে বলছেন এই মেধাবী শিক্ষার্থীর  পরিবারের সদস্যরা৷

আর আমরা  ভিকারুননিসা স্কুলের শিক্ষার্থী অরিত্রি  অধিকারীর আত্মহত্যা নিয়ে তো সারাদেশে তোলপাড় হয়েছে৷ এক শিক্ষক কারাগারে গেছেন৷ অধ্যক্ষ সামায়িক বরখাস্ত হয়েছেন এর জের ধরে৷ গত ডিসেম্বরে পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন নেয়ার অভিযোগে অরিত্রির বাবাকে শিক্ষকদের অপমানের জের হিসেবে সে আত্মহত্যা করে৷

তাজুল ইসলাম

আরো উদাহরণ দেয়া যায়৷ তবে এই তিনটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই অনেক কিছু স্পষ্ট হবে৷ জাতীয় মানমিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রথম ঘটনায় সম্পর্কের টানাপোড়েন অথবা সম্পর্কের প্রতি আস্থাহীনতা, দ্বিতীয় ঘটনায় শিক্ষা ব্যবস্থা বা কোনো  শিক্ষকের অবহেলা এবং তৃতীয় ঘটনায় অপমান সইতে না পারাকে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়৷ কিন্তু দায় কার তা নির্নয় করা কঠিন৷ কারণ এই একই ধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে অনেকেইতো আত্মহত্যা করেন না৷ এরচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেও অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন না৷''

তিনি বলেন, ‘‘একটি মানসিক পরিস্থিতিতে কেউ আত্মহত্যা করেন৷ আবার কেউ করেন না৷ যিনি হতাশায় শূন্য হয়ে যান৷ মনে করেন জীবন অর্থহীন৷ জীবনের কোনো মানে থাকেনা তার কাছে সে আত্মহত্যা করতে পারে৷ এটা অনেকটা মানসিক গঠনের ওপরও নির্ভর করে৷''

তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘তবে আমাদের সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যেই আত্মহত্যার কারণ বিদ্যমান৷ কে কোন পরিস্থিতি চরম হতাশ হয়ে জীবনকে অর্থহীন মনে করবে তা বলা মুশকিল৷ চরম শূন্য বোধই এর কারণ৷ এই যে পারিবারিক কারণ, বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা উঠে এল এর বাইরেও সমাজে ও রাষ্ট্রে নানা অসঙ্গতি আছে যা আত্মহত্যার পিছনে কাজ করে৷ মাদকাসক্তিও আত্মহত্যার কারণ৷''

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা'র (হু)  তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতিবছর ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে৷ প্রতিদিন এই সংখ্যা দুই হাজারেরও বেশি৷ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে বিশ্বের কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ আত্মহত্যা করছে৷ প্রতি একজনের আত্মহত্যা প্রায় ২৫ জনকে আত্মহত্যা প্রবণতার দিকে নিয়ে যায়৷ বিশ্বে  ১৫-২৯ বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ আত্মহত্যা৷

বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করে৷ যাঁরা আত্মহত্যা করেছেন বা চেষ্টা করেছেন, তাঁদের বড় অংশের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে৷

২০২০ সাল নাগাদ বিশ্বে প্রতিবছর সাড়ে ১৫ লাখ মানুষ আত্মঘাতী হবেন৷ আত্মহত্যার চেষ্টা চালাবেন এরও ১০ থেকে ২০ গুণ মানুষ৷

আত্মহত্যার প্রবণতা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বেশি৷ বাংলাদেশও আত্মহত্যাপ্রবণ একটি দেশ৷

জিয়া রহমান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আত্মহত্যার ক্ল্যাসিকাল কারণগুলোর বাইরে বাংলাদেশে নতুন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ মানবিক এবং সামাজিক সম্পর্কের নতুন ধারা এবং  মাত্রা আমাদের সমাজে প্রবেশ করছে৷ অন্য সমাজে যা স্বাভাবিক আমাদের এখানে তা স্বাভাবিক নয়৷ ফলে এক ধরণের মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে৷ যা  কাউকে কাউকে গভীর হতাশায় নিমজ্জিত করে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করছে৷ সমাজে অর্থনেতিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আসছে৷ দারিদ্র্য যেমন আত্মহত্যার কারণ হতে পারে তেমনি ধন সম্পদও হতে পারে৷ কোটি টাকার লটারি জিতেও কেউ আত্মহত্যা করতে পারেন৷''

তিনি বলেন, ‘‘সামাজিক সংহতি যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে ব্যক্তি বিচ্ছিন্নতায় ভোগে৷ বিচ্ছিন্নতা থেকে চরম হতাশা৷ তাইতো শেয়ার বাজারে পুঁজি হারিয়ে কেউ আত্মহত্যা করেন৷''

ড. জিয়া বলেন, ‘‘গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে প্রধানত সম্পর্কের নতুন মাত্রা যুক্ত হওয়া, আকাশ সংস্কৃতির কারণে মূল্যবোধে বিচ্ছিন্নতার উপাদান যুক্ত হওয়া এবং মনোজগতে জঙ্গিবাদসহ আরো কিছু মতাদর্শ যুক্ত হওয়া আত্মহত্যার প্রধান কারণ৷''

মানসিক শক্তি এবং জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা এই আত্মহত্যা ঠেকাতে পারে৷ ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘পরিবার প্রথমেই বুঝতে পারে আত্মহত্যার প্রবণতার কথা৷ তাই তাদের মানসিক শক্তি যোগানো , জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করা পরিবারের সদস্যদেরই কাজ৷ আর সমাজ ও রাষ্ট্র এমন হতে হবে যেখানে হতাশার উপাদান কম থাকবে৷ যত কম থাকে ততই ভালো৷''

জিয়া রহমান বলেন, ‘‘হতাশা, চাপ  জীবনে থাকবেই সেটাকে জয় করতে হবে৷ জীবনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখার পরিবেশও তৈরি করতে হবে৷''