আদুরি ‘আপোষ' করেনি
১৮ জুলাই ২০১৭২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর যখন শিশু গৃহকর্মী আদুরিকে রাজধানীর পল্লবী ডিওএইচএস এলাকার একটি ডাস্টবিনে পাওয়া যায়, তখন তার সারা শরীরে ক্ষতচিহ্ন৷ নির্যাতনের অসংখ্য রেখা৷ শরীরে কাটা ও পোড়া দাগ৷ প্রায় চার বছর পরও সেই দাগ মুছে যায়নি৷ ডয়চে ভেলের প্রতিবেদকের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় তার শিশু কণ্ঠে ছিল উচ্ছ্বলতা৷
কেমন আছো আদুরি?
- ভালো৷ আপনি কেমন আছেন?
ভালো৷ কী করছ?
- নাশতা করি৷
কার সঙ্গে থাকো গ্রামে?
- মায়ের সঙ্গে৷
পড়াশোনা করো?
- করি৷
আদুরির বয়স এখন ১৪ অথবা ১৫৷ পটুয়াখালির পূর্ব জৈনকাঠি গ্রামে থাকে৷ পড়ে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায়৷ তার কচি মন থেকে এতদিনেও মুছে যায়নি নির্যাতনের সেই দুঃস্বপ্নগুলো৷ তাই ঘুমের মধ্যে প্রায়ই চিৎকার করে ওঠে৷ তার মা সাবিহা জানালেন সেই কথা৷ ‘‘আদুরি কান্নাকাটি করে৷ এখনো রাতে চিৎকার দেয়৷ শরীরের মধ্যেও যন্ত্রণা করে খুব৷''
ঢাকার ৩ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জয়শ্রী সমাদ্দার মঙ্গলবার আদুরির মামলার রায় ঘোষণা করেন৷ আসামি গৃহকর্ত্রী নদীকে যাবজ্জীবন কারাদাণ্ডের পাশাপাশি এক লাখ টাকা জরিমানা করেন৷ ওই অর্থ আদায়ের পর তা আদুরিকে দিতে হবে৷ আর জরিমানা দিতে ব্যর্থ হলে আরও এক বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে তাঁকে৷ নদীর মা ইশরাত জাহানও এ মামলার আসামি ছিলেন৷ তবে অপরাধে তাঁর সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁকে খালাস দিয়েছেন বিচারক৷
আদুরির মা জানালেন, পরিবারের বাকিরা এবং গ্রামের লোকেরা সবাই তাঁকে সাহস যুগিয়েছে৷ সহযোগিতা করেছে৷ এই বিচারে তিনি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন৷ ‘‘আমি খুশি, খুব খুশি৷''৷ টেলিফোনে ডয়চে ভেলেকে বলছিলেন তিনি৷
আদুরিরা আইনি সহযোগিতা পেয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির কাছ থেকে৷ সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী এই আদালতের এই রায়কে একটি মাইলফলক মনে করেন৷ কারণ আদুরির পরিবার ‘আপোষ' করেনি৷ ‘‘এ ধরনের মামলায় এক ভাগ বিচার হয়৷ বাকিরা আপোষ করে ফেলেন৷ কেউ চাপ দিয়ে, কেউ পয়সা দিয়ে ধামাচাপা দিয়ে দেন৷ তাই আমরা আইনি লড়াই লড়তে চাইলেও ঘটনার শিকার অনেকেই এসে বলেন, তারা আর মামলা লড়তে চান না৷'' মামলার রায় উচ্চ আদালতেও বহাল থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি৷
এই মামলার ক্ষেত্রে আদুরির পরিবারের একাগ্রতাই তাঁদের ন্যায়বিচার এনে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলে মনে করেন তিনি৷ একইসঙ্গে, সাক্ষীরাও তাঁদের অবস্থানে অটল ছিলেন৷
‘‘ভিকটিম ও সাক্ষী দু'জনই অনেক সময় দেখা যায়, চাপ ও অভাবের কাছে মাথা নত করে ফেলেন৷ এমনও হয়েছে খুনের মামলার আসামী ছাড়া পেয়ে গেছে শুধু এসব কারণে৷'' এক্ষেত্রে এমন কোনো ঘটনা না ঘটায় সন্তুষ্ট সালমা আলী৷ এছাড়া, মূল আসামীর জামিন না দেয়ার আদালতের সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেন এই আইনজীবী৷ তিনি বলেন, এর ফলে আসামীরা কোনো চাপও তৈরি করতে পারেননি৷ একইসঙ্গে গণমাধ্যমের ভুমিকারও প্রশংসা করেন৷ তবে এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতাও ভিকটিমদের বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয় বলে মনে করেন তিনি৷ ‘‘যেমন এই মামলার আইও (তদন্তকারী কর্মকর্তা) এক বছর ট্রেনিংয়ে ছিলেন, যার কারণে বিচার পেতে কিছুটা দেরি হয়েছে৷ এছাড়া অন্যান্য কারণেও দীর্ঘসূত্রিতা তো থাকেই৷''
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ বলছে, বাংলাদেশে নারী গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ৷ বিভিন্ন এনজিও প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, এই গৃহকর্মীদের একটা বড় অংশ নির্যাতনের শিকার৷ আইন ও শালিস কেন্দ্রের মতে, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৫ সালে মোট ৩২ জন গৃহকর্মী মারা গেছেন৷ এদের মধ্যে ২৩ জনের বয়স ১৮ কিংবা কম এবং ১৩ জনের বয়স ৭ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে৷ আর ২০১৬ সালে মারা গেছেন ৪০ জন গৃহকর্মী, যাদের মধ্যে ২৩ জনের বয়স ১৮ কিংবা কম৷ ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ লেবার স্টাডিজ' বা বিলস-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সারাদেশে অন্তত ১৮২ জন নির্যাতিত গৃহকর্মী মারা গেছেন৷ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আরও ১৪৩ জন৷
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলও গৃহকর্ম সম্পর্কিত কনভেনশন-১৮৯ গ্রহণ করে ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩ সালে৷ এ পর্যন্ত সর্বমোট ২৩টি সদস্য-দেশ এতে অনুসমর্থন দিলেও বাংলাদেশ সরকার এখনো দেয়নি৷ তবে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সফল করার জন্য ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, ২০১৫'-এর অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা৷ বাড়িতে গৃহকর্মীদের কাজের শর্ত ও নিরাপত্তা, ভালো কর্মপরিবেশ, পরিবারসহ মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের উপযোগী মজুরি এবং গৃহকর্তা-কর্ত্রী ও গৃহকর্মীর মধ্যে সুসম্পর্ক –এ সব বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়া আছে এই নীতিমালায়৷ এছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানেও এ বিষয়ে আছে নির্দেশনা৷ অনুচ্ছেদ ১৪, ২০, ২৭ ও ৩৪ অনুযায়ী, শোষণ থেকে মুক্তি, কর্মানুযায়ী অধিকার, মর্যাদা ও পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা এবং জবরদস্তি কাজ করানো – এ সব বিষয়ে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা আছে৷ কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এগুলোর বাস্তবায়নে তেমন কোনো আগ্রহ নেই৷ বরং সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও প্রায়ই এ সব নির্যাতন চালানোর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে৷ এক ক্রিকেটারের নাম উল্লেখ করে সালমা আলী বলেন, ‘‘তাঁকে শুধু তিন মাসের জন্য জেল খাটাতে পেরেছি৷ কিন্তু এরপর তিনি অনেক টাকা খরচ করেছেন৷ পরে আর মামলা এগুতে পারিনি৷''
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পুলিশের ‘মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স' বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, ঘটনা থেমে নেই৷ যখন একাধিক ঘটনা কাছাকাছি সময়ে ঘটে, তখনই এগুলোতে মানুষ সোচ্চার হয়৷ কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে এ সব ঘটনা ঘটছে৷ ‘‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নেই৷'' ডয়চে ভেলেকে টেলিফোনে বলছিলেন তিনি৷ তবে আপোষ বা সমঝোতা করার মানসিকতাও আইনি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা বলে মনে করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা৷ ‘‘সবাই আপোষ করেন না৷ অনেকে মামলাই করেন না৷ আর আপোষ করার পর আদালত যদি তা মেনে নেন তাহলে তদন্তকারী সংস্থা হিসেবে পুলিশের কিছু করার নেই৷''
তবে এ ধরনের মামলার তদন্তে দীর্ঘসূত্রিতার সুযোগ খুব কম বলে দাবি করেন তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘বেশিরভাগ মামলা হয়, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে৷ এ সব মামলায় তদন্তের সময়সীমা থাকে৷ তাই তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রশিক্ষণে গেলে কিংবা মারা গেলে বা অন্য কোনো কারণে অনুপস্থিত থাকতে হলে মামলার তদন্তের ভার আরেকজনের ওপর ন্যস্ত করা হয়৷''
মাসুদুর রহমানের মতে, শুধু আইন দিয়ে এ ধরণের অপরাধ ঠেকানো যাবে না৷ ‘‘এটি আসলে নৈতিকতার ব্যাপার৷ আইন দিয়ে এ সমস্ত অপরাধ ঠেকানো কঠিন৷ অন্য আরেকজন মানুষকে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দেয়ার মানসিকতা তৈরি না হলে এটি ঠেকানো যাবে না৷''
অ্যাডভোকেট সালমা আলী মনে করেন, আদুরির মামলাটির মতো আরো দৃষ্টান্ত তৈরি করা জরুরি৷ তাহলে মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে এবং এ ধরনের নির্যাতন কমবে৷
সবাই হয়ত আদুরির পরিবারের মতো সাহসী নন৷এমন অনেক আদুরি আছে, যারা হারিয়ে যায় আপোষের কাছে৷ তাই আদুরির ‘আপোষহীনতা' একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, বলে মত সালমা আলীর৷