আফগানদের কাছে পরাজয়ে পাগলাঘণ্টি
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯এমন নয় যে, পরাজয়ের সঙ্গে সেভাবে পরিচয় নেই বাংলাদেশের৷ যতটা হার, তার চেয়ে বেশি জয় তো গেল কয়েক বছরের চিত্র মাত্র৷ ক্যানভাসের পুরো ছবিটায় বরং পরাজয়ের আঁকিবুকিই বেশি৷ আফগানদের বিপক্ষে এই ম্যাচের আগে ৮৫ টেস্ট হেরেছে; হেরেছে ২৪১ ওয়ানডে এবং ৫৭ টি-টোয়েন্টি৷ তবে সাকুল্যের এই ৩৮৩ আন্তর্জাতিক ম্যাচ হারের কোনোটিই এমন সতর্কঘন্টা বাজাতে পারেনি, যতটা পাগলাঘন্টি বাজাচ্ছে রশিদ খানের দলের কাছে টেস্ট হারে৷ বাংলাদেশ ক্রিকেটের হর্তাকর্তারা তা আমলে আনছেন কিনা, সেটি অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ৷
আর যদি আমলে না আনেন, তাহলে তো দেশের ক্রিকেটেরই চোরাবালিতে তলিয়ে যাবার আশঙ্কা৷
একটি মাত্র ম্যাচ হারে এমন আতঙ্ক বাড়াবাড়ি ঠেকতে পারে৷ কিন্তু আফগানিস্তানের কাছে টেস্টকে ‘শুধু একটি ম্যাচ হার' হিসেবে দেখার উপায় নেই যে! বছরের শুরু থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দুঃস্বপ্নের গহবরে৷ নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়ে যাচ্ছেতাই পরাজয় সব ম্যাচে৷ আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের ট্রফি জয় একটু আলোর রেখা দেখায় বটে৷ তাতে অন্ধকার লেপ্টে দেয় বিশ্বকাপের বিবর্ণ পারফরম্যান্স৷ এরপর শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ধবলধোলাই৷ তারপর আফগানদের বিপক্ষে টেস্ট হার৷
এটিকে তাই বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ কোথায়!
আফগানিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচের আবহে এমন কিছুর শঙ্কা অবশ্য কারোই ছিল না৷ নতুন কোচ রাসেল ডমিঙ্গো হয়তো নিজেকে খানিকটা ভাগ্যবানই ভাবছিলেন৷ কারণ তাঁর আগের দুজন স্থায়ী কোচ চন্দিকা হাতুরাসিংহে এবং স্টিভ রোডসের প্রথম সিরিজ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে৷ তুলনায় ঘরের মাঠে আফগানরা তো সহজ প্রতিপক্ষ৷ টেস্ট বলে তা আরো সহজ! মাত্রই দুটো টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতাই ওদের সম্বল৷ সে পুঁজি নিয়েই যে বাংলাদেশ ক্রিকেটের দেউলিয়াত্ব এভাবে প্রকাশ করে দেবে রশিদ খানের দল, সেটি ডমিঙ্গো নিশ্চয়ই ভাবতেই পারেননি৷ অন্য কেউও না!
টেস্টের আগে থেকেই উইকেট নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা৷ বছর তিনেক হল নিজেদের মাঠে প্রবল স্পিনিং উইকেট বানিয়ে সাফল্যের ‘চোরাপথ' খুঁজে নেয় বাংলাদেশ৷ সেভাবেই হারায় ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতো পরাশক্তিদের৷ যাঁদের কারোই বোলিং আক্রমণের মূল শক্তি স্পিন নয়৷ আফগানিস্তানের মূল শক্তি স্পিন৷ রশিদ-নবী-কায়েস-জহিরের বিপক্ষে কেমন উইকেট বানানো হবে, এ নিয়ে সেজন্য চলে বিস্তর গবেষণা৷ শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রামে যে ২২ গজে খেলা হয়েছে, তাতে সন্তুষ্ট নন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান৷ এটি নাকি যথেষ্ট স্পিনিং উইকেট না৷ ওদিকে টেস্টের মাঝপথেই বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান অবধারিত পরাজয়ের সামনে দাঁড়িয়ে উইকেট নিয়ে উগড়ে দেন নিজের ক্ষোভ৷ এটি নাকি স্পিনিং উইকেট৷ স্পিননির্ভর আফগানদের বিপক্ষে এমন উইকেটে খেলার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি৷
দুজনের বিপরীতমুখী দাবির পরও এ সত্য পাল্টায়নি যে, উইকেট দুই দলের জন্যই সমান৷ হ্যাঁ, টস জিতে আফগানেরা এগিয়ে গেছে বটে৷ কিন্তু নিজেদের তৈরি করা ফাঁদে পড়ার এ আশঙ্কা নিয়েই তো এমন উইকেট তৈরির চর্চায় গিয়েছে বাংলাদেশ৷ ঘরের মাঠে আগের ১০ টেস্টের যে পাঁচটিতে জেতে, এর সবগুলোর পূর্বশর্তে স্বাগতিক অধিনায়কের টস জয়ের বাধ্যবাধকতা৷ এবার জেতেননি বলে টেস্টের প্রথম বল গড়ানোর আগেই যেন ম্যাচ থেকে গড়িয়ে ছিটকে যাবার দশা বাংলাদেশের৷
সেই মাঠের ক্রিকেটটাও সাকিবের দল খেলেছে যাচ্ছেতাই৷ আফগান স্পিন চতুষ্টয়ের বিপক্ষে রীতিমতো অসহায় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা৷ বাংলাদেশের চার স্পিনার আবার প্রতিপক্ষ ব্যাটিং লাইনকে ততটা ভোগাতে পারেনি৷ যে কারণে ম্যাচে আফগানেরা একটি সেঞ্চুরির পাশাপাশি করে চারটি ফিফটি; যার মধ্যেও ৯২ ও ৮৭ দুটি ইনিংস প্রায়-সেঞ্চুরি! আর দুই ইনিংস মিলিয়ে বাংলাদেশের একটি মাত্র পঞ্চাশ পেরোনো ইনিংস৷ তা-ও মোটে ৫২ রানের!
তুলনামূলক অচেনা টেস্ট ক্রিকেটে আফগানরা নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে কী দারুণভাবে! বিপরীতে খেই হারিয়ে খাবি খাবার দশা বাংলাদেশের৷ অতিথি অধিনায়ক রশিদ খান ম্যাচে ১১ উইকেট নেবার পাশাপাশি ব্যাটিংয়ে প্রথম ইনিংসে করেন গুরুত্বপূর্ণ ফিফটি৷ আবার স্বাগতিক অধিনায়ক সাকিব আল হাসান হয়ে থাকেন অবিমৃশ্যকারিতার চূড়ান্ত উদাহরণ৷ শেষ দিনের শেষ বিকেলের ওই শটের কারণে৷
পুরো টেস্টে বাজে খেলা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সামনে ড্রয়ের সুযোগ আসে বৃষ্টির দাক্ষিণ্যে৷ শেষ বেলায় চার উইকেট নিয়ে ১৮.৩ ওভার টিকে থাকলেই হত! সাকিব করলেন কী, নেমে অফ স্ট্যাম্পের অনেক বাইরের প্রথম বলেই মারতে গিয়ে আউট! যেন সেটি চার বা ছক্কা হলেই জিতে যাবে বাংলাদেশ! যেন ওভারপ্রতি ১৩.৯৩ রান করে নিয়ে ১৮.৩ ওভারে ২৫৫ রান করে ফেলবে দল! অন্যরা অধিনায়কের অনুগামী হয়ে ঐতিহাসিক এক জয় আফগানিস্তানকে উপহার দেয় বাংলাদেশ৷ নিজেরা ঐতিহাসিক পরাজয়ের শিকার হয়ে৷
ম্যাচের আগ-পরের ছয় দিনের মধ্যে চার দিনই সংবাদ সম্মেলনে আসেন অধিনায়ক সাকিব৷ অহেতুক নয়৷ তিনি যে টেস্ট অধিনায়ক থাকতে চান না, সে বার্তা স্পষ্ট করে দেবার জন্যই হয়তো-বা৷ ওদিকে বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান ফল নিয়ে নিজের ক্রোধের কথা জানিয়েছেন৷ চারিদিকে তাই নানা কথা; হরেক গুঞ্জন৷ রীতিমতো হ-য-ব-র-ল অবস্থা৷ সামনে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের আগে যদি সবার সুর না মেলে, তাহলে অসুর ভর করবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ওপর৷
আফগানিস্তানের কাছে টেস্ট হার হয়তো সেটির কেবল শুরু!