1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আমলাতন্ত্র : সেবায় কৃপণ, ঔদ্ধত্যে উদার?

১৪ অক্টোবর ২০২২

সম্প্রতি ডিসি-এসপিরা কি নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতার দৌরাত্ম্য দেখালেন? আর সেই দৌরাত্ম্যে ক্ষুব্ধ হয়ে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান অফিসে যাওয়াই বন্ধ করে দিলেন? আমলাদের এমন ক্ষমতা এবং ক্ষমতার দৌরাত্মের কারণ কী?

https://p.dw.com/p/4ICaH
বাংলাদেশ সচিবালয়
বাংলাদেশ সচিবালয়ছবি: bdnews24.com

গাইবান্ধা-৫ উপ-নির্বাচনেও তারা ক্ষমতা দেখিয়েছেন৷ নির্বাচন কমিশনকে তাদের সহযোগিতা করার আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও তারা সহযোগিতা করেননি৷ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভাষায় ভোট কেন্দ্রে ‘ডাকাত’ ঢুকে যায়- যা থামানোর দায়িত্ব ছিল পুলিশ ও প্রশাসনের৷ সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ বলেন, ‘‘৮ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে ডিসি-এসপিরা শিয়ালের মতো একযোগে যা করেছে তা তো ঔদ্ধত্য৷ আর গাইবন্ধার উপ-নির্বাচনে তাদের অসযোগিতাও পরিষ্কার৷ সিসি ক্যামেরার অনেক লাইন কেটে দেয়া হয়েছে৷ পুলিশ বলবে, আমরা দেখিনি৷ তারা আসলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়৷ এটা অশনি সংকেত৷’’

তাদের এমন প্রবণতা তৃণমূল থেকে সব পর্যায়েই লক্ষ্য করা যায়৷ সাধারণ মানুষ থেকে জনপ্রতিনিধি সবাই এর ভুক্তভোগী৷ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের সংগঠন উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন অর রশীদ বলেন, ‘‘আইন হয়েছে, সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে যে উপজেলার ১৭টি প্রশাসনিক বডির প্রধান হলেন উপজেলা চেয়ারম্যান৷ তারপরও ডিসিদের সহযোগিতায় ইউএনওরা তা ছাড়ছেন না৷ তারা ওই প্রতিষ্ঠানগুলো কুক্ষিগত করে রেখেছেন৷’’

নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে ডিসি-এসপিরা শিয়ালের মতো একযোগে যা করেছে তা তো ঔদ্ধত্য: মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শেখ ইউসুফ হারুন মনে করেন, এই সরকারের আমলে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা শতভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ কিন্তু তাদের সেবার মান বাড়েনি৷ তার কথা, ‘‘সমাজে যখন সব ক্ষেত্রেই বিশৃঙ্খলা, তার প্রভাব প্রশাসনেও আছে৷ নির্বাচন কমিশনের সভায় তারা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা শৃঙ্খলা-বিরোধী৷’’

বেতন-ভাতা আর সুবিধায় শীর্ষে

বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন ১০ বছরে দুই গুণেরও বেশি বেড়েছে৷ সুযোগ-সুবিধাও অনেক৷ তারা এখন বাড়ি-গাড়ির জন্য বলতে গেলে বিনা সুদে ঋণ পান৷ পদোন্নতি, বিদেশে প্রশিক্ষণ, মোবাইল ফোন কেনা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ, অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারে নমনীয়তাসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন তারা৷ এখন বাংলাদেশে যে-কোনো পেশার চেয়ে সরকারি চাকরি তাই আকর্ষণীয়৷ আর ক্ষমতার হিসাব করলেও তো তাদের ধরা বা ছোঁয়া যায় না৷ তাই শুধু নির্বাচন কমিশনে কেন, উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত তাদের ক্ষমতার দৌরাত্ম্য দেখার মতো৷ জন প্রতিনিধিরাও তাদের কাছে এখন আর গুরুত্ব পান না৷

বেতন-ভাতা বৃদ্ধি

২০১৫ সালে সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারিদের মূল বেতন গ্রেড ভেদে ৯১ থেকে ১০১ শতাংশ বাড়ানো হয়৷ ২০১৮ সালের নতুন কাঠামো অনুযায়ী, প্রথম গ্রেডে সর্বোচ্চ মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা আর ২০তম গ্রেডে সর্বনিম্ন মূল বেতন আট হাজার ২৫০ টাকা৷ আগে সরকারি কর্মচারীরা সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা ও সর্বনিম্ন চার হাজার ১০০ টাকা মূল বেতন পেতেন৷ সরকারি কর্মকর্তাদের বর্তমান মূল বেতনের সঙ্গে ভাতা এবং সুযোগ-সুবিধা অনেক৷ ঢাকা সিটি এলাকায় বাড়ি ভাড়া দেয়া হয় মূল বেতনের শতকরা সর্বোচ্চ ৬৫ ভাগ৷ আর ঢাকার বাইরে ৫৫ ভাগ৷

নির্বাচন কমিশনের সভায় তারা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা শৃঙ্খলা-বিরোধী: শেখ ইউসুফ হারুন

বাড়ি-গাড়ির সুবিধা

আগে শুধু যুগ্ম সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তারা গাড়ির সুবিধা পেতেন৷ ২০১৯ সাল থেকে উপসচিবরাও গাড়ির জন্য সরকার থেকে সুদমুক্ত ৩০ লাখ টাকা করে ঋণ পাচ্ছেন৷ একই সঙ্গে পাঁচ শতাংশ সুদে সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকার গৃহঋণ পাচ্ছেন তারা৷ তবে চাকরিরত অবস্থায় কোনো সরকারি কর্মচারি মারা গেলে ওই কর্মচারির উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে সরকার গৃহঋণের টাকার আসল, সুদ ও দণ্ড সুদ কিছুই ফেরত নেবে না৷ কোনো কর্মচারি পঙ্গু হয়ে অবসরে গেলেও একই সুবিধা পাবেন৷ যেসব অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পেনশনের পুরো টাকা তুলে নিয়েছেন, অবসরের তারিখ থেকে ১৫ বছর পার হলে তাদেরও মাসিক ভিত্তিতে আবার পেনশন দেবে সরকার৷ শুধু তাই নয়, প্রতি বছর পাঁচ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্টও পাবেন তারা৷

দুর্নীতি দমন কমিশনের ১০ম থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত কর্মচারিদের মাসিক ঝুঁকি ভাতা এবং পুলিশ পরিদর্শকদের জন্য ‘বিশেষ ভাতা’ চালু আছে৷

ফোন, ইন্টারনেট, পিয়ন, বাবুর্চি, এসি

মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সব সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের বাসায় আগে বাবুর্চি ও নিরাপত্তা প্রহরী থাকলেও এখন বাবুর্চি ও নিরাপত্তা প্রহরীর বদলে সচিবেরা এখন ১৬ হাজার করে প্রতি মাসে মোট ৩২ হাজার টাকা ভাতা পান৷ সচিবদের জন্য ৭৫ হাজার টাকা করে মোবাইল ফোন কেনা এবং ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ হিসেবে মাসে ৩ হাজার ৮০০ টাকা করে বিল দেয় সরকার৷

একজন সচিব প্রয়োজন অনুযায়ী শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) পান এবং অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব এবং সিনিয়র সহকারি সচিব ও সহকারি সচিব অফিসে একটি করে এসি ব্যবহার করতে পারেন সরকারি খরচে৷

দায়িত্ব ও ক্ষমতা

জেলার ডিসিরা জেলার প্রশাসন, রাজস্ব, বিনোদন, উন্নয়ন, জেলখানা থেকে শুরু করে ৬২টি বিষয় দেখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত৷ ‘অন্যান্য’ বলতে একটি বিষয়ও তার মধ্যে রয়েছে৷ ফলে তাদের দায়িত্বের বাইরে কিছু নেই৷ ডিসি আইন-শৃঙ্খলা কমিটিরও সভাপতি৷ একই সঙ্গে তিনি জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট৷ ফলে তার দায়িত্বের বাইরে তেমন কিছু নেই৷ আর এটাই আবার ডিসিদের ক্ষমতার উৎস৷

আর ইউএনওরা উপজেলা পর্যায়ে একই ধরনের দায়িত্বে রয়েছেন, যা তার ক্ষমতার উৎস৷ উপজেলা চেয়ারম্যানদের আইন করে উপজেলায় ১৭ ধরনের সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান করা হলেও তাদের তাদের সে ক্ষমতা ইউএনওরা না দিয়ে কুক্ষিগত করে রেখেছেন বলে অভিযোগ৷ ইউএনওদের ৭২ ধরনের দায়িত্বের মধ্যে পাবলিক পরীক্ষাও রয়েছে৷ তারা উপজেলার প্রধান নির্বাহী৷ এগুলো তাদের ক্ষমতাবানও করেছে৷ ডিসি ইউএনওদের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতাও আছে৷ ইউএনও একজন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটও৷

সিআরপিসির ১৯৭ ধারায় সরকারি কর্মকর্তারা সরকারি দায়িত্ব পালকালে কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত হলে সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো আদালত সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নিতে পারে না৷ কোন আদালতে এই মামলার বিচার হবে, তা সরকার নির্ধারণ করে দেয়৷ তারপরও  ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’ নামে একটি আইন করে তাদের গ্রেপ্তারের আগে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার বিধান করা হয়৷ যদিও সম্প্রতি উচ্চ আদালত বলেছে, এই অনুমতির প্রয়োজন নেই৷ তবে উচ্চ আদালতের এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে৷ ফলে আমলারা এক ধরনের দায়মুক্তি পান৷

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ মনে করেন, ‘‘এই আইনি কাঠামোর সঙ্গে তাদের এখনকার রাজনৈতিক ক্ষমতা তাদের দৌরাত্ম্য বাড়িয়ে দিয়েছে৷ সরকার তাদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করায় তারা রাজনৈকিভাবে ক্ষমতাবান হয়েছে৷ তারা এখন ক্ষমতাসীন এমপিদের সঙ্গে মিলেমিশে আরো ক্ষমতাবান হয়েছেন৷ তারা এখন ক্ষমতাসীনদের বাইরে কাউকে গুণছে না৷’’ তারপরও তারা সন্তুষ্ট নন৷ ডিসি-এসপিরা বিচারিক ক্ষমতাও চান৷

সংকট কোথায়?

সাবেক সিনিয়র সচিব শেখ ইউসুফ হারুন মনে করেন, সবখানেই এখন অধঃপতন৷ প্রশাসনও তার বাইরে নয়৷ এখন সরকারি কর্মকর্তারা অনেক ভালো জীবন যাপন করে৷ এই মূল্যস্ফীতির বাজারেও তারা যে বেতন পান, যে সুযোগ-সুবিধা পান তা তাদের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি৷ তারপরও তাদের অনেকের আচরণে উন্নতি নেই , সেবার মান কমছে৷ তারা অসহিষ্ণু আচরণ করছেন৷ তার কথা, ‘‘আইনের শাসনের অনুপস্থিতিও এর কারণ৷ ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ইসির সঙ্গে বৈঠকের পর একজন ইউএনও টেলিভিশনে মন্তব্য করেছিলেন৷ কিন্তু তখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়৷ এবার ইসির সঙ্গে বৈঠকে ডিসি-এসপিরা যে ভাষা ও স্টাইলে প্রতিবাদ করেছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়৷ তবে একজন নির্বাচন কমিশনার যে ভাষায় ঢালাওভাবে সবার ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন, তা-ও গ্রহণযোগ্য নয়৷ দুই পক্ষকেই সংযত হতে হবে৷’’ প্রসঙ্গত ওই নির্বাচন কমিশনারও একজন আমলা৷

সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, ‘‘ডিসি-এসপিরা এখন সব কিছু কুক্ষিগত করতে চায়৷ তাদের মানসিকতা এমন যে সব ক্ষমতা তাদের হবে৷ এই মানসিকতা সংকট তৈরি করেছে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘এই মানসিকতার কারণ আইন থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না৷ এখন নির্বাচন কমিশন কী করতে পারে? তারা রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে পারে৷ রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা না নিলে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার নেই৷ নির্বাচন কমিশন তো সরাসরি ব্যবস্থা নিয়ে কার্যকর করতে পারে না৷’’

আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘তারা তো মনে করে সরকার তারা চালায়৷ এমপি তারা বানিয়েছে৷ তাহলে তারা অন্যদের মানবে কেন? পুলিশ ও প্রশাসনকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের পরিণতি আমরা ভোগ করছি৷’’

আর উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন অর রশীদ বলেন, ‘‘ইউএনওরা সংসদের আইন মানছেন, প্রজ্ঞাপন মানছেন না৷ সেটা মানাতে এখন আমাদের উচ্চ আদালতে যেতে হয়েছে৷ তারা সবকিছু কুক্ষিগত করে রাখতে চায়৷ তাহলে দেশের মানুষের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন সহজেই বুঝতে পারছেন৷ তাদের এই কাজে আবার সহযোগিতা করছেন ডিসিরা৷ এটাই আমলাতন্ত্র৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য