আপনার জন্য কতজন দাস?
১৬ জুন ২০১৩কলম, সাবান এবং আমার সন্তানের জন্য ডায়পার্স৷ স্লেভারিফুটপ্রিন্ট ডটঅর্গ ওয়েবসাইটের সমীক্ষায় এই তিনটি বস্তু আমাকে উপরের দিকে নিয়ে গেছে৷ এই পণ্যগুলোতে ব্যবহৃত বিভিন্ন কাঁচামাল – উল, কয়লা এবং বিভিন্ন ধাতব পদার্থ – পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অমানবিক পরিবেশে বাছাই কিংবা উৎপাদন করা হচ্ছে৷ আমার দাসরা মূলত চীনে অবস্থান করলেও দক্ষিণ অ্যামেরিকা, ইউক্রেন, ইন্দোনেশিয়া এবং ভারতেও রয়েছে৷
স্লেভারিফুটপ্রিন্ট ডটঅর্গ ওয়েবসাইটটির পেছনে রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান৷ সাইটটির প্রতিষ্ঠাতা জাস্টিন ডিলন ধারণা করেন, গোটা বিশ্বে ২৭ মিলিয়নের মতো মানুষ কোনো ধরনের বেতন ছাড়া কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন৷ তাদেরকে অনেকে বলেন, বিনা বেতনে কাজ করতে বাধ্য শ্রমিক৷
ডিলন স্মার্টফোন, টি-শার্ট এক কফিসহ চারশোর মতো নিত্য ব্যবহার্য্য পণ্যের তালিকা তৈরি করেছেন৷ এরপর তিনি এসব পণ্যের গড় মূল্য নির্ধারণ করেছেন এবং ওয়েবসাইটটিতে এই মূল্যের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয় একজন মানুষের পেছনে কতজন দাস কাজ করছেন৷ আমার ক্ষেত্রে সংখ্যাটি ৬৮৷ সাইটটিতে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন প্রশ্ন যোগ করা হয়েছে এবং সমীক্ষার ফলাফল যাতে সহজে সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোতে ব্যবহার করা যায় সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে৷ উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই ইস্যুতে যত দ্রুত সম্ভব যত বেশি জনসচেতনতা সৃষ্টি করা৷
দয়া করে আরো বিস্তারিত তথ্য দিন
স্লেভারিফুটপ্রিন্ট ডটঅর্গ-এর কন্টেন্ট নিয়ে খানিকটা সমালোচনাও আছে৷ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ইস্যু নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান স্যুডভিন্ড এর সাবিনে ফেরেনশিল্ড ওয়েবসাইটে ব্যবহৃত ‘দাসত্ব' টার্মের সমালোচনা করেছেন৷ বিশেষ করে কিসের ভিত্তিতে এই টার্ম ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটি সাইটটিতে পরিষ্কারভাবে বিস্তারিত উল্লেখ নেই বলেই মনে করেন ফেরেনশিল্ড৷
তিনি বলেন, ‘‘এই ওয়েবসাইটটি অত্যন্ত কার্যকর হয়ে উঠতে পারে, যদি এটি আরো কিছু বিষয় যেমন নূন্যতম সামাজিক অবস্থান এবং গ্রহণযোগ্য বেতন যা (শ্রমিকদের ক্ষেত্রে) সচরাচর দেখা যায় না, সেসবের দিকে নজর দেয়৷''
আমি কি করতে পারি?
আমার পেছনে ৬৮ জন দাস কাজ করার সংখ্যাটি একেবার সঠিক না হলেও এটা সত্য যে, এই বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে ওয়েবসাইটটি৷ আমি যাতে আমার জীবনযাপন ঠিকভাবে অব্যাহত রাখতে পারি তা নিশ্চিত করতে বিশ্বের সব জায়গায় অমানবিক পরিস্থিতিতে কাজ করছে অনেক মানুষ৷ এর আগে আমার বিমানযাত্রার ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আমাকে সচেতন করেছিল কার্বনফুটপ্রিন্ট ডটকম৷ এবার অমানবিক কর্মপরিবেশ সম্পর্কে আমাকে সচেতন করেছে স্লেভারিফুটপ্রিন্ট ডটঅর্গ৷
ওয়েবসাইটটি এই সমস্যার এক সহজ সমাধান দিয়েছে৷ সেটি হচ্ছে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা এবং অর্থ দান করা৷ এটি আমাকে বিশেষ কোন পণ্য ব্যবহার থেকে দূরে থাকতে বলছে না৷ খাদ্য এবং ব্যবহার্য্য যেসব পণ্যের কথা সাইটটিতে উল্লেখ আছে সেগুলোর সঙ্গে কোনো ব্র্যান্ডের নাম নেই৷ তবে সাবিনে ফেরেনশিল্ড মনে করেন, সাইটটি যদি সেরকম কোনো সুপারিশ করেও তাতে খুব একটা উপকার হবে না৷ কেননা, ভোক্তা হিসেবে সৎ হওয়ার চেষ্টা করাটা বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার৷
সাপ্লাই চেইনে স্বচ্ছতার অভাব
অনেক প্রতিষ্ঠানই তাদের পণ্যের কাঁচামালের উৎস সম্পর্কে তেমন একটা জানে না৷ বাভারিয়ার ভূগোলবিদ সুসানে জর্ডান বিশ্বাস করেন, বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যবসার গতিপ্রকৃতি পরিবর্তনে বিশেষ আগ্রহী নয়৷ এজন্য তিনি নিজে সৎ উপায়ে একটি পণ্য তৈরির প্রকল্প গ্রহণ করেছেন৷ পণ্যটি হচ্ছে কম্পিউটার মাউস৷ এই প্রকল্প গ্রহণের পর জর্ডান বুঝতে পারেন, এরকম একটি সাধারণ পণ্য কত জটিল সাপ্লাই চেইন-এর উপর নির্ভরশীল৷
জর্ডান বলেন, ‘‘পণ্যটির বিভিন্ন অংশ জোড়া লাগানো, ঝালাই করা এবং কেসিং উৎপাদনের মতো কাজগুলো আমরা ন্যায্য উপায়ে করি৷ এটি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের দুই-তৃতীয়াংশ ন্যায্যভাবে সংগ্রহ করা হয়৷''
কিন্তু এই মাউসের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু উপকরণের উৎস সম্পর্কে এখনো জানতে পারেননি জর্ডান৷ তিনি বলেন, ‘‘এটির কিছু উপকরণ তৈরির জন্য কাঁচামালের প্রয়োজন হয়৷ এসব কাঁচামাল সম্পর্কে খুব কম তথ্যই পাওয়া যায়, কেননা অনেকক্ষেত্রে সরবরাহকারীরা বিস্তারিত জানাতে চান না, আবার কখনো কখনো এসব কাঁচামাল দালালদের কাছ থেকে কিনতে হয়, যারা নিজেরাও এসবের উৎস সম্পর্কে জানে না৷''
প্রশান্ত মূল্যায়ন
‘‘আমি ধারণা করি মাউসের ভেতরে ব্যবহৃত ধাতব টুকরাগুলো ন্যায়সঙ্গত উপায়ে সংগ্রহ করা হয়নি'', বলেন হতাশ জর্ডান৷ তাই বলে অবশ্য ন্যায্য উপায়ে মাউস তৈরি থেকে পিছিয়ে যেতে চাননা তিনি৷ একেবার শতভাগ ন্যায্য উপায়ে পণ্য তৈরি সম্ভব নয় বলেই মনে করেন তিনি, তবে কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছাতে চান৷ তাঁর তৈরি মাউস এখন বাজারে রয়েছে৷ কিন্তু একই ধরনের অন্যান্য পণ্যের তুলনায় এসবের দাম প্রায় দ্বিগুন৷
নেদারল্যান্ডসের একটি প্রতিষ্ঠানও জর্ডানের মতো একই উপায়ে কাজ করছে৷ চলতি গ্রীষ্মে প্রতিষ্ঠানটি বাজারে আনবে ফেয়ার ট্রেড স্মার্টফোন৷ এই প্রতিষ্ঠানও শতভাগ সৎ উপায়ে স্মার্টফোন তৈরি সম্ভব নয় বলেই মেনে নিচ্ছে৷ তাই তাদের নীতি হচ্ছে, ‘যতটা সম্ভব সৎ থাকা'৷
ফেরেনশিল্ডের উপসংহার হচ্ছে একমাত্র স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়াই এবং ন্যায্যভাবে পণ্য তৈরি সম্ভব৷ তিনি চান, সকল প্রতিষ্ঠান তাদের সাপ্লাই চেইন সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জনসম্মুখে উম্মুক্ত করে দিক৷ আর রাজনৈতিক চাপ ছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলো সেটা করবে না৷