আর্সেনিক নির্ণয়ে বায়ো-সেনসর
১ সেপ্টেম্বর ২০১২জার্মান গবেষকরা বায়ো-সেন্সর দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন৷ এই পরীক্ষা সুলভ মূল্যে করা যায় এবং বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ছাড়াই কাজে লাগানো যায়৷ কেননা এটি ব্যাকটেরিয়া দিয়ে করা হয়৷ জিন পরিবর্তন করা এইসব ব্যাকটেরিয়া পানিতে বিষাক্ত আর্সেনিক বের করার জন্য এক ধরনের জীব গোয়েন্দার মতো কাজ করে৷
ব্যাটেরিয়ার কৌশল
জার্মানির বিখ্যাত গবেষণা এসোসিয়েশন, ‘হেলমহোলটস সেন্টার ফর এনভারনমেন্ট'-এর মাইক্রোজীববিজ্ঞানী কারোলা এন্ডেস এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আর্সেনিককে সেল থেকে বের করে ফেলার জন্য ব্যাকটেরিয়াগুলি এক ধরনের কৌশলের আশ্রয় নেয়৷ কেননা আর্সেনিক ব্যাকটেরিয়ার জন্যও বিষাক্ত৷ ব্যাকটেরিয়ার এই কৌশলটা ব্যবহার করতে চান এখন গবেষকরা৷ লক্ষ্য করা গেছে, জিন পরিবর্তন করা আইকলি ব্যাকটেরিয়ারা আর্সেনিকের সংস্পর্শে এলেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে৷''
গবেষণা কেন্দ্রের ভূতত্ববিদ জিগফ্রিড পানির নতুন নতুন নমুনা সংগ্রহ করতে ব্যস্ত৷ এই পরীক্ষার জন্য যে সব টিউবওয়েলকে নেয়া হয়েছে, সেগুলির বয়স, গভীরতা ও অবস্থানও বিভিন্ন রকমের৷ জিগফ্রিড বলেন, ‘‘এখন টিউবওয়েলগুলির অবস্থান বের করার চেষ্টা করছি আমরা, যাতে পরে বলা যায়, কোনো কোনো এলাকায় কোনো কোনো টিউওয়েলে আর্সেনিকের প্রাবল্য রয়েছে৷''
নোয়া পাড়ার অধিকাংশ পরিবারের নিজস্ব টিউব ওয়েল রয়েছে৷ পুকুরের পানির বিকল্প হিসাবে৷ আগে পুকুরের পানি পান করে এখানকার মানুষের কলেরা ও টাইফয়েডের মতো অসুখ বিসুখ হতো, তাই এই টিউব ওয়েল৷ কিন্তু অন্যদিকে অনেক টিউওয়েলের পানিতে রয়েছে বিপজ্জনক আর্সেনিক৷
গ্রামের এক বাসিন্দা আলেয়া বেগম বলেন, ‘‘আমার শ্বশুর ছয় বছর আগে আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় মারা গেছেন৷ এর পর আমি টিউবওয়েলের পানি পরীক্ষা করতে দিয়েছিলাম কিন্তু ফলাফল পাইনি৷ এখন আমরা জানিনা কী করা উচিত৷''
এশিয়ার অনেক দেশে মাটিতে আর্সেনিক থাকে৷ ভূগর্ভস্থ পানিতে মিশে যায়৷ টিউবওয়েল দিয়ে তা ওপরে তোলা হয়৷ পরিবেশের এই বিষে মানুষের নানা রকম ক্রনিক অসুখ বিসুখ দেখা দেয়৷
ফলাফল মারাত্মক
রিকশা চালক মোহাম্মদ আহসানুল্লাহ আর্সেনিকের বিষে আক্রান্ত হয়ে ভুগছেন৷ না জেনেই তিনি কয়েক বছর ধরে আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করেছেন, যাতে আর্সেনিকের পরিমাণ ছিল ৮০০ গ্রাম প্রতি লিটারে৷ ৮০ গুণ বেশি৷
আহসানুল্লাহ জানান, ‘‘দু'বছর ধরে আমি বিছানা ভিজিয়ে ফেলছি৷ ঘুম হয়না বললেই চলে৷ সারা শরীরে ব্যথা৷ সূর্যের তাপ লাগলেই শরীর জ্বালাপোড়া করে৷ মাথায় ঠাণ্ডা পানি লাগালে মনে হয় গরম৷''
ত্বকের পরিবর্তন হওয়াটা আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার একটা বহিঃপ্রকাশ৷ আরো মারাত্মক ব্যাপার হল, আর্সেনিক তাঁর শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আক্রমণ করেছে৷ ইতিমধ্যে সরকারের তরফ থেকে আহসানুল্লাহর টিউবওয়েলে আর্সেনিকের ফিল্টার লাগানো হয়েছে৷ এটা কাজ করছে কিনা তা আহসানুল্লাহ জানেন না, কেননা তিনি তো এটা পরীক্ষা করতে পারেন না৷
চিকিত্সক ডাঃ মোহাম্মদ এ সালাম এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘তিনি যদি বিষাক্ত পানি সব সময় পান করতে থাকেন, তাহলে তাঁকে আর সাহায্য করা সম্ভব নয়৷ এর ফলে বিষ তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আরো বেশি করে আক্রমণ করবে৷ এতে ক্যানসার দেখা দিতে পারে৷ লিভার, মূত্রাশয় ও কিডনি আক্রান্ত হতে পারে৷ যা থেকে মৃত্যুও হতে পারে তাঁর৷''
এবার দৃষ্টি দেয়া যাক আর্সেনিক গবেষকদের কর্মকাণ্ডের দিকে৷ মাইক্রোজীববিজ্ঞানী এনডেস বায়ো সেনসরটি পরীক্ষা করে দেখছেন৷ এটির সাহায্যে স্থানীয় সাহায্য সংস্থাগুলি বিভিন্ন গ্রামে টিউব ওয়েলের পানিতে আর্সেনিকের অস্তিত্ব পরীক্ষা করে দেখতে পারে৷ কাঁচের গ্লাসে ফ্রোজেন ব্যাকটেরিয়াগুলিকে দেখা যায়৷ পানির নমুনা এতে ঢাললে এই বায়ো ডিটেকটিভগুলি জেগে উঠবে৷ ঘণ্টা দুয়েক পর তথাকথিত লিউমিনোমিটার দিয়ে ব্যাকটেরিয়াগুলির ভেতরে জ্বলজ্বল করা আলোর শক্তি নির্ণয় করা হবে৷ আর এর মাধ্যমে আর্সেনিকের পরিমাণও নির্ণয় করা যাবে৷
কার্যক্ষেত্রে নির্ভুল নয়
তবে গবেষণাগারে এই পদ্ধতি নির্ভুল হলেও কার্যক্ষেত্রে পরীক্ষা করার সময় অনেক ক্ষেত্রে ভুল ফলাফল পাওয়া গেছে৷ গবেষকরা এর কারণটা ঠিক মতো বুঝতে পারছেন না৷ কারোলা এনডেস বলেন, ‘‘প্রখর সূর্যতাপ, বাতাসে আর্দ্রতা, পানিতে বিভিন্ন দ্রব্যের মিশ্রণ এই সব আর্সেনিকের পরীক্ষাকে প্রভাবিত করতে পারে৷ আর এসবই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে৷''
এজন্য প্রতিটি টিউবওয়েল থেকে ৮টি নমুনা নেয়া হবে৷ ফলফলটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য গবেষক কনরাড জিগফ্রিড একই সাথে রাসায়নিক পরীক্ষা চালাবেন৷ এছাড়া গবেষকদের এই টিম প্রতিটি টিউবওয়েল থেকে ৬টি নমুনা জার্মানিতে এনে গবেষণাগারে পরীক্ষা করবেন৷ গ্রামবাসীরা খুব আগ্রহের সঙ্গে এই পরীক্ষাটি লক্ষ্য করেছেন৷ অনেকেই নিজেদের টিউবওয়েলটি পরীক্ষা করার জন্য গবেষকদের অনুরোধ করেছেন৷ বাচ্চারা বিষয়টি নিয়ে গানও গায়৷
অনেকেই জানে না, তাদের কলের পানি আর্সেনিক দ্বারা দূষিত কিনা৷ কেননা আর্সেনিকের স্বাদ ও গন্ধ কিছুই থাকে না৷ বাংলাদেশের এক কোটি (১০ মিলিয়ন) টিউবওয়েলের মধ্যে মাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশই পরীক্ষা করা হয়েছে৷ এজন্য সহজ ও সুলভ মূল্যের পরীক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ৷
জার্মান গবেষক টিমটির প্রধান মাইক্রোজীববিজ্ঞানী হাউকে হার্মস বলেন, বায়ো-সেনসর খাদ্যদ্রব্যে আর্সেনিকের উপস্থিতি নির্ণয় করতে পারে৷ কেননা এখনও কেউ জানে না, আর্সেনিক খেতের ধানকেও দূষিত করছে কিনা৷ হাউকে হার্মসের ভাষায়, ‘‘আমি এটা প্রমাণ করতে চাই যে, বায়ো-সেনসর রাসায়নিক পদ্ধতির চেয়ে ভালো৷ আমাদের স্বপ্ন, এই পদ্ধতির আরো উন্নতি হলে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা নিরীক্ষার আর প্রয়োজন হবে না৷''
প্রতিবেদন: বির্গিটা শ্যুলকে / আরবি
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ