1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আসন্ন সাইবার সুরক্ষা আইনের কাছে প্রত্যাশা

১৯ নভেম্বর ২০২৪

সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার এখন নতুন আইন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, নতুন ওই আইনের নাম হবে ‘সাইবার সুরক্ষা আইন’।

https://p.dw.com/p/4nAeS
Asif Nazrul
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ছবি: Sazzad Hossain

 আইনটি কেমন হবে সে ব্যাপারে বিস্তারিত তিনি বলেননি।

গত ৭ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠকে সাইবার নিরাপত্তা আইন (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ ২০২৪-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদনের সিদ্ধান্তের পর জানানো হয়, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভোটিং সাপেক্ষে অধ্যাদেশটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ পুনরায় উপস্থাপন করবে।তারপর চূড়ান্তভাবে বাতিল করা হবে। আর সাইবারস্পেসে সেফটি ও সিকিউরিটি নিশ্চিত করার বিষয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সাচিবিক ও কারিগরি সহায়তায় একটি পৃথক আইনি কাঠামো আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠকে উপস্থাপন করবে। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে নতুন ‘সাইবার সুরক্ষা আইন' আসছে।

আর ওই সময়েই তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, "আগের আইনের অধীনে যত মামলা হয়েছে, সব মামলাও বাতিল হবে। শুধু এই আইন নয়, মত প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করে-এমন সব আইন পর্যালোচনা করা হচ্ছে।” 

‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা যাতে ক্ষুন্ন না হয়’

সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা: শেখ হসিনা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের আমল

দেশের সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরোধিতার মধ্যেই ২০১৮ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর সংসদে পাস হয়েছিল ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। তারপর সেই প্রতিবাদ সামাল দিতে ২০২৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর করা হয় সাইবার সিকিউরিটি আইন। আসলে পরের আইনটি পুরনো আইনই নতুন নামে করা হয় ,তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না।

সেন্টার পর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ বলেছে, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট এক হাজার ৩৬টি মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরপত্তা আইনে। তাতে আসামি করা হয়েছে ৪,৫২০ জনকে। তার মধ্যে  ১,৫৪৩ জনের পেশাগত পরিচয় পাওয়া গেছে। ২,৯৮৬ জনের পেশাগত পরিচয় পায়নি সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ।যাদের পেশাগত পরিচয় জানা গেছে, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতারাই সংখ্যায় বেশি- ৪৯৫ জন। তারপরই রয়েছে সাংবাদিক- ৪৫১ জন। এছাড়া সরকারি চাকুরে, চিকিৎসক, এনজিওকর্মী, আইনজীবী, ছাত্র, শিক্ষকও রয়েছেন। শতাংশ হিসাবে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ৩২.২৭ শতাংশ এবং সাংবাদিক ২৯.৪ শতাংশ।এইসব মামলায় আসামিদের মধ্যে ২৮ জন আছেন, যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে।

মামলায় ১,৫৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৪৩ জন রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ছাত্র ১০৪ জন এবং সাংবাদিক ৯৭ জন।

মামলা দায়েরকারীদের মধ্যে শীর্ষে আছে র‌্যাব, পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা।ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামীলীগের নেতারাই সবচেয়ে বেশি ৩৩৪টি মামলা করেছেন। যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের প্রায় সবাই বিরোধী নেতা-কর্মী।এইসব মামলায় শাস্তি হয়েছে খুবই কম। তারপরও জেলে থাকতে হয়, হয়রানির শিকার হতে হয়। এই মামলার আসামি লেখক মুশতাক আহমেদ ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কারাগারেই মারা যান।আর্টিক্যাল নাইনটিন বলছে, শুধু ২০২১ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশে যত মামলা হয়েছে, তারমধ্যে ৪০ শতাংশ মামলাই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের নামে কটূক্তির কারণে।

উল্লেখ্য, অন্তর্বতী সরকারে আমলেও সাইবার সিকিউরিটি আইনে অন্তত: দুটি মামলা হয়েছে।

আইনেরশিকার' যারা

ডিএসএ ভিক্টিম নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক, স্থপতি গোলাম মাহফুজ জোয়ার্দার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্বেগ প্রকাশ করায় ১০ মাস কারাগারে ছিলেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার জেরে ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর র‌্যাবের একটি দল তাকে আটক করে। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘নতুন ডিজিটাল সুরক্ষা আইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা যাতে ক্ষুন্ন না হয় সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে। সেটা করা হলে আইনটি সাধারণ মানুষের কাজে লাগবে।”

"আগে যে আইন ছিল তা মানুষকে হয়রানির জন্য ব্যবহার করা হতো। ওই আইন ছিল ক্ষমতাবানদের দমন-পীড়নের হাতিয়ার। এবার সেটা না হয়ে যদি সত্যিকারের সুরক্ষার আইন হয় তাহলে আমরা খুশি হবো,” বলেন তিনি।

তিনি বলেন, "আগের আইনের যারা শিকার হয়েছেন, তাদের ক্ষতিপুরণ ও যারা এর অপব্যবহার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি আমাদের।”

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ)-র আরেক শিকার দিদারুল ভুঁইয়া। তিনি ২০২০ সালে গ্রেপ্তার হয়ে পাঁচ মাস জেলে ছিলেন। চৌধুরী নাফিজ শারাফাতের নানা অপকর্ম এবং করোনা সংস্ক্রান্ত সঠিক তথ্য প্রকাশের প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকায় তাকে ওই আইনের মামলায় আটক করা হয়েছিল বলে অভিযোগ।

তিনি বলেন, "ডিএসএ ভিক্টিম নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে আমাদের সুনির্দিষ্ট চারটি দাবি আছে। ডিএসএসহ নিবর্তনমূলক আইনে যারা এখনো আটক আছেন, তাদের মুক্তি দিতে হবে। যারা মিথ্যা মামলা করেছে, তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিচার ও শাস্তি (হতে হবে)৷ নতুন আইন যাতে সরকার একতরফাভাবে করতে না পারে, সবার সঙ্গে আলোচনা করে (তা নিশ্চিত) করতে হবে। আর এই ধরনের আইন করতে গণভোটের ব্যবস্থা করতে হবে।”

" নতুন যে ডিজিটাল সুরক্ষা আইন করা হচ্ছে, তাতে অবশ্যই মিথ্যা ও হয়রানিমূললক মামলার ব্যাপারে শাস্তির বিধান রাখতে হবে,”বলেন তিনি।

তিনি জানান, তাদের জানা মতে এখন ডিএসএ অ্যাক্টে গ্রেপ্তার হয়ে কেউ আর কারাগারে নেই।

কেমন আইন চাই

ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সাইবার সিকিউরিটি আইনের বড় সমালোচনা হলো, এই আইন মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও কন্ঠরোধ করতে ব্যবহার করা হয়েছে। আর সাংবাদিকরা সঠিক খবর পরিবেশন করলেও মানহানির অভিযোগে ক্ষমতাসীন ও ক্ষতাবানরা মামলা করে হয়রানি করেছেন। সাধারণ মানুষসহ পেশাজীবীরাও এর শিকার হয়েছেন। এই আইনে অনুভূতি, ধর্মীয় অনুভূতি, মানহানির সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা না থাকায় এর যথেচ্ছ ব্যবহার হয়েছে। একজন সাব ইন্সপেক্টর মামলা করতে পারেন, ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তার করতে পারেন। ফলে অপব্যবহার সহজ হয়েছে। অধিকাংশ ধারাই জামিন-অযোগ্য। ফলে আটক হলেই দীর্ঘদিন জেলে থাকতে হয়। এছাড়া আইনটিতে সুরক্ষার কোনো বিধান নেই। ফলে হয়রানির প্রতিকার পাওয়া যায় না। ফলে যারা আসলেই সাইবার অপরাধের শিকার, তারা এই আইন থেকে কোনো প্রতিকার পাননি।প্রতিপক্ষকে দমনে ক্ষমতাবানদের হাতিয়ার হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, "নতুন আইনের উদ্দেশ্য হতে হবে যারা সাইবার বিশ্বে অপরাধের শিকার হন, তারা যেন ন্যায় বিচার পান। আর সাইবার বা ইন্টারনেট জগতে যারা কাজ করেন, যারা গ্রাহক, তারা যেন সুরক্ষা পান।”

"সরকারের সমালোচনা করলে হয়রানি করা, সাংবাদিকরা অনুন্ধানী প্রতিবেদন করলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা- নতুন আইনে সেই সুযোগ যেন না থাকে।” 

‘অনেক নারী সাইবার অপরাধের শিকার হন’

তিনি বলেন, "আমাদের সাইবার ট্রাইব্যুনাল মাত্র ছয়টি। ওইসব আদালতে কনভিকশন রেট খুবই কম। অনেক নারী সাইবার অপরাধের শিকার হন। পুরুষরাও (শিকার) হন। তারা যাতে বিচার পান, নতুন আইনে সেই ব্যবস্থা থাকতে হবে।”

মানবাধিকার কর্মী ও গুম কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, "এই আইনে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার করা যায়। জামিন নেই। আর মিথ্যা মামলা হলে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই। নতুন আইনে এই বিষয়গুলো দেখতে হবে।”

"আর মানহানি, অনুভূতি এগুলোর সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থাকতে হবে। তা না হলে অপব্যবহার বন্ধ করা যাবে না,” বলেন তিনি।

তার কথা, " বাক স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যেন কোনোভাকেই খর্ব না হয় নতুন আইনে। তবে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যেন অন্যের স্বাধীনতা ও অধিকার  খর্ব না হয়।”

বাংলাদেশের সাংবাদিকরা ডিএসএ-র বড় শিকার। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেন, " নতুন আইনটি নিয়ে আইন উপদেষ্টা আমাদের সঙ্গে বসেছিলেন। আমরা কিছু পরামর্শ দিয়েছি। আমাদের কথা হলো, নতুন আইনে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তারা যেন এই আইনের কারণে হয়রানির শিকার না হন।  বাকস্বাধীনতা যেন খর্ব না হয়।” সাংবাদিকের সুরক্ষার পাশাপাশি হলুদ সাংবাদিকতা ও তথ্য সন্ত্রাসের ব্যাপারেও ব্যবস্থা থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি। 

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, "এই আইনগুলোর মাধ্যমে অনেকে অনেক হয়রানির শিকার হয়েছেন, এটা সত্যি। কিন্তু পাশাপাশি অনলাইনে ছেলে বা মেয়ে যদি হেনস্থার শিকার হন, তাহলে আইন না থাকলে কোথায় যাবেন?”

তার কথা, "প্রথমে জেলায় জেলায় ট্রাইব্যুনাল করতে হবে। এখন  বিভাগে আছে। ফলে বাদী ও বিবাদী দুইজনকেই বিভাগে যেতে হয়। এটা বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা। কোন বিষয়গুলো মানহানি, তা স্পষ্ট করতে হবে। কোনো সত্য তথ্যকে মানহানির আওতায় রাখা যাবে না। আর এই ধরনের মামলায় হয়রানির প্রতিকার থাকতে হবে। মিথ্যা ও হয়রানিমুলক মামলা হলে কার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে তা পরিস্কার থাকতে হবে।”