আয়ারল্যান্ডে সবিতার জয়
গর্ভপাত নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত আইরিশরা তাঁদের ভোট দিয়েছেন৷ সেই ভোটের ফলাফল গর্ভপাতকে আয়ারল্যান্ডে আইনসিদ্ধ করতে চলেছে৷ নতুন এ আইনের নাম সবিতা হলপ্পনবার নামের প্রয়াত এক ভারতীয় নারীর নামেই করার দাবি উঠেছে৷
গণআন্দোলন
২০১২ সালে আয়ারল্যান্ডে গর্ভপাতবিরোধী আইনের ফাঁদে পড়ে যে নারীর মৃত্যু হয়েছিল, যাঁকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল গণআন্দোলন; তাঁর নাম সবিতা হলপ্পনবার৷ দন্তচিকিৎসক সবিতা মিসক্যারেজের পর সংক্রমণে মারা যান৷ তাঁর মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছিল আয়ারল্যান্ডের মানুষকে৷ ২০১৮-তে গর্ভপাতবিরোধী আইন শিথিল করার দাবিতে পথে নেমেছিলেন তাঁরা৷ গণভোটে তাঁদের জয় হয়েছে৷
যে কারণে ভোট
রক্ষণশীল আয়ারল্যান্ডে মায়ের গর্ভে থাকা ভ্রুণও জীবিত মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়৷ সে হিসেবে একজন মানুষের যেমন বেঁচে থাকার অধিকার আছে, তেমনি একটি ভ্রুণও একই অধিকার রাখে৷ তাই ১৯৮৩ সাল থেকে দেশটিতে গর্ভপাত নিষিদ্ধ থাকায় এতদিন নারীরা অন্যদেশে পাড়ি জমাতেন গর্ভপাত করতে৷ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী লিও ভারাদকার গর্ভপাতের পক্ষে ছিলেন৷ তিনি শুক্রবারের ভোটকে 'ওয়ান্স ইন আ জেনারেশন চান্স' বলেছেন৷
পথদিশারী সবিতা
আইরিশ রক্ষণশীল সমাজের পক্ষে এই ভোটে পৌঁছানোর রাস্তাটা মোটেই মসৃণ ছিল না৷ এর আগে ১৯৮৩ সালেও একবার গর্ভপাতের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি উঠেছিল৷ কিন্তু তখনও সমাজে ক্যাথলিক নেতাদের যথেষ্ট রমরমা৷ ফলে গণভোটে চুড়ান্ত হার হয়েছিল গর্ভপাতকামীদের৷ কিন্তু এরপর এই আন্দোলনকে আবার পথ দেখান সবিতা৷
ভোটের ফল
মোট সাড়ে ২১ লাখ ভোট পড়েছে, যা আয়ারল্যান্ডের ইতিহাসের যে কোনো গণভোটে সর্বোচ্চ৷ গর্ভপাতের পক্ষে পড়েছে ১৪ লাখ ৩০ হাজার, বা ৬৬ দশমিক ৪ ভাগ৷ অর্থাৎ রোমান ক্যাথলিকপ্রধান দেশটিতেও প্রতি তিন জনের দু'জন চান যে, মায়ের কোনো ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে গর্ভপাতের সুযোগ থাকুক৷ রায় ঘোষণার দিন গর্ভপাতের স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনকে ‘সবিতা’ ‘সবিতা’ বলে স্লোগান দিতে দেখা যায়৷
সবিতাও আইনি সমস্যার শিকার
মিসক্যারিজ, অর্থাৎ অনিচ্ছাকৃত গর্ভপাতের সময় সবিতার প্রাণ বাঁচাতে পরিবারের পক্ষ থেকে গর্ভপাতের আবেদন করা হয়েছিল৷ আইরিশ চিকিৎসকরা তাতে রাজি হননি৷ এর মূলে ছিল আইনি সমস্যা৷ কয়েক দিন দুর্বিসহ যন্ত্রণা ভোগ করে শেষ পর্যন্ত রক্তে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় মারা যান ৩১ বছর বয়সি সবিতা৷ তবে তাঁর মৃত্যু বৃথা যায়নি৷ ৬ বছর পরে আয়ারল্যান্ডে গর্ভপাত আইন সংস্কার হচ্ছে৷ আর তাই নতুন এ আইন সবিতার নামে উৎসর্গ করার দাবি উঠেছে৷
আইনের নাম ‘সবিতা ল’ ?
কিন্তু এখনো আইন পাস হয়নি৷ আইরিশ সংসদের উচ্চ ও নিম্নকক্ষে বিল পাস হওয়ার পরই বৈধ হবে গর্ভপাত৷ আইরিশ সংসদেই সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করে যে আইন করা হয়েছিল, তা বদলে নতুন আইন তৈরি হবে৷ দ্রুত সেই আইনি স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে সবিতার নামেই নতুন আইনের নামকরণ করার দাবি জানিয়েছেন তাঁর বাবা আন্দানাপ্পা ইয়ালগি৷
জয়ের নেপথ্যে
ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মে গর্ভপাত নিষিদ্ধ৷ সবিতার মৃত্যুর পর ২০১৩ সালে এ নিয়ে তদন্ত শুরু হয়৷ হাসপাতালে ভর্তির প্রথম তিন দিনের মধ্যে গর্ভপাত করা হলে হয়ত সবিতা বেঁচে যেতেন বলে জানিয়েছিলেন দেশটির এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক৷ ঐতিহ্যগতভাবে রোমান ক্যাথলিক অধ্যুষিত দেশটিতে আজ মানুষ রীতিনীতির বদলে সামাজিক সমস্যার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন৷ এজন্য অনেকেই এই আন্দোলনের পথিকৃৎ সবিতাকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন৷
স্মৃতিতে উৎসর্গ
সবিতার মৃত্যুর পর তীব্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল আয়ারল্যান্ডে৷ সবিতাই ছিলেন সেই আন্দোলনের মুখ৷ তাঁর ছবি দিয়ে বের হয় পোস্টার৷ গর্ভপাতপন্থিরা সবিতার স্মরণে মোমবাতি মিছিল করেন৷ সবিতার মৃত্যু যে আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল তার রাশ হাতে তুলে নেন আইরিশ মহিলা সমাজ৷ পক্ষে-বিপক্ষে যা-ই যুক্তি দেওয়া হোক সবটাই ছিল মহিলাদের তরফ থেকে৷ তাই ভোটে জয় পেয়ে ‘হ্যাঁ’পন্থি মহিলারা সবিতার ছবির সামনে ফুল ও চিঠি রেখেছেন৷
সবিতাকে কেউ ভোলেনি
গণভোটে রায়ের পর প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘আজ আয়ারল্যান্ডের জন্য একটা ঐতিহাসিক দিন৷ এখানে নিঃশব্দে বিপ্লব হয়েছে৷ গোপনীয়তা থেকে পর্দা উঠে গেল৷’’ এই আন্দোলনের অন্যতম মুখ সবিতাকে কেউ ভোলেনি৷ অনেক মানুষকে সবিতার নামে তৈরি স্মারকে ফুল ও হাতে লেখা চিঠি দিতে দেখা গেছে৷ সেখানে একটি চিঠিতে লেখা ছিল, ‘‘অনেক দেরি করে ফেলার জন্য আমরা দুঃখিত৷ কিন্তু আমরা আজ এখানে পৌঁছতে পেরেছি, আমরা তোমাকে ভুলে যাইনি৷’’
শান্তির পথযাত্রী
প্রধানমন্ত্রী ভারাদকর গণভোটের ফলাফলের পরে বলেন, ‘‘এই দিনে আয়ারল্যান্ড শেষ কালোছায়াটি অতিক্রম করে আলোতে এলো৷ একদিনেই আমরা একটি যুগ পেরোলাম৷ আমরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে শামিল হলাম৷'' সবিতা এই যুগে আর নেই৷ তবুও আয়ারল্যান্ডে আজ তিনি জয়ী৷ ঐতিহাসিক রায়ে খুশি জনগণ সবিতার আত্মার শান্তি কামনা করেছেন৷