1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ইঁদুরের উৎপাতে নাজেহাল কলকাতা

২১ ডিসেম্বর ২০২৪

কলকাতা শহরে ইঁদুরের তাণ্ডব৷ বাসাবাড়ি, ফুটপাত, উড়ালসেতুর ভিত সর্বত্রই ইঁদুরের দাপাদাপি৷ এমনকি শ্মশানেও সরব তারা৷

https://p.dw.com/p/4oShN
ইঁদুর
কলকাতায় বড় বড় সৌধ, সেতু, পুরভবন ইঁদুরের আক্রমণে ধসের মুখে পড়েছে৷ ফাইল ফটোছবি: Privat/D. Balete/Field Museum Luzon

ইঁদুরের এমন উৎপাতে বিরক্ত নগর মেয়র৷ পুরসভার মাসিক অধিবেশনে মেয়র কাছে আরজি জানিয়েছেন এক কাউন্সিলরও৷ প্রশ্ন উঠছে, হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সন্ধান কলকাতায় বসে মিলবে কি?

শুক্রবার কলকাতা পুরসভার মাসিক অধিবেশনে উঠে আসে ইঁদুরের যন্ত্রণার কথা৷ পুরসভার ১২১ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কংগ্রেস কাউন্সিলর রূপক গঙ্গোপাধ্যায় মেয়র ফিরহাদ হাকিমকে বলেন, ‘‘আমার ওয়ার্ডে প্রত্যেক দিন ইঁদুরের সংখ্যা বাড়ছে৷ মাননীয় মহানাগরিক, আমার ওয়ার্ডকে ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষা করুন৷’’

অবশ্য ইঁদুরের উৎপাত কলকাতা শহরে নতুন নয়৷ ভূগর্ভস্থ বৈদ্যুতিক তারের লাইন, কংক্রিটের উড়ালপুলের ভিত খুঁড়ে ফেলেছে ইঁদুর৷ কলকাতার বস্তি এলাকা থেকে শুরু করে হেরিটেজ তকমা পাওয়া ভবন সর্বত্রই ইঁদুরের দাপাদাপি৷ একসময় ইঁদুরের জন্য ঢাকুরিয়া ব্রিজ বিপন্ন হয়েছিল৷

কলকাতা পুরসভার তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়া এবং ভবানীপুরের বস্তি অঞ্চলগুলো ইঁদুরের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ সপ্তাহখানেক আগে ইঁদুরের উপদ্রবে কলকাতার শ্মশানে মৃতদেহ সৎকারে বাধা সৃষ্টি হয়েছিল৷ কাশিপুর মহাশ্মশানে ইলেকট্রিক চুল্লির তার কেটে দিয়েছিল ইঁদুর৷ বৈদ্যুতিক সংযোগ ছিন্ন হওয়ায় সেখানে দিনের পর দিন সৎকারে সমস্যা দেখা দেয়৷

তার আগে ‘টক টু মেয়র' অনুষ্ঠানে ফিরহাদ হাকিম বলেছিলেন, ‘‘কিভাবে ইঁদুর বাস করছে তা আগামী দিনে বোঝা যাবে৷ সুরাট শহর একটা সময় প্লেগে ছেয়ে গিয়েছিল৷ এখন থেকে সতর্ক না হলে, ভবিষ্যতে মহামারি হতে পারে কলকাতায়৷’’

কলকাতায় বড় বড় সৌধ, সেতু, পুরভবন ইঁদুরের আক্রমণে ধসের মুখে পড়েছে৷ তা থেকে ঐতিহ্যবাহী বড় বড় বাড়িও রেহাই পায়নি৷ ইঁদুর মাটি আলগা করে দিচ্ছে৷ যার ফলে শহরে বড় বড় গাছ পড়ে যাচ্ছে৷

ইঁদুর তাড়াতে বিড়াল সেনা

কলকাতা পুরনিগমের অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট অনুযায়ী, শহরে ফুটপাতের ৬০- ৬২ শতাংশের অবস্থা খারাপ৷ এর জন্য ভূগর্ভে ইঁদুরের তান্ডবকে দায়ী করা হয়েছে৷

মেয়র ফিরহাদ হাকিম খাদ্য ব্যবসায়ীদের কাছে আবেদন করেছিলেন যেন হোটেলের আবর্জনা, বাসি খাবার রাস্তার ধারে না ফেলা হয়৷ এই আবর্জনাগুলো থেকে এই ইঁদুরের উৎপাত বাড়ছে৷

পার্কস্টিট, মানিকতলা, হাজরা, বড়বাজার, হাতিবাগান এলাকায় স্ট্রিট ফুডের দোকান রয়েছে অজস্র৷ এখানে ফুটপাত তৈরির তিন চার মাসের মধ্যেই গর্ত হয়ে যাচ্ছে৷ পুরনিগমের সড়ক বিভাগের ইঞ্জিনিয়াররা তাতেই পড়েছেন উদ্বেগে৷ কোটি কোটি টাকা খরচ করে ফুটপাত তৈরি করার পরও ইঁদুরের তাণ্ডবে তা নষ্ট হচ্ছে৷

কেন উৎপাত করছে ইঁদুর?

বিশ্লেষকেরা বলছেন, নগরায়ন বাড়তে থাকায় ইঁদুরের স্বাভাবিক বাসস্থান নষ্ট হচ্ছে৷ নিজেদের আবাস হারিয়ে নতুন আবাসের সন্ধানে ইঁদুরেরা৷ 

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাস ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘শহরের বাস্তুতন্ত্রের অংশ হিসেবে ইঁদুর নিশ্চয়ই পড়ে৷ নগরায়নের উত্তরোত্তর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইঁদুরদের স্বাভাবিক বাসস্থানগুলো অর্থাৎ পার্ক, উদ্যান, জলাশয়ের ধারের জায়গা ইত্যাদি ক্রমশ নির্মাণে ভরে যাচ্ছে৷ ফলে ইঁদুররা যেসব জায়গায় থাকতো, সে সব জায়গা থেকে তাদের বাস্তুচ্যুতি ঘটছে৷ তাই তারা নতুন বাসস্থান খুঁজছে৷ কখনো রাস্তা বা সেতুর অগভীর ভিত্তিতে ঘাঁটি গাড়ার চেষ্টা করছে৷’’

এদিকে পশ্চিমবঙ্গ প্রাণীচিকিৎসা বিজ্ঞান ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিদ্ধার্থ জোয়ারদার ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘কলকাতা এবং হাওড়া সংলগ্ন শহরতলিতে বর্তমান সময়ে ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও এর সাথে ইঁদুরের খাবারের পর্যাপ্ত সরবরাহ৷ অন্যদিকে প্রকৃতির রোষানলে তাদের না পড়া৷ প্লেগ, লেপ্টোস্পাইরোসিসের মতো মহামারি শহরে না হওয়ায়, এরা নিশ্চিন্তে সংখ্যায় বেড়েছে৷’’

সম্প্রতি কলকাতাকে জঞ্জালের শহর বলে মন্তব্য করেছেন তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী রেভন্ত রেড্ডি৷ অবশ্য কলকাতার রাস্তাঘাটে জমে থাকা আবর্জনা নিয়ে পরিবেশকর্মীরা চিন্তিত৷ আর অপরিকল্পিতভাবে জঞ্জালব্যবস্থাপনার কারণে বাড়ছে উঁদুরের উৎপাত- এমনটাই জানালেন পরিবেশকর্মী নব দত্ত৷   

ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘কলকাতায় এই দশকের এত খারাপ আবর্জনা ব্যবস্থাপনা অতীতে কোন সময় আমরা দেখিনি৷ পুরো শহরটা একটা জঞ্জাল নগরীতে পরিণত হয়েছে৷’’

নব দত্তের মতে, ‘‘কোথাও জঞ্জাল ব্যবস্থাপনা হচ্ছে না, ইচ্ছামতো জঞ্জাল জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ রাস্তার ধারের ফুড হকাররা বেআইনি জিনিসপত্র যেমন থার্মোকল, সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ইত্যাদি ব্যবহার করছে৷ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গাফিলতির জন্যই ভেক্টর বোর্ন ডিজিজ বাড়ছে৷ একটার সঙ্গে আর একটা সম্পর্কিত৷’’

নগরায়নের কারলে ইঁদুরের আবাস হারিয়ে যাচ্ছে: পার্থপ্রতিম বিশ্বাস

মুক্তির উপায়?

গ্রামাঞ্চলে কৃষি ক্ষেত্রে ইঁদুর বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খলের ফলেই কমে যায়৷ সেখানে সাপ, চিল, পেঁচা ইত্যাদি প্রাণী ইঁদুর খেয়ে পরিবেশে ভারসাম্য বজায় রাখে৷ কিন্তু শহরাঞ্চলে সেই সম্ভাবনা কম৷

এই পরিস্থিতিতে ইঁদুরের সমস্যা থেকে ফুটপাতের সুরক্ষার জন্য কাঁচের গুঁড়োকে গুরুত্ব দিচ্ছেন মেয়র৷ ইতিমধ্যে এই কৌশলে ফুটপাত তৈরি হচ্ছে৷ ফুটপাত তৈরির সময় মেশানো হয় কাঁচের গুঁড়ো৷

অধ্যাপক জোয়ারদার বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই ইঁদুরের সংখ্যা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে৷ ইঁদুরের গর্তের মুখে কাঁচ, পেরেক জাতীয়  সামগ্রী ছড়িয়ে কাজ না হলে ‘ট্র্যাপার' দিয়ে ইঁদুর ধরে জঙ্গলে (তাদের অপরিচিত জায়গায়) ছেড়ে দিতে হবে, যাতে তা অন্য বন্যপ্রাণী ও সাপের খাদ্য হয়ে ওঠে৷ এই কাজটা বছরে দু'বার অর্থাৎ শীতের আগে ও পরে পুরসভার উদ্যোগে করলে ফল পাওয়া যাবে৷’’

এদিকে অধ্যাপক বিশ্বাস বলেন, ‘‘ইঁদুর যে কারণে তার স্বাভাবিক জায়গাগুলো থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, পৌর কর্তৃপক্ষকে এই জায়গাটিতে নজর দিতে হবে৷ যেভাবে দ্রুত জলাশয় ভরাট করে নির্মাণ কাজ চলছে, সেটি ঠেকাতে হবে৷ মানুষের উচ্ছিষ্ট খাবার ইঁদুর খায়৷ রাস্তার ধারের ভ্যাট যদি ঠিকঠাক ভাবে পরিষ্কার না হয়, তাহলে ভ্যাটের আশেপাশের রাস্তার ইমারত, বাড়িতে ইঁদুরের বাসা বাঁধার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি৷ পৌর কর্তৃপক্ষ ইঁদুরের ঘাড়ে দোষ চাপানোর আগে নিজেদের মুখটা আগে আয়নায় দেখুন৷ শহর অপরিষ্কার থাকলে, বিশেষ করে কঠিন বর্জ্য ঠিকঠাকভাবে অপসারণ না ঘটলে ইঁদুর উত্তরোত্তর বাসা বাঁধবেই৷ বর্জ্য থেকে রক্ষা করলে শহরকে ইঁদুরের হাত থেকে বাঁচানো যাবে৷’’

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য