ইইউর কূটনীতিকদের যে বার্তা দিলেন প্রধান উপদেষ্টা
১০ ডিসেম্বর ২০২৪ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধিকাংশ দেশের কূটনীতিককের সঙ্গে সোমবার ঢাকায় বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷ তাদের অনেকে এসেছেন দিল্লি থেকে৷ তাদের কোনো মিশন বাংলাদেশে নেই৷ একসঙ্গে এতজন ইইউ কূটনীতিককে নিয়ে ঢাকায় এর আগে এরকম কোনো বৈঠক আয়োজিত হয়নি৷
প্রধান উপদেষ্টা তাদের বাংলাদেশিদের জন্য ইউরোপের দেশগুলোর ভিসা সেন্টার দিল্লি থেকে সরিয়ে ঢাকায়, কিংবা প্রতিবেশী অন্য কোনো দেশে স্থানান্তরের অনুরোধ করেছেন৷
অন্যদিকে কূটনীতিকরাও শ্রম অধিকার, জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকারসহ নানা বিষয়ে জানতে চেয়েছেন বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে৷
দিল্লির সঙ্গে ঢাকার যখন শীতল সম্পর্ক চলছে, সেই মুহূর্তে এই বৈঠকটির তাৎপর্য জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. শফিউল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অবশ্যই এই বৈঠকের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে৷ ইউরোপের অনেক দেশের বাংলাদেশে মিশন নেই৷ ফলে দিল্লি মিশনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বাংলাদেশ নিয়ে রিপোর্ট করেন৷ এখন বেশ কিছুদিন ধরে দিল্লি থেকে আমাদের সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দেওয়া হচ্ছে, মিথ্যা খবর ছড়ানো হচ্ছে৷ ফলে আমাদের সরকারের দায়িত্ব তাদের ডেকে সঠিক তথ্যটি তুলে ধরা৷ অনেক কূটনীতিক এখানে আসার পর বাস্তব চিত্র দেখেছেন৷ ফলে তাদের পক্ষে রিপোর্ট দেওয়া সহজ হবে৷ এই পরিস্থিতিতে তো ধরেই নেওয়া যায়, এর মাধ্যমে আমরা দিল্লিকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছি৷''
প্রায় আড়াই ঘণ্টার এ বৈঠকে ১৫ জন প্রতিনিধি তাদের মতামত তুলে ধরেন৷ বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, কূটনীতিকরা এই সরকারকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে৷ এছাড়া বৈঠকে শ্রম অধিকার, বাণিজ্য সুবিধা, জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাস্তবায়ন ও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে উভয়ের অঙ্গীকার ও করণীয় সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে৷
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব যেদিন ঢাকায় এলেন, সেদিনই এমন বৈঠক সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই বৈঠকটিকে অন্য কিছুর সঙ্গে মেলানো ঠিক হবে না৷ কাকতালীয়ভাবে হয়ত ভারতের পররাষ্ট্রসচিব যেদিন এসেছেন সেদিনই এই বৈঠকটি হয়েছে৷ একথা সত্যি যে, এখন ভারত যে ভিসা নীতিতে চলছে, সেখানে আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন হুমকির মধ্যে পড়ছে৷ ফলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের তো তাদের বলতেই হতো৷ এখন অনেকেই ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের সফরের দিন মেলানোর চেষ্টা করছেন৷ আমার মনে হয়, উভয়ের স্বার্থেই আমাদের মধ্যে যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল সেটা শিগগিরই স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আমার বিশ্বাস৷''
বৈঠকে অংশ নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘ইতোমধ্যে বুলগেরিয়া বাংলাদেশিদের জন্য তাদের ভিসা সেন্টার ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে স্থানান্তর করেছে৷ তিনি অন্য দেশগুলোকেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণের আহ্বান জানান৷ সংস্কার প্রক্রিয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন ইইউ প্রতিনিধিরা৷ পরামর্শ ও সুপারিশ জানিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তারা৷
ড. ইউনূস ইউরোপীয় কূটনীতিকদের বলেছেন, ভারত বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সীমিত করায় অনেক শিক্ষার্থী দিল্লি গিয়ে ইউরোপের ভিসা নিতে পারছেন না৷ ফলে তাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে৷ ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাংলাদেশের শিক্ষার্থী পাচ্ছে না৷ ভিসা অফিস ঢাকা অথবা প্রতিবেশী কোনো দেশে স্থানান্তর হলে বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয়ই উপকৃত হবে৷
এই বৈঠক সম্পর্কে সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একটা দেশে নতুন সরকার এলে উন্নত দেশগুলোর প্রতিনিধিরা সাক্ষাৎ করেন, এটাই রীতি৷ বৈঠকটিকে ভিন্নভাবে ব্যাখা করার সুযোগ নেই৷ আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে মিশন সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে যে কথাটি বলা হয়েছে, সেটি কিন্তু আমাদের দেশের ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থীদের অনেক দিনের দাবি৷ বিশেষ করে করোনার সময় অনেক শিক্ষার্থী দিল্লি গিয়ে আটকে গিয়েছিলেন৷ অন্যদিকে ভারতের ভিসা শেষ হয়ে যায়, কিন্তু ইউরোপের ভিসার প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগে, সেক্ষেত্রে নতুন জটিলতায় পড়তে হয়৷ আমি মনে করি, সরকারের তরফ থেকে যে দাবিটি করা হয়েছে, সেটা যৌক্তিকভাবেই করা হয়েছে৷''
প্রধান উপদেষ্টা বৈঠকে কূটনীতিকদের বলেছেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্যাপক আকারে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে৷ আমরা এই মিসইনফরমেশন ঠেকাতে আপনাদের সহযোগিতা কামনা করি৷ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়া স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীরা যে ব্যাপক টাকা পাচার করে নিয়ে গেছে, তা দিয়ে তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে৷ সম্প্রতি জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের কথাও বৈঠকে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা৷
বৈঠকে কি শুধু ভিসা সেন্টার সরিয়ে আনার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে, নাকি এর অন্য কোনো তাৎপর্যও আছে? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক আমেনা মহসিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রধান উপদেষ্টা যে দাবি করেছেন, সেটা অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল৷ কারণ, ইউরোপের এই দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের ব্যবসাসহ শিক্ষার্থী যাওয়ার ক্ষেত্রে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে৷ পাশাপাশি আয়তনে ছোট হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে আমরা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ৷ ফলে তাদের বাংলাদেশে মিশন করার ব্যাপারে উদ্যোগী করার চেষ্টাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে ইতিবাচক হিসেবে দেখি৷ আর আমাদের বিরুদ্ধে যেভাবে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে, সে কারণে তাদের বিষয়গুলো জানানোরও দরকার ছিল৷ মাঝে মধ্যেই এমন বৈঠক হওয়া উচিত৷''