ব্যক্তি হোক কিংবা রাষ্ট্র, এখন মেধা ও অর্থনীতিতে স্বাবলম্বী ও আত্মনির্ভরশীল হতে না পারলে কারো পক্ষে প্রতিনিধিত্বশীল একটা অবস্থান তৈরি করা অসম্ভব।
সে হিসেবে দক্ষিণ এশিয়া কেন আন্তর্জাতিক যে কোনো পরিমণ্ডলেই বাংলাদেশের পক্ষে কর্তৃত্বের সাথে নিজের অবস্থান গড়া সম্ভব হবে না যতদিন পর্যন্ত মেধা ও অর্থনীতিতে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষ ব্যষ্টিক থেকে সমষ্টিক পর্যায়ে স্বাবলম্বী না হচ্ছে। বিশ্বের যেসব দেশকে আমরা পরাশক্তি হিসেবে মানি, তাদের প্রত্যেকটিই এই দুটি ক্ষেত্রে শক্তিশালী। আর মেধা ও অর্থনীতির উন্নতির জন্য দরকার উপযুক্ত ও কার্যকরী শিক্ষা ব্যবস্থা, যেটিকে আমরা বলে থাকি মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা। এক সময় বলা হতো, শিক্ষা মানব সম্পদ উন্নয়নের অব্যর্থ হাতিয়ার। কিন্তু গত কয়েক দশকে বলা হচ্ছে, শিক্ষার গুণগতমান যদি ঠিক থাকে তাহলে শিক্ষাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী নিজেদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করে নিতে পারে।
মানসম্পন্ন শিক্ষা মানে সুসমন্বিত শিক্ষা। খাদ্য মানে যেমন পুষ্টিকর সুখাদ্য, তেমনি শিক্ষা বলতে বুঝানো হয় মানসম্মত সুশিক্ষা। শিক্ষা যখন নিম্নমানের হবে তখন ভালো বিজ্ঞানী, প্রশাসক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, কৃষিবিদ, সাংবাদিক, লেখক – কোন কিছুই তৈরি হবে না। যেনতেন শিক্ষা ব্যবস্থায় সার্টিফিকেটধারী চাকরিজীবী পাওয়া যায়, কিন্তু একীভূত সমাজ তৈরিতে লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম যোগ্য নাগরিক পাওয়া যাবে না। অ্যাসোসিয়েশন ফর সুপারভিশন অ্যান্ড কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট বলছে, শিশুর পূর্ণাঙ্গ বিকাশকে গুরুত্ব দেয়; লিঙ্গ, বর্ণ, গোষ্ঠী, আর্থসামাজিক অবস্থান অথবা ভৌগোলিক অবস্থানের ঊর্ধ্বে উঠে সব শিশুর সামাজিক, আবেগিক, মানসিক ও শারীরিকভাবে সুসমন্বিত বিকাশ নিশ্চিত করে – এমন শিক্ষাই হলো মানসম্পন্ন শিক্ষা। এই যে মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা বা শিক্ষার মানের কথা বলা হয়, সেটি কোনো একক ব্যাপার নয়। বরং একটি ব্যাপক ও সামগ্রিক এবং সমন্বিত বিষয়। কারণ, কোন দেশের শিক্ষার মান কেমন হবে তা অনেকগুলো শর্তের ওপর নির্ভর করে। এর অর্থ হলো গুণগত বা মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য দরকার অনেক উপাদানের সমন্বিত ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা এবং কর্মকাণ্ড।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে সাক্ষরতার হার বাড়ছে, জেলায় জেলায় স্কুল-কলেজের সংখ্যা বাড়ছে, হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজ, বাড়ছে পাসের হার – গ্লোডেন এ প্লাসের আধিক্যে দেশে মিষ্টি বিতরণের হার বেড়েছে —আরও কত কী! কিন্তু এসব তথ্যের বিপরীতে যেসব তথ্য উঠে আসছে সেগুলো বাংলাদেশের শিক্ষা পরিস্থিতি ও মানের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর। কারণ তথ্যগুলো দেশটির শিক্ষা ব্যবস্থা ও মানের বিপন্ন পরিস্থিতির ছাঁচাছোলা রূপটি তুলে ধরে।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বৈশ্বিক শিক্ষা সংক্রান্ত তিনটি সূচক হলো- বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক, বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচক এবং গ্লোবাল ট্যালেন্ট কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্স। ২০২৩ সালে প্রকাশিত এই তিনটি সূচকের মধ্যে বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক অনুযায়ী ১৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম, বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচক অনুযায়ী ১৩২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৫তম এবং গ্লোবাল ট্যালেন্ট কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্স অনুযায়ী, ১৩৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩তম। এর মধ্যে গ্লোবাল ট্যালেন্ট কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্স অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। আন্তর্জাতিক স্কেলের মানদণ্ডে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে তুলনা করা নিতান্তই বোকামি হবে যেখানে আমরা পার্শ্ববর্তী ভারত থেকেও যোজন-যোজন দূরে অবস্থান করছি। সর্বমহলে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, বাংলাদেশে শিক্ষার পরিমাণগত বিকাশ হলেও গুণগত উন্নয়ন তেমন ঘটেনি। পাশের হার বৃদ্ধি আর জিপিএ প্রাপ্তিতে আমরা যতটা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছি, তার পরিবর্তে মানসম্মত ও গুণগত শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়ার আওয়াজ ততটাই কম শোনা যায়। শিক্ষা খাতে পাশের হার বাড়লেই শিক্ষার মান বাড়ে না। মান বাড়াতে পরিকল্পনা ও প্রায়োগিত উভয় ক্ষেত্রেই শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হয়।
আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনগুলো থেকে গত কয়েক বছরের যে হিসেব আমরা পাই তার ভিত্তিতে বলা যায়, বাংলাদেশের শিক্ষার গুণগত মান কমছে এবং এটি বাড়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট তাদের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে বলেছিল শিক্ষার গুণগত মান কমে যাওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা খুব সঙ্গীন। ২০২৪ সালেও আমরা দেখতে পাই পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষার যে তিন স্তর – প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা – সবখানেই বিভাজন বহুবিধ। প্রাথমিক স্তরে প্রধানত তিন ধরনের বিভাজন পাওয়া যায়। সাধারণ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের স্কুল, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল আর মাদ্রাসা শিক্ষা। এইসবের মধ্যেও আবার নানা ধরনের বিভাজন রয়েছে। এই বিভাজনের কুফল নিয়ে আলোচনা খুব বেশি না করে বলা যায়, শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর হিসেবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরকে বিবেচনা করা হয়। কারণ একটি ভবন কতটা শক্তিশালী হবে তা যেমন নির্ভর করে এর ভিত্তির ওপর তেমনি একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর। একজন শিক্ষার্থীর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের গঠন পদ্ধতি যত যৌক্তিক ও মজবুত হবে ততই পরবর্তীতে মৌলিক বিষয়াবলীতে জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে সহায়ক হবে। ২০২২ সালের জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়নের তথ্য বলছে, শিক্ষাক্রম অনুযায়ী যেসব যোগ্যতা বা দক্ষতা অর্জন করার কথা, তা অর্জন করতে পারছে না বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। যেমন, তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বাংলায় কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা বা দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। গণিত ও ইংরেজির ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও করুণ। বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো মানের যে করুণ অবস্থা সেটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন আমরা দেখি অনেক শিক্ষকই নিজের সন্তানদেরকে এখন আর সরকারি বা নিজের স্কুলে পড়াতে চান না। আবার বৈশ্বিক মানদণ্ডে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থানও ভালো নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় গড়ে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী পাশ করতে পারছে না। গুণগত শিক্ষা ও গবেষণার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৈশ্বিক মানদণ্ডে পিছিয়ে পড়ছে। দেশে পাবলিক, সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এগুলোর বেশিরভাগই গুণে-মানে অনেক পিছিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণার ক্ষেত্রে যে সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার, তা তারা একধরনের অপব্যয় হিসেবে চিন্তা করা হয় বাংলাদেশের সরকারি মহলে। এর অর্থ হলো প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা – সব স্তরে জোড়াতালি মাধ্যমে মানের অবনমনের ভেতরে চলছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা।
বাংলাদেশের শিক্ষার গুণগত মান যে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেই, তা বলাই বাহুল্য। মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক অপরিহার্য পূর্বশর্তের মধ্যে একটি হচ্ছে শিক্ষায় জাতীয়ভাবে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। বাংলাদেশে শিক্ষায় বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে শিক্ষা খাতে বাজেটে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১.৬৯ শতাংশ। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৭ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা জরুরি। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ পাওয়া যাবে না যারা কমপক্ষে সাড়ে চার শতাংশ বরাদ্দ না রেখে উন্নতি করতে পেরেছে। অথচ ২০১৬ সালের পর থেকে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ কমছে। কুদরাত-ই-খুদা কমিশনের ১৯৭২ সালের প্রতিবেদনে জাতীয় বাজেটের অন্তত ৩০ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করার কথা বলা আছে। অথচ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের ১১.৮৮ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করা হয়েছে। তার আগের বছরগুলোতেও সংখ্যাটি খুব একটা এদিক-ওদিক হয়নি। কেবল ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের ১৪.৩৮ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করা হয়েছিল। জাতীয় বাজেটের প্রতিটি অর্থ বছরেই শিক্ষা খাত অতি অবহেলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকার থেকে রাজনীতিবিদ সবাই শিক্ষার গুরুত্ব বুঝেন, তা সত্ত্বেও কেন বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমে? দেখা গেছে, যেসব দেশে শিক্ষা ও সেবাখাতগুলোকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বা হাইপ তোলার উপকরণ হিসেবে রাজনীতিবিদরা ব্যবহার করে থাকেন সেসব দেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ সবচেয়ে কম থাকে। বাংলাদেশে শিক্ষায় সর্বনিম্ন সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি চলছে ব্যয়বহুল বেসরকারি শিক্ষা। ফলে শিক্ষার বৈষম্য বাড়ছে, কমছে শিক্ষার মান।
সরকারিভাবে শিক্ষায় বিনিয়োগের এই যে রাষ্ট্রীয় অনীহা তা দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার মানে একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে। কারণ এটি মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা এমন প্রত্যেকটি অনুঘটকের লাগাম টেনে ধরে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল ক্রীড়ানক শিক্ষকদের মান। ইউনেস্কো বলছে, যে দেশে শিক্ষকের মান যত ভালো সে দেশের শিক্ষার মান তত উন্নত। বৃটেনে শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান নির্ণয়ে অফস্টেড রিপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া। দ্য অফিস ফর স্ট্যান্ডার্ডস ইন এডুকেশন, চিলড্রেনস' সার্ভিসেস এন্ড স্কিলস নামের সংস্থাটি বৃটেনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ও শিশু সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান নির্ণয় করে। তাদের মূল্যায়নের প্রথম পদক্ষেপটি হলো শিক্ষকদের সক্ষমতা যেখানে শিক্ষকদের পাঠদান পদ্ধতি ও ক্ষশতা, শিক্ষার্থীদের শেখানোর জন্য উপযোগী কৌশল এবং শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির কতটুকু সুযোগ আছে সেটি দেখা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মানসম্মত শিক্ষার ২০ শতাংশ নির্ভর করে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ওপর বাকি ৮০ শতাংশই নির্ভর করে মানসম্পন্ন শিক্ষকের ওপর। যদিও সেই মুঘল আমল থেকে বাংলা ভূমিতে শিক্ষকদের ‘সমাজ গড়ার শিল্পী বা কারিগর' হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বিদ্যমান বেতন-কাঠামো, সুবিধাদি, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা, সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে তাদের মান-মর্যাদা নিয়ে আলোচনা তোলাও অনেক ক্ষেত্রে লজাস্কর বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা না করে কোনো পেশাতেই পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। একটি দেশের শিক্ষার মান দেশটির শিক্ষকের মানকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। অর্থ হচ্ছে, কোনো শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার মাননির্ভর করে শিক্ষকের মানের ওপর, তার দক্ষতা, যোগ্যতা, সম্মান ও মর্যাদার ওপর। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষককে উপেক্ষা করে মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পাই। বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে, কখনো কখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য স্বচ্ছতার সঙ্গে কী মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে? বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যেভাবে শিক্ষক নিয়োগ হয়, সেখানে কি আসলেই মেধাবীরা আসছেন। শিক্ষকদের যে বেতন কাঠামো, প্রশিক্ষণ সুবিধা তাতে কি আসলেই মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষকদের মান এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক? দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ভিত রচনা করে দেন। অথচ তাদের বেতন দেয়া হচ্ছে ১৩তম গ্রেডে, বিবেচিত হচ্ছে কর্মচারী হিসেবে। মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা যে পেশায় নেই সেই পেশায় কেন মেধাবীরা যোগ দিবেন, শ্রম দেবেন? এখন যেসব মেধাবী শিক্ষকতায় যোগ দিচ্ছেন তারা আসলে ঘটনাচক্রে শিক্ষক হচ্ছেন। সুযোগ পেলেই তারা পেশা পরিবর্তন করছেন। বিসিএস ক্যাডার পছন্দের ক্ষেত্রে শিক্ষা ক্যাডারকে সবচেয়ে নিচে রাখাটা পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক চিত্রটাকেই তুলে ধরে।
শুধু আর্থিকভাবে রাজনৈতিক দিক থেকেও শিক্ষকরা দৃশ্যমান নির্যাতনের শিকার হন। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ‘ঘরের চাবি পরের হাতে' থাকার মতো পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়। সরকারি প্রশাসন থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ এবমনকি ছাত্র সংগঠনগুলোর হাতে থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃত্ব, যেখানে শিক্ষকদের ভূমিকা হয় তল্পিবাহক মাত্র। শিক্ষকরা যখনই এ নিয়ে কথা বলতে যান, তখন তাদেরকে ‘উচিত শিক্ষা'র মাধ্যমে পুরষ্কৃত করা হয়। এই উচিত শিক্ষার মাত্রা বাড়লে আমরা দেখি শিক্ষককে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা এবং শিক্ষার্থীদের দিয়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেয়া হয়। তবে এ বিষয়গুলো নতুন কিছু নয়, ফি বছর কেউ না কেউ এ নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সরকারগুলো এসব বিষয়ে জেগে জেগে ঘুমানোর তত্ত্ব ব্যবহার করছে। অর্থাৎ, পরিস্থিতি ও কারণ উপলব্ধি করতে পেরেও বুঝে না বুঝার ভান করছে। সব শিক্ষকের জন্য বুনিয়াদি ও বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, শিক্ষকদের জন্য কর্মকালীন প্রশিক্ষণ এবং একইসঙ্গে শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা ছাড়া শুধু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল আর অবকাঠামোর সংখ্যা বাড়িয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটানো সম্ভব নয়। দরকার যেখানে শিক্ষার আত্মিক উন্নতি সেখানে বস্তুগত গড়ন-পাঠন নিয়ে রাজনৈতিক সরকারগুলো ব্যতিব্যস্ত থাকে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির এই যে বিদ্যমান ব্যবস্থা তাকে আমরা অর্থনীতির একটি জনপ্রিয় তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করতে পারি। তত্ত্বটি হলো ‘লিপস্টিক এফেক্ট' বা তত্ত্ব। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মন্দার সময় লিপস্টিক সূত্র বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে নারীরা আগের তুলনায় বেশি হারে বাসায় অবস্থান করেন। এই সময় তারা নানা রকম দুশ্চিন্তায় থাকেন। এই দুশ্চিন্তার ছাপ তাদের চেহারাকে প্রভাবিত করে। চেহারায় যাতে দুশ্চিন্তার ছাপ না পড়ে, সে জন্য নারীরা এই সময় বেশি বেশি লিপস্টিক ব্যবহার করেন। একইভাবে আমাদের সরকারগুলো আসল কারণকে ডেকে রাখতে শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট কম গুরুত্বপূর্ণ ও লোক দেখানো দিককে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন থেকে শিক্ষক নিয়োগ, পাঠ্যক্রম থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন – প্রতি বছর কোনো না কোনো ইস্যুতে বাংলাদেশের শিক্ষা খাত থেকে উত্তাল। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে সামগ্রিক ও সমন্বিত কোনো প্রক্রিয়া হাতে নিতে দেখা যায় না। বিদেশি দাতাদের পরামর্শগুলোকে জোর করে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করলেও মাধ্যমিক এবং উচ্চ স্তরে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নের আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
এর অর্থ হলো, শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ সেটি এখনো পর্যন্ত আমরা জানতেই পারছি না বা জানার সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সরকার ও নীতিনির্ধারকরা শিক্ষার মানোন্নয়নে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। সব সরকারের আমলেই আমরা এমনটা শুনে থাকি। এমনকি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চুক্তিতেও তারা স্বাক্ষর করেন। কিন্তু মানোন্নয়নের জন্য করা বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি আর চুক্তির প্রতিফলন আমরা দেখিরা। কোনো বাগানে ভাল ফলন পেতে হলে বাগানের আয়তন কত বড় তা বিবেচনা করলে হয় না, দরকার ভাল বীজ, মাটি, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ও পরিচর্যা। একইভাবে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আর পাসের হার বাড়িয়ে বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার মানের উন্নতি ঘটানো সম্ভব নয়। উল্টো এতে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়াবে।