1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘এ মুহূর্তে মিডিয়ার মধ্যে আশানুরূপ বস্তুনিষ্ঠতা নেই’

২৪ ডিসেম্বর ২০১৮

দোরগোড়ায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন৷ এই নির্বাচনে মিডিয়ার ভূমিকা কী? ভোটারদের ওপর মিডিয়া কি কোনো প্রভাব বিস্তার করছে? ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া উন্নয়ন ও অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম৷ 

https://p.dw.com/p/3AZJj
DW-Karikatur von Sergey Elkin - Pressefreiheit und Verhaftungen
ছবি: DW/S. Elkin

ডয়চে ভেলে : নির্বাচনে মিডিয়ার প্রভাব কেমন?

অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম: আমি যদি এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি চিন্তা করি, আমার কাছে মনে হয় যে, ভোটারদের আচরণকে প্রভাবিত করার জন্য মিডিয়ার প্রভাব অনেক বেশি শক্তিশালী না৷ আমি গত সাত দিনের মধ্যে পাঁচটি নির্বাচনি এলাকা নিজে ঘুরে এসেছি৷ তা থেকে আমার মনে হয়েছে, ভোটারদের আচরণ বা মনোভাব প্রভাবিত করার মতো মিডিয়ার তেমন কোনো শক্তিশালী ভূমিকা নেই৷ 

আমাদের নির্বাচনকেন্দ্রিক সাংবাদিকতার মান কেমন? 

 একটা জিনিস দেখেন, নির্বাচনি সাংবাদিকতায় আমাদের এখানে ওই অর্থে কোনো পেশাদারী অবস্থা তৈরি হয়নি৷ আমরা বিভিন্ন সময় চেষ্টা করেছি প্রশিক্ষণ দেয়ার৷ বিভিন্নভাবে যেমন নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে আরো কতগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রশিক্ষণ দেয়ার চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু আমরা দেখি খুব বেশি পেশাদার সাংবাদিকতা এখানে ডেভেলপ করেছে এটা বলা যাবে না, এই মুহুর্তে৷ 

আমাদের মিডিয়া তো প্রযুক্তির সঙ্গে অনেক দূর এগিয়েছে৷ পেশাগত উৎকর্ষতাও বেড়েছে৷ নির্বাচনের সময় এর ছাপ কতটা দেখা যায়?

এটা ঠিকই বলেছেন যে, আমাদের মিডিয়ার উৎকর্ষতা খানিকটা বেড়েছে৷ কিন্তু যদি নির্বাচনের সাথে যুক্ত করি, তাহলে আমি দেখতে পাই, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়া বা রেডিও চ্যানেলগুলো আছে, সেই চ্যানেলগুলো যে সংবাদ পরিবেশন বা উপস্থাপন করে, সেখানে আমি খুব বেশি উৎকর্ষতা সাধন করেছে এমন কিছু দেখিনি৷ এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি, মিডিয়া খুবই বায়াস্ড কিংবা ঘটনার সাথে তাদের সম্পর্ক আমরা যেটা বলি, তা তাদের রিপোর্টে উঠে আসছে না৷ তারা যে রিপোর্টগুলো প্রোডিউস করছে, সেখানে রিয়েলিটির সাথে বা গণমানুষের বা সমাজের বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি করছে৷ 

আমাদের সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা কী বাড়ছে, না কমছে?

আমি এক হিসেবে বলব যে, আমাদের সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়ছে৷ এর দুটো কারণ৷ আপনি এবার দেখবেন যে, ৬১ ভাগ প্রার্থী ব্যবসায়ী৷ আবার আরেক দিকে যদি আপনি দেখেন, মিডিয়া যাঁরা যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাঁরা কিন্তু ব্যবসায়ী৷ ফলে এই ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করছে আমাদের এই মিডিয়া৷ নাম্বার টু হচ্ছে, যাঁরা মিডিয়াতে কাজ করছে, সংবাদকর্মী বা মিডিয়া প্রফেশনাল, তাঁদের মধ্যে এক রকমের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বেড়েছে৷ ফলে তাঁরা অনেক সময় রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক সংবাদ তৈরি করছে এবং পরিবেশন করছে৷ 

কাজী মারুফুল ইসলাম

মিডিয়ার সঙ্গে এই রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বা ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততা ভালো ,না খারাপ?


দেখেন, আমরা তো আমাদের মিডিয়াকে এই সমাজ থেকে, রাজনীতি থেকে আলাদাভাবে চিন্তা করতে পারি না৷ আমাদের মিডিয়াতে যাঁরা কাজ করেন, যাঁরা সংবাদকর্মী, তাদেরই কিন্তু রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আছে৷ আবার মিডিয়া যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন, মালিকপক্ষ তাঁদেরও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আছে৷ এতে করে দাঁড়িয়েছে আমাদের মিডিয়া ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের বাইরে যে সাধারণ মানুষ আছে বা ভোটার আছে, তাঁদের মতামতের প্রতিফলন ঘটানোর জন্য যে বস্তুনিষ্ঠতা থাকা দরকার, এই মুহূর্তে আমি মনে করছি যে, আমাদের মিডিয়ার মধ্যে সেটা নেই৷ আমাদের মিডিয়া একরকমের নিয়ন্ত্রিত যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করছে৷ এবং সাধারণ মানুষের মতামত এখানে ভালোভাবে উপস্থাপন হচ্ছে না৷ 

নির্বাচন ব্যবস্থাকে ব্যাহত না করে কিভাবে আরো জনবান্ধব ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করা সম্ভব?


আমি যদি পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে চিন্তা করি, আমাদের দেশে যে আইনগুলো রয়েছে বা সাংবাধানিক অধিকারগুলো রয়েছে, সেগুলো যদি প্রয়োগ করা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের কথা বলার সুযোগ এখানে থাকার কথা৷ এখানে প্রত্যেকটা মিডিয়ার মালিকপক্ষ রয়েছে, তাদের একটা ইনফুয়েন্স রয়েছে৷ পেশাদারিত্বের যে নৈতিক মানদণ্ড রয়েছে, সেই মানদণ্ডগুলো যদি অনুসরণ করা হয়, তাহলে আমাদের মিডিয়া অবশ্যই সাধারণ মানুষের কথাকে প্রতিফলিত করতে পারে৷ আমরা অতীতেও দেখেছি আমাদের মিডিয়া, বিশেষ করে ছাপা শিল্পের মাধ্যমে যে সংবাদপত্র রয়েছে এবং যে টিভি মিডিয়া রয়েছে, তারা আমাদের গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে৷ এবং তারা চাইলে এটা কন্টিনিউ করতে পারে৷ তাদের সে ক্ষমতাও রয়েছে বলে আমি মনে করি৷

আমার কাছে মনে হয়, তাদের একটু রিউইন্ড করা দরকার এবং কিছু প্রশিক্ষণের দরকার৷ আমি একটা উদাহরণ দিই যে, আমাদের নির্বাচনি ইশতাহারগুলো দেয়া হয় এই সময়েই৷ আরআইআই ২০০৮ সালে একটা সার্ভে করেছিল, সেখানে দেখা গেছে, ইশতাহার ঘোষণার পর মাত্র ৮ ভাগ ভোটার তাঁদের ভোটাধিকারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ তার মানে দেখেন, ইশতাহারগুলো ভোটারদের খুব একটা প্রভাবিত করছে না৷ মিডিয়া যদি চায় এই ইশতাহার ধরে যে দল ক্ষমতায় আসবে, তাদের কিন্তু জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে পারে৷ এই জায়গায় পেশাগত উৎকর্ষতা প্রয়োজন৷ আমি মনে করি, আমাদের সাংবাদিকরা মালিকপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে কতগুলো ইহজাগতিক লোভ, কতগুলো স্বল্পস্থায়ী লাভের বাইরে যদি তারা পেশাদারিত্বের কথা চিন্তা করে বা গুরুত্ব দিতে পারে, তাহলে তারা এই রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে, বিশেষ করে রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে পারে৷ 

নির্বাচনের সময় সাংবাদিকদের কী ধরনের ত্রুটি আপনার চোখে পড়ে?

আমরা যদি আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে দেখি, তাহলে আমি নিজে দেখতে পাচ্ছি স্পষ্টভাবে তারা এই মুহূর্তে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা আছে বা সরকারপক্ষ আছে, তাদের পক্ষ নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করছে৷ তারা যে কনটেন্টটা তৈরি করছে, সেটাও পক্ষ নিয়ে৷ এখানে সাধারণ মানুষের বা সমাজের যে মনোভাব সেটা তাদের রিপোর্টে উঠে আসছে না৷ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়া ক্ষমতাসীন দল বা গোষ্ঠীর মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছে৷ 

এই ত্রুটি কিভাবে দূর করা যায়?


দূর করা সম্ভব৷ শুধুমাত্র পেশাদারিত্বের উৎকর্ষতা সাধন করেই এটা সম্ভব৷ পৃথিবীর সব দেশেই মিডিয়া শিল্পের মালিকপক্ষ আছে৷ কিন্তু মালিকপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এসে সাংবাদিকরা যদি পেশাদারী মানদণ্ডটাকে অক্ষুন্ন রাখতে পারে, তাহলে আমার মনে হয়, তাঁরা তাঁদের বস্তুনিষ্ঠতা, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের যে মনোভাব, সেটিকে তাঁরা যথাযথভাবে জনগণের কাছে উপস্থাপন করতে পারবে৷ ফলে এই মুহূর্তে তাঁদের বিভিন্ন স্বার্থ গোষ্ঠীর বাইরে এসে সাধারণ মানুষের জন্য সংবাদ তৈরি করতে হবে৷ এর জন্য তাঁদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন৷ 

আমাদের দেশের মিডিয়া নাকি সাংবাদিকরা– কে স্বাধীন নয়?


দেখেন, মিডিয়াকে যদি আমরা একটা ‘হাউস’ বলি, সেক্ষেত্রে তার সঙ্গে স্পষ্টভাবে দুটো পক্ষ রয়েছে৷ একটা হলো মালিকপক্ষ যারা এটা চালাচ্ছে, আরেকটা হলো যারা যারা সংবাদ তৈরি করছে৷ মালিকপক্ষ বর্তমানে বায়াস্ড৷ এই অর্থে যে গত ১০ বছরে যেসব চ্যানেল সম্প্রচারে এসেছে, তারা প্রত্যেকেই বর্তমান সরকারের সুবিধাভোগী৷ তারা এই সরকারের আমলে লাইসেন্স পেয়েছে, এই সরকারের আমলে বিদেশ ভ্রমণ করেছে, ফলে প্রত্যেকে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন রকমের সুবিধাভোগী৷ কিন্তু আমি যদি মিডিয়াকর্মীদের কথা বলি, বিশেষ করে নতুন জেনারেশনের যেসব সংবাদকর্মী এসেছেন, তাঁরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কৌশল জানেন৷ কিন্তু তাঁদের সঙ্গে মালিকপক্ষের একটা চলমান বিরোধও আছে৷ এতে করে এই যুদ্ধে যেসব সংবাদকর্মী টিকে থাকতে পারছেন, তাঁরা কিন্তু ভালো রিপোর্ট করছেন৷ আর যাঁরা টিকে থাকতে পারছে না, তাঁরা মালিকপক্ষের সঙ্গে আপোষকামিতা তৈরি করছেন এবং মালিকপক্ষের সঙ্গে সরকার পক্ষের বা শাসকদলের স্বপক্ষে সংবাদ উৎপাদন করছেন এবং সেটা জনগণের সামনে তুলে ধরছেন৷

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য