‘এইয়াফিয়াদলা’ বন্ধ করে দিয়েছিল গোটা ইউরোপের বিমান চলাচল
২৩ এপ্রিল ২০১০অগ্ন্যুৎপাতের ফলে যে ছাইমেঘ বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, সেসম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া গেলেও কোন বিমানের জন্য গোটা এলাকার ঠিক কোথায় কতটা বিপদের আশঙ্কা রয়েছে, তা সঠিকভাবে বলা অত্যন্ত কঠিন৷ এই মেঘের মধ্যে পাথর বা কাচের মত যে সব বস্তু রয়েছে, তা বিমানের ইঞ্জিন এবং বিমানের কাচের জানালারও মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে৷ ১৯৮২ সালে ইন্দোনেশিয়ার উপর দিয়ে যাওয়ার সময় ছাইমেঘের মধ্যে ঢুকে পড়ে একটি বোয়িং ৭৪৭ বিমানের ৪টি ইঞ্জিনই বিকল হয়ে গিয়েছিল৷ পাইলটের অসাধারণ দক্ষতার কারণে সেযাত্রা বিমানটি জরুরি অবতরণ করতে পেরেছিল৷ বিমানযাত্রীদের কোন ক্ষতি হয় নি৷
আইসল্যান্ডের এইয়াফিয়াদলা আগ্নেয়গিরি ১০ কিলোমিটারের বেশী উচ্চতায় ছাইমেঘ ছড়িয়ে দিয়েছে – যা অত্যন্ত বিরল এক ঘটনা৷ ফলে গোটা মহাদেশ জুড়ে প্রায় ৬ দিন ধরে বিমান চলাচল থেমে গিয়েছিল৷ মানুষ সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় পরিস্থিতির উন্নতির জন্য শুধু অপেক্ষা করেছে৷ কোন অবস্থাতেই একটা সার্বিক চিত্র পাওয়া যায় নি৷ বাতাস যেহেতু থেমে থাকে না, তাই পরিস্থিতিও দ্রুত বদলে যেতে পারে৷ জার্মান মহাকাশ সংস্থা ডিএলআর-এর একটি বিমান বিশেষ যন্ত্রপাতি সহ এমন পরিমাপের কাজ চালিয়েছে৷ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানী হান্স ফলকার্ট বললেন, ‘‘ক্ষুদ্র এয়ারোসোল ধুলিকণাই ছাইমেঘের আসল উপাদান৷ খালি চোখে এই কণা প্রায় দেখাই যায় না৷ এই কণা কত বড়, কোন্ উচ্চতায় এগুলি রয়েছে, ছোট-বড় কত কণা একসঙ্গে রয়েছে, তাদের ঘনত্ব কী, প্রতি বর্গ মিটার বাতাসে কত পরিমাণ কণা রয়েছে – এমন সব তথ্য জানা অত্যন্ত প্রয়োজন৷''
আরও একটি সমস্যা হল, ছাইমেঘ কখন বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, সেসম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট মানদণ্ড স্থির করা কঠিন৷ হান্স ফলকার্ট বললেন, ‘‘এটা একটা বাড়তি সমস্যা৷ সামগ্রিকভাবে ছাইমেঘকে অত্যন্ত বিপজ্জনক হিসেবে গণ্য করা হয়৷ তাই এখনো পর্যন্ত শুধু বিমান চালানো হবে কি না, অর্থাৎ ‘হ্যাঁ' বা ‘না' – এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়৷ অর্থাৎ আকাশে ছাইমেঘ দেখা দিলেই বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়৷''
আইসল্যান্ডের ঘটনা সত্যি অভূতপূর্ব৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের আকাশ এমন অচল হয়ে পড়ে নি৷ ফলে কেউই এমন বিপদের জন্য প্রস্তুত ছিল না৷ অনেক মহলেই সমালোচনা শোনা যাচ্ছে, যে সঙ্কটের সমাধান করতে ইউরোপের দেশগুলির সরকার অথবা ইউরোপীয় পর্যায়ে যথেষ্ট দ্রুত প্রতিক্রিয়া বা সিদ্ধান্ত দেখা যায় নি৷ বৈজ্ঞানিকরা কি এই অরাজকতা কাটাতে আরও দ্রুত কোন পদক্ষেপ নিতে পারতেন না ? নাকি উপযুক্ত প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ছিল ? এই অভিযোগ সম্পূর্ণ সত্য নয়৷
হান্স ফলকার্ট জানালেন, ‘‘প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে এর ব্যবস্থা রয়েছে৷ বিভিন্ন দেশের আবহাওয়া দপ্তরের ভলক্যানিক অ্যাশ অ্যাডভাইজরি সেন্টার আছে৷ তাদের কাজই হল সর্বক্ষণ আগ্নেয়গিরির ছাইয়ের দিকে লক্ষ্য রাখা৷ আইসল্যান্ডের ঘটনার দিকে নজর রাখছে ব্রিটেনের আবহাওয়া দপ্তর৷ তারা সব তথ্য জার্মানির বিমান চলাচল নিরাপত্তা সংস্থাকে পাঠিয়ে দেয়৷ জার্মানির এই সংস্থা তার ভিত্তিতে বেসামরিক বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে৷ কিন্তু অনেকে এখন বলছে, এত কড়া নিষেধাজ্ঞার কি সত্যি প্রয়োজন ছিল? কিন্তু সমস্যা হল, আকাশে ছাইমেঘের অবস্থা সম্পর্কে সব তথ্য সংগ্রহ করলেও একেবারে নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না, যে সেই মেঘ বিমানের ইঞ্জিন বা জানালার জন্য বিপজ্জনক কি না৷ সেই জ্ঞান এখনো আমাদের নেই৷ দীর্ঘদিন ধরে তথ্য সংগ্রহ করতে পারলে হয়তো এবিষয়ে আরও নিশ্চিত হওয়া সম্ভব৷''
আইসল্যান্ডের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ইউরোপ এমন বিপর্যয়ের জন্য সাধ্যমত আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা করছে৷ প্রশাসনিক স্তরে উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলার নানারকম প্রস্তাবের কথা শোনা যাচ্ছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিবহনমন্ত্রীরা এক ভিডিও বৈঠকে জরুরি ভিত্তিতে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বটে, কিন্তু অর্থনৈতিক চাপের মুখে বিমান চলাচল আবার স্বাভাবিক করে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা শোনা যাচ্ছে৷ ছাইমেঘের বিপদ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব অবশ্যই লক্ষ লক্ষ বিমানযাত্রীদের ক্ষোভের কারণ হয়েছে বটে, কিন্তু তাদের নিরাপত্তা আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করছেন পাইলট সংগঠন ও অন্যান্য মহল৷
প্রতিবেদক : সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা : দেবারতি গুহ