1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

এবং কবিরাজ…

ফাইজুস সাজ্জাদ
১৫ নভেম্বর ২০১৯

আলতা বানুর ছেলেটা মাত্র দুই মাস৷ এই মুহূর্তে আবির, মানে আলতা বানুর ছেলেটা মাথা নিচে আর পা দুটি আকাশের দিকে দিয়ে মজাফফর ফকিরের হাতে ধরা অবস্থায় ঝুলছে৷

https://p.dw.com/p/3T5qt
Bangladesch Cox's Bazaar Rohingya-Flüchtlingslager
ছবি: Jibon Ahmed

আলতা বানুর ছেলেটা মাত্র দুই মাস৷ এই মুহূর্তে আবির, মানে আলতা বানুর ছেলেটা মাথা নিচে আর পা দুটি আকাশের দিকে দিয়ে মজাফফর ফকিরের হাতে ধরা অবস্থায় ঝুলছে৷ মাটিতে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া উরছে৷ সেই ধোঁয়ায় ঝুলতে ঝুলতে তিব্র কান্নার আর যন্ত্রণার মাঝে আবিরের শ্বাসকষ্টের চিকিৎসা চলছে৷ এটা কবিরাজি৷ এ ধরনের অনেক চিকিৎসার উদাহরণ দেয়া যেতে পারে৷ আমাদের দেশে কবিরাজি চিকিৎসার বিরাজ ও বিস্তার নিয়ে বিশদ আলোচনা হতে পারে৷ কিন্তু কেন এই কবিরাজি? মানুষ কেন এমন ঝাড়ফুঁকে আস্থা রাখছে? তারা কি চিকিৎসকদের বিশ্বাস করছে না? নাকি প্রচলিত চিকিৎসার এবং চিকিৎসকের অভাব থাকায় তারা এই বিকল্প বেছে নিচ্ছে?

প্রাকৃত ও প্রথাগত (Tradional and Complementary Medicine) চিকিৎসা কম-বেশি পৃথিবীর সব দেশেই রয়েছে৷ অধাপক ইমদাদুল হক, তাঁর এক প্রবন্ধে, বাংলাদেশের প্রথাগত চিকিৎসাকে দুই ভাগে ভাগ করেছেনঃ ধর্মীয়-প্রথাগত চিকিৎসা যেমন- ‘কালামি’, ‘বান্ধাই’, ‘আধ্যাত্মিক চিকিৎসা’ এবং অধর্মীও-প্রথাগত চিকিৎসা, যেমন-‘জাদু-টোনা’, ‘কবিরাজি’, ‘গ্রাম্য-চিকিৎসা’৷ এর মধ্যে কবিরাজি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত চিকিৎসা, বিশেষত গ্রাম-বাংলায় ৷ সাধারণত যারা এধরনের চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন, তারা দরিদ্র বা অতি-দরিদ্র শ্রেণির ৷ ভাগ বা বিভাজন যাই থাকুক না কেন, যারাই এদেশে প্রথাগত চিকিৎসা দেন তারাই ‘কবিরাজ’ হিসাবে পরিচিত৷ লক্ষণীয় বিষয় হল, অভিজ্ঞতাই কবিরাজি চিকিৎসার সারবস্তু৷ দেখা যায়, পারিবারিক কিংবা বংশানুক্রমে কবিরাজরা চিকিৎসা দেন৷ অনেকেই এই অভিজ্ঞতা ‘স্বপ্নে-প্রাপ্ত’ হিসাবে বর্ণনা করেন৷ এবং এই অভিজ্ঞতা ও সেবার মানদণ্ড শুধুমাত্র ‘বিশ্বাস’ ও ‘স্তুতি’র উপর নির্ভরশীল৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে (২০১৩) দেখা যায়, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ‘প্রথাগত’ চিকিৎসা সেবা নিয়ে থাকে৷ 

Faizus Sazzad | Yong Loo Lin School of Medicine National University of Singapore
ফাইজুস সাজ্জাদ, রিসার্চ ফেলো, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরছবি: privat

কবিরাজি চিকিৎসার অন্যতম উপাদান হল উদ্ভট সব পন্থায় মানুষকে ‘বিশ্বাস’ করানো যে, ‘প্রকৃত’ চিকিৎসা চলছে৷ শাররিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, ঝাড়-ফুক, তাবিজ-কবজ এসব মানুষ সহজেই মেনে নেয় কারণ তারা কবিরাজি যুগযুগ ধরে এভাবেই করতে দেখেছে; এটা আমদের সমাজেরই অংশ৷ বংশ-পরম্পরায় এভাবেই এই চিকিৎসা চলে এসেছে এবং মানুষ তা মেনে নিয়েছে৷ ‘শিক্ষার-অভাব’ একারনে কবিরাজি চিকিৎসা নেয়, একথাটিও অর্ধসত্য৷ অনেক শিক্ষিত মানুষ এদেশে কবিরাজি চিকিৎসা নেয়৷  কিছু মানুষ আছেন তারা, তাদের নিজেদের এবং পরিবারের সবার যেকোনো সমস্যার সমাধানে কবিরাজের শরণাপন্ন হন৷ তারা মনে করেন, অধুনিক চিকিৎসা সেবার অনেক আগেই ‘কবিরাজি’ চিকিৎসার উদ্ভব হয়েছে৷ অতিপ্রাচীন কাল থেকেই এই চিকিৎসা চলে এসছে তাই আধুনিক চিকিৎসায় সকল সমস্যার সমাধান নেই৷ এরকম, প্রথাগত চিকিৎসা সবচেয়ে বেশি প্রচলিত চীনদেশে৷ বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানি ‘জনসন অ্যান্ড জনসন’ বিরাট অঙ্কের এক গবেষণা বাজেট দিয়ে প্রায় ১০ বছর নিরন্তর গবেষণা করে এর ভালো কোনো ফল পায়নি৷ তাই অতিপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসলেও বর্তমানে তা গ্রহণযোগ্য নয়৷

‘বিকল্প চিকিৎসা’ কিংবা ‘চিকিৎসার বিকল্প’ এর অবাধ প্রসারের প্রধান কারন হলো ‘চিকিৎসা হীনতা’৷ বাংলাদেশে মাত্র ২০-২৫% মানুষ আধুনিক চিকিৎসা সেবার আওতায় আছেন বাকি ৭৫-৮০% লোক এখনো কবিরাজি সহ অন্যান্য বিকল্প চিকিৎসার উপর নির্ভরশীল ৷ হাসপাতাল থাকলে ডাক্তার নেই, ডাক্তার থাকেল ওষুধ নেই৷ ওষুধ থাকলে পরীক্ষানিরীক্ষা করার সুযোগ নেই৷ সম্মিলিত ভাবে ‘স্বাস্থ্য সেবা’ একটি বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য ‘অতি- দুর্বল সেবা’ হিসাবে পরিগণিত৷ আমাদের দেশে পরিকল্পিতভাবে এই সেবা দেয়া ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল, যা নেই৷ নেই, সরকারি বাজেট-বরাদ্দ৷ এসব সত্য আমাদের সমাজের ধনী- গরীব সকলেই জানেন৷ তাই নিদেন পক্ষে, উপায়ন্তর না থাকলে তারা ‘হাসপাতাল’ মাড়াতে চাননা৷ কেননা ‘অতি- দুর্বল সেবা’ হলেও এদেশে আধুনিক চিকিৎসা ‘অতি- সুলভ’ নয়৷ হেলথ-ইন্সুরেঞ্চ না থাকায় চিকিৎসার প্রায় সব খরচই রোগীকে বহন করতে হয়৷

আমদের দেশে ‘অতি- দরিদ্র শ্রেণীর’ মতো ‘অতি- ধনিক শ্রেণি’ ও রয়েছে৷ এই বৈশম্বের কারনে দেশে ‘প্রাইভেট’ হাসপাতাল গড়ে উঠেছে অনেক৷ এসব হাস্পাতালে আধুনিক থেকে আধুনিকতর চিকিৎসা সেবা থাকলেও তা সাধারণ এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগালের বাইরে৷ এসব হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা ব্যয়বহুল৷ দেশে দারিদ্রের হার কমলেও এই বৈষম্য আরো প্রকট হয়েছে৷ তাই অতি দরিদ্ররা অভাব মেনে নিয়েই ‘কবিরাজি’ চিকিৎসার শরণাপন্ন হয়৷

সমাজ-বিশ্লেসকরা অবশ্য ভিন্ন চোখে দেখেন ৷ তাঁরা বলেন - মানুষ তাঁর অবস্থার পরিবরতন চায়৷ অবস্থানের পরিবরতন চায়৷ প্রকৃতপক্ষে চায় তাঁর দুরবস্থার পরিবর্তন, দুরবস্থানের পরিবর্তন৷ শৈশবে দাদা- দাদী, নানা- নানীর মুখ থেকে শোনা ঠাকুমার ঝুলি, রূপকথা মনের গহীনে লালন করে চলে… ‘বাস্তব' যখন হতাশা বঞ্ছনায় বিষিয়ে যায় তখন অবচেতন মন চায় রূপকথার সোনার কাঁঠি, রূপার কাঁঠি তাঁর অবস্থা, অবস্থানের পরিবর্তন করে দিক রাতারাতি স্বপ্নের মতো ৷ যুগ যুগ ধরে শিক্ষার অভাব, কুসংস্কার, অভাব, অনটন, সামাজিক অন্ধ রীতিনীতি, দম বন্ধ করা পরিবেশ মানুষকে ধাবিত করে অলৌকিক অবাস্তব জিনিসের প্রতি৷ সাময়িক সান্তি দেয় কল্পনার রাজ্যে নিয়ে গিয়ে৷ সেই কল্পনার রাজ্যে নেই দুঃখ, জরা, রোগ, শোক, অভাব, অনটন ৷ উপায়ন্তর অসহায় মানুষ বুঁদ হয়ে থাকে তাতে নেশাগ্রস্তের মতো৷ খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, বিচার ব্যবস্থার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের সমাজব্যবস্থা ব্যার্থ৷ প্রশাসনের চোখ বন্ধ৷ 

এমতবস্থায় একটি ‘ফুঁ’ যদি পারে কিছু বদলে দিতে, সমস্ত দুঃখ ধূলার মতো উড়িয়ে দিতে, দীর্ঘদিনের সমস্যার বেড়াজাল থেকে মুক্তি দিতে… তো ক্ষতি কি! গুটিকয়েক মানুষ ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো' বৃহত্তর গোষ্ঠীর এই অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে ‘টু- পাইস’ কামিয়ে নিতে ব্যাস্ত৷ দিনে দুপুরে মানুষ ঠকানোর এই পদ্ধতি দ্যাখে প্রশাসনও চোখবন্ধ করে নিজের ‘কমিশন' বুঝে নিয়ে চুপ করে আরামে দিন কাটায়৷ কে করে বাড়তি পরিশ্রম৷ আপনার কাজ নাই, তাই রোজগারও নাই৷ আছে ক্ষুধায় উদগ্রীব মুখ৷ অসুখ আছে, চিকিৎসার টাকা নাই৷ টাকা আছে, চিকিৎসা নাই৷ অভিযোগ করবেন? নিরাপত্তা নাই, বিচার নাই৷  সর্বোপরি নাই সুশিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, এমনকি নাই সঠিক ধর্মীও শিক্ষা৷ কে দেবে এসব?!! কোথা থেকে আসবে?!! সবাই ব্যাস্ত ‘শর্টকাটে’ ৷ শর্টকাটে কি করে ক্ষমতাবান হওয়া যায়, শর্টকাটে কি করে ধনী হওয়া যায়, শর্টকাটে কি করে পারা যায় একটা ‘ফুঁ’ দিয়ে সব উড়িয়ে দিতে! তাইতো আজ সর্বত্রই সর্বসমক্ষেই ঝাড়ফুঁক, পানিপড়া, তন্ত্রমন্ত্র, লটারি, জুয়া, চুরি, ডাকাতি, বাটপারি, খুন, ছিনতাই, রাহাজানি…পরিশে…আহাম্মকের (অথবা অসহায়ের) দল এতটাই ভারী যে জোচ্চোর হুজুর আর আলাদা আলাদা করে ‘ফুঁ’ দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না, মাইকে একসাথে একবারেই ‘ফুঁ’ উড়িয়ে দেয় জাতির উন্নয়ন আর প্রগতির ধ্বজা…

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান