করোনা-গরিবদের বাঁচানোর বাজেট চাই
৩১ মে ২০২১নির্মাণ শ্রমিক হাসানের আয় নির্ভর করে প্রতিদিনের কাজের উপর৷ করোনার আগে গাজীপুরে একজন ঠিকাদারের অধীনে তিনি কাজ করতেন, দৈনিক সাড়ে ৫০০ টাকা মজুরিতে৷ পাশাপাশি আরো কিছু কাজ মিলিয়ে মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা তার হাতে আসত অনায়াসে৷ তবে সময়টা এত দ্রুত বদলে যাবে সেটি অনুমাণ করেননি মোটেও৷ জুলাই নাগাদ কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়৷ ফিরে যান নিজ জেলা নোয়াখালীতে৷ তিনমাস বেকার বসে থাকতে হয়েছে তাকে৷ অক্টোবর নাগাদ একটি কাজ জোটে, কিন্তু স্বস্তি ফেরেনি তাতে৷ হাসান জানান, ‘‘গত দুই-তিন মাস ধরে একদিন কাজ হলে তিনদিন হয় না৷ কাজ না হলে টাকাও নাই৷ তারমধ্যে মজুরি ঠিকঠাক পাই না৷ মাসে পাঁচ হাজার টাকাও জোটে না৷’’
করোনা যাদের দারিদ্র্যরেখার নীচে নামিয়ে এনেছে হাসান তাদেরই একজন৷ তার মতো এমন মানুষের সংখ্যা মোটেও কম নয়৷ পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপের ফলাফল অনুযায়ী সেটি দুই কোটি ৪৫ লাখ৷ গত মার্চ পর্যন্ত মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এত বিপুল মানুষের আয়ের স্তরে এই পরিবর্তন এসেছে৷
সরকারের হিসাবে ২০১৮-১৯ সালে জনসংখ্যার সাড়ে ২০ শতাংশ বা সোয়া তিন কোটি মানুষ দরিদ্র ছিল৷ অর্থাৎ নতুনসহ প্রায় ছয় কোটি মানুষ এখন দারিদ্র্যের কাতারে রয়েছেন৷ এর আগে বাংলাদেশের আরেক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং- সানেমের জরিপেও এমন তথ্য উঠে এসেছে৷ গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে৷
ঠিক এমন এক বাস্তবতায় আগামী বৃহস্পতিবার ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার৷
দারিদ্র্যের কাতারে নেমে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত
করোনায় বিপুল পরিমান মানুষ চাকরি হারিয়েছে৷ অনেকের কমে গেছে আয়৷ বিভিন্ন জরিপেও তা ধরা পড়েছে৷ গত বছর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস এর এক জরিপে দেখা যায় করোনার কারণে নতুন করে ১৩ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছে৷ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলছে মহামারির কারণে লকডাউনের প্রথম ধাক্কায় কাজ হারিয়েছিলেন ৬০ ভাগ মানুষ৷ তাদের অনেকে পরবর্তীতে কাজে ফিরলেও আয় কমে গেছে৷ সানেম এর আরেক জরিপে ৬২ শতাংশ কর্মী ও শ্রমিক বলেছেন, ২০২০ সালের মার্চ-ডিসেম্বরে তাদের মজুরি আগের বছরের চেয়ে কমেছে৷
এই ধাক্কায় বিপাকে আছেন মধ্যবিত্তরাও৷ সানেমের প্রধান নির্বাহী ড. সেলিম রায়হান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তরাও যথেষ্ট সংকটে পড়েছেন৷ আমাদের গবেষণায়ও তাই উঠে এসেছে৷... হিসাবে দেখা যাচ্ছে আড়াই কোটি থেকে সাড়ে তিন কোটি নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন৷ তাদের মধ্যে একটা বিশাল অংশ নিম্ন মধ্যবিত্ত বা নিম্ন আয়ের মানুষ৷ তারা দরিদ্র ছিল না এর আগে৷ তাদের একটা বড় সমস্যা হল এই পরিবারগুলোর আগে কোনো মানুষ বা সরকারের কাছে আর্থিক সহযোগিতা চাওয়া বা পাওয়ার সুযোগে ছিল না৷ ...এই সংকটের সময় তারা ঠিক সাহায্যও চাইতে পারছেন না৷ তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য কোন ম্যাকানিজমও নেই পরিস্কার৷’’
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে তেমনই একজন ব্যক্তি সরকারের তথ্য সহায়তা কেন্দ্রে ফোন করে খাদ্য চেয়ে উলটো শাস্তি পেয়েছিলেন৷ এই খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে ব্যাপক সমালোচনা হয়৷ পিপিআরসি এর নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমানও বলেন, ‘‘মধ্যবিত্তের একটা অংশ নতুন দরিদ্রদের মধ্যে ঢুকে গেছে৷ এমনও আমরা দেখেছি, শিক্ষক ছিল কিন্তু কাজ না পেয়ে অদক্ষ একটা কাজ করতে হচ্ছে৷’’
তিনি মনে করেন, তাদের জন্য মূলত খাদ্য বা ভাতা নয় প্রয়োজন নগদ অর্থ সহায়তা, ‘‘এককালীন একটা টাকা দেয়া গেলে তাদের জন্য সঙ্গত হতো৷ এর বাইরে এরা অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে চায়৷ সেখানেও সহযোগিতা দরকার,’’ বলেন এই অর্থনীতিবিদ৷
বদলাতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি
দরিদ্র ও বঞ্চিতদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি নামে সরকারের একটি কর্মসূচি রয়েছে৷ গত বছর বাজেটেও এ খাতে এক কোটির কিছু বেশি মানুষের জন্য বিভিন্ন ভাতা বাবদ অর্থ বরাদ্দ করেছিল সরকার৷ প্রতিবারের ধারাবাহিকতায় এ বছরও তার আওতা কিছুটা বাড়বে বলে জানা যাচ্ছে৷ কিন্তু অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, করোনার বাস্তবতায় দারিদ্র্যের চিত্রে যে পরিবর্তন এসেছে শুধু এই কর্মসূচি দিয়ে তা মোকাবিলা করা যাবে না৷
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘‘আমাদের সামাজিক নিরাপত্তার যে কর্মসূচি সেটা মূলত গ্রামীণ দরিদ্রদের নিয়ে৷ নগর দরিদ্রদের নিয়ে কোন কর্মসূচি নাই৷ এই বাজেটে এই নগর দরিদ্রদের একটা বড় সহযোগিতা দেয়া দরকার৷ দ্বিতীয়ত, নতুন দরিদ্র যারা তারা কিন্তু ৫ কেজি, ১০ কেজি চালের সহযোগিতা চাচ্ছে না৷ তারা দারিদ্র্যের উপরে অবস্থান করছিল কিন্তু এখন পড়ে গেছে৷ ওদের আর্থিক সহায়তা দরকার৷''
তিনি বলেন, সরকার গত বছর ক্ষতিগ্রস্তদের আড়াই হাজার টাকা করে দেয়া শুরু করেছিল৷ ৩৪ লাখ মানুষ সেই টাকা পেয়েছেন৷ তবে এই তালিকা নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে৷ ব্র্যাকের এই চেয়ারম্যান মনে করেন, শুধু পুরাতন দরিদ্র নয়, যেই ২ কোটি ৪৫ লাখ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে, সবারই এমন সহযোগিতা দরকার৷
কিন্তু সমস্যা হলো পুরাতন বা নতুন, দেশের দরিদ্র মানুষের সঠিক কোনো পরিসংখ্যানই নেই সরকারের কাছে৷ ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘‘যারা পুরনো তাদেরই সঠিক তথ্য নেই৷ এজন্য তাদেরই সহায়তা দিতে গিয়ে সরকার নানা ধরনের সমস্যায় পড়েছে আমরা গত বছর দেখেছি৷ এখন নতুন করে যারা দরিদ্র হয়েছেন তাদের তালিকাতো কিছুই নেই৷ কোন ধরনের তথ্যই নেই সরকারের কাছে৷ সুতরাং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি যেভাবে বাজেটে প্রস্তাব করা হয় গতানুগতিকভাবে, সেই গতানুগতিক প্রক্রিয়া ও কর্মসূচির মাধ্যমে পুরনোদের কাছে পৌঁছানোর সমস্যা আগেই আছে, নতুনদের কাছে পৌঁছানো আরো ভয়ানক সমস্যা৷ আমি মনে করি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন কর্মসূচি দরকার৷ শুধু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বা তার বরাদ্দ ঘোষণা করাই যথেষ্ট নয় নিশ্চিত করতে হবে এই বরাদ্দ যাতে পৌঁছতে পারে, নতুন ও পুরাতন দরিদ্র যারা তাদেরকে আইডেন্টিফাই করা যায়৷’’
কিন্তু প্রশ্ন হলো এমন চিন্তা কতটা রয়েছে সরকারের? বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা নতুন দারিদ্র্যের তথ্য দিলেও তা বিবেচনায় নিচ্ছে না সরকার৷ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, শুধু সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যই তারা গ্রহণ করবেন৷ কিন্তু সেই পরিসংখ্যান এখনও করেনি সংস্থাটি৷
ড. সেলিম বলেন, ‘‘আমি যেটা মনে করি সরকারি নীতিনির্ধারক যারা আছেন তাদেরকে একনলেজ করতে হবে পরিস্থিতি৷ যদি তারা মনে করেন এরকম হয়নি তাহলে কিন্তু এই দরিদ্র জনগোষ্ঠী যারা খুবই সংকটে আছেন তাদের সহযোগিতা করতে পারবেন না৷ দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের চিহ্নিত করে তাদের সহযোগিতায় সহায়তা পৌঁছে দিতে হবে৷ ....বাজেটে আমি চাই শুধু বরাদ্দ না এই ম্যাকানিজমগুলো সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়া৷’’
তার মতে, পুরো বাজেটের প্রধান মনযোগ থাকা উচিত তিন জায়গায়৷ দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং অবশ্যই স্বাস্থ্যখাত৷ তা না করে গতানুগতিকভাবে অন্যান্য বছরের মতো করে বাজেট প্রণয়ন করা হলে ‘বর্তমান ভয়াবহ সংকট’ থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন হবে৷