1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

করোনায় আদালত: প্রিয় পেশা ছাড়ছেন অনেকে

এম এম খালেকুজ্জামান ঢাকা
২৫ জুন ২০২১

লালনের গানের মতো অপার হয়ে বসে আছেন প্রিয়ম বালা চাকমা৷তিনি অনিমেষ আর অনির্বাণের মা৷ এফআইআরে নাম না থাকা সত্ত্বেও সন্দেহজনকভাবে গ্রেফতার উপার্জনক্ষম তার দুই সন্তানই এখন কারাগারে৷

https://p.dw.com/p/3vXd7
ঢাকার এক আদালত
ছবি: Mortuza Rashed/DW

করোনার কারণে ছয় মাস কারাগারে থাকতে হয় এক হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দুই ভাইকে৷ স্বাভাবিক সময় হলে হয়ত উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়ে মামলা চালাতে পারতেন ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর এই দুই তরুণ৷ করোনা পরিস্থিতি তাদের সে অধিকার থেকেও বঞ্ছিত করে৷হঠাৎই আদালত কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই দুই ভাইয়ের মতো অনেক বিচারপ্রার্থীই নানা বিড়ম্বনার শিকার হন৷

অথচ ওই দুই ভাইয়ের মামলা কিন্তু শুনানির জন্য কার্যতালিকাতেও ছিল৷ শুনানি না হওয়ার কারণে তাদের কারামুক্তি অনিশ্চয়তায় পড়ায় মামলা পরিচালনাকারী তরুণ আইনজীবীও পড়েন নিদারুণ অনিশ্চয়তায়৷ কারণ, লকডাউন শুরু হওয়ার আগে সেটাই ছিল তার হাতে থাকা একমাত্র মামলা৷

অনেকের মতো আইন পেশা সংশ্লিষ্টদেরও চরম অনিশ্চয়তায় ফেলেছে লকডাউন৷ সঞ্চয়হীন আইন পেশার মানুষেরা আর প্রিয়ম বালা চাকমা একই অনিশ্চয়তার নিদারুণ শিকার৷

গত বছরের ৮ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের তথ্য জানায় সরকার৷ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ২৩ মার্চ প্রথমবার সাধারণ ছুটির ঘোষণা দেয়া হয়৷ শুরুতে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি দেওয়া হলেও পরে ছুটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়৷ সব মিলিয়ে গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত দেশজুড়ে ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ছিল৷সে সময় সব অফিস-আদালত, কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়৷যদিও সাংবিধানিক আদালত কখনোই বন্ধ থাকতে পারে না৷ কেননা, জরুরি সাংবিধানিক বিষয় শুনতে হয় উচ্চ আদালতকে৷ অথচ এই অভূতপূর্ব ঘটনাও তখন ঘটেছিল৷

গত প্রায় এক মাস ধরে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার ও মৃত্যুর সংখ্যা ঊর্ধমূখী৷ মনে হচ্ছে, ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তারে দেশে করোনা সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে৷ সীমানার ওপারের অভিজ্ঞতা থেকে এটি সুস্পষ্ট, ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট আগের সব ধরন থেকে অনেক বেশি সংক্রামক এবং এর দ্বারা মৃত্যুর হারও অপেক্ষাকৃত বেশি, যা ইতিমধ্যে জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তায় ব্যাপক উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে৷ আবার এমন প্রেক্ষাপটে নিম্ন আদালতের সব পর্যায়ে শারীরিক উপস্থিতিতে বিচার কাজ শুরুর অনুমতি দিয়েছে সরকার৷এবং বিচারিক ও আইন পেশা সংশ্লিষ্টদের অব্যাহত দাবির মুখে সেই সাথে মামলা-জট  বিবেচনায় এ ছাড়া ভালো বিকল্পও ছিল না৷

আইন পেশা জনসম্পৃক্ত পেশা৷ জনসম্পৃক্ত পেশাজীবীদের মধ্যে আইনজীবীদের করোনায় মৃত্যুহারও আশঙ্কাজনক৷ ১৯ জানুয়ারি করোনাকালে আইনজীবীদের মৃত্যুতে সুপ্রিম কোর্টের শহীদ শফিউর রহমান মিলনায়তনে এক স্মরণসভার আয়োজন করা হয়৷ সেই স্মরণ সভায় জানানো হয়, ২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে সুপ্রিম কোর্টের কয়েকশ আইনজীবী ও বিচারপতি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন৷ এ সময়ের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১২৫ জনের৷ তাদের মধ্যে দুজন বিচারকও রয়েছেন৷ (সূত্র: সারাবাংলা ডটনেট)৷

সাবেকি, একইসাথে প্রথানিবিড় আইন ও বিচারব্যবস্থায় কিছু রীতি সনাতনী মনে হলেও তাৎপর্যপূর্ণ৷ প্রতিষ্ঠিত রীতিতে সামান্যতম পরিবর্তনও আইন ও বিধির যথাযথ সংশোধনীর মাধ্যমেই আনতে হয়৷গত বছরে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে প্র্রায় প্রস্তুতিহীনভাবে অ্যাকচুয়াল (শারীরিক) থেকে ভার্চুয়াল স্তরে উত্তীর্ণ হয় বিচার কাজ৷ রাষ্ট্রের তিন বিভাগের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিচার বিভাগ প্রায় দেড় মাসের নীরবতা কাটিয়ে ওঠে হালদা নদীর ডলফিন বাঁচানোর রিটের মধ্য দিয়ে৷ সেদিন থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে স্বল্প পরিসরে আদালতে আইনি সেবা দান শুরু হয়, চলেছিল আগস্টের ৮ তারিখ পর্যন্ত৷

এম এম খালেকুজ্জামান, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
এম এম খালেকুজ্জামান, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টছবি: Private

মানুষ তৎক্ষণাৎ প্রাপ্তি খুব পছন্দ করে৷ লাইনে না দাঁড়িয়ে আগে বাসে ওঠা হোক আর মামলা জমা দিয়ে পরের দিনেই লিস্টে এনে শুনানি সম্পন্ন করাই হোক৷ ই-জুডিশিয়ারি, ভার্চুয়াল আদালত- এই নতুন দিনের শব্দগুলো যে দ্রুততার দ্যোতনা সৃষ্টি করে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরাও জানেন বাস্তবতা তেমন না৷ যে কারণে শরীরি উপস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আদালত খুলে দেওয়ার বিষয়ে আইনজীবীদের বিরাট অংশ আন্দোলন ও প্রতিবাদ ইত্যাদি কার্যক্রমে মুখর ছিল জীবন ও জীবিকার ভারসাম্য আনতে৷

আইন পেশার প্রাথমিক সংগ্রাম-মুখরতা সর্বজন বিদিত৷এই পেশায় নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বেতন কাঠামো, অনেকটা সিনয়র নির্ভর জুনিয়রদের বেতন ভাতা ইত্যাদি৷ এই করোনাকালে অনেক নবীন আইনজীবীই অর্থসংকটে পড়েছেন৷ বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জেলার আইনজীবী সমিতি কিছু এককালীন প্রণোদনা দিয়েছে৷ সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন থেকেও দেয়া হয়েছে ঋণ (যদিও সরকার গত বছর এক লক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়, কিন্তু তাতে আইনজীবী অন্তর্ভূক্ত ছিল না) কিন্তু তা যথেষ্ট অপ্রতুল৷ হার-জিতের যে ক্রীড়াসুলভ অন্তর্গত অনিশ্চয়তা, সেটি আইন পেশার অন্যতম এক বৈশিষ্ট্য৷ জুনিয়র আইনজীবীরা মামলায় যথাযথ ফলাফল নিশ্চিত করতে না পারলে শুধু খেলায় পার্টিসিপেশন ফি'র মতো মামলার ফাইলিং ফি'র কিছু পরিমাণ পান, সিনিয়র আইনজীবীদের এ সমস্যা নেই৷ স্বাভাবিক সময়ের প্রেক্ষপটে এসব অনিশ্চয়তা জেনেও প্রতিবছর অনেক আইনজীবী তালিকাভুক্ত হন৷ কিন্তু করোনার অভিঘাতে গত কয়েক মাসের তুলনাহীন পেশাগত অচলাবস্থা অনেক তরুণ আইনজীবীর পেশা ও জীবিকানির্ভর সামাজিক জীবনকে রীতিমতো অনিশ্চিত করে তুলেছে৷ অনেককে প্রিয় পেশা পরিবর্তনের মতো অপ্রিয় পদক্ষেপও নিতে হয়েছে৷