কেন এত রাগ, কেনইবা এত গালির কলুষ?
২৩ এপ্রিল ২০২১সবজি, মাছ, মাংস থেকে শুরু করে টমেটো, লেবু পর্যন্ত যাতেই হাত দিন, ছ্যাঁকা লাগবে৷ তেমনই, চারপাশে যে দিকে তাকান, দেখবেন শুধু ক্রুদ্ধ মানুষজন৷ রাগ এবং উত্তেজনার পারদ কেবল বাড়ছে৷ টিভির বিতর্কে চোখ রাখলে মনে হবে, রেগেমেগে, উত্তেজনায় রাজনীতিক বা উপস্থাপকের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে৷ গলা ব্যাথা তো হবেই৷ এখনই একজন আরেকজনের উপর চড়াও হয়ে যাবেন৷ সংসদের অধিবেশন কোনোদিন শান্ত থাকাটাই খবর৷
ক্রিকেট বা ফুটবল দেখুন, মনে হবে খেলা নয় যুদ্ধ চলছে৷ দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে, একে অন্যের দিকে তেড়ে গিয়ে একাকার কাণ্ড৷ রেফারি পেনাল্টি দিলে বা হলুদ কার্ড দেখাতে গেলেই যাচ্ছেতাই দৃশ্য৷ ভদ্রলোকের খেলা বলে পরিচিত ক্রিকেটে এখন আম্পায়ারও ছাড় পাচ্ছেন না৷ ক্রিকেটাররা একে অন্যের দিকে হামেশাই তেড়ে গিয়ে চেঁচাচ্ছেন৷ যে কথাগুলো বলছেন, তা একেবারেই শ্রুতিমধুর নয়৷
সামাজিক মাধ্যমের অবস্থা তো কহতব্য নয়৷ কোনো যুক্তিসঙ্গত মন্তব্য করলে বা মত না মিললেই কিছু মানুষ রে রে করে তেড়ে আসবেন৷ গালাগালি দেবেন৷ কোন দলের এজেন্ট তা জানতে চাইবেন৷ ১৪ পুরুষ উদ্ধার করে দেবেন৷ তার মধ্যে যদি দুই অক্ষরের গালাগালি থাকে তা হলে বুঝতে হবে অল্পের উপর পার পাওয়া গেল৷ না হলে চার বা ততোধিক অক্ষরের গালাগালির স্রোত বইবে৷ গালাগলি নিয়ে একটা তত্ত্ব আছে৷ গালি দিলে নাকি মনের ক্লেদ দূর হয়৷ তা মানুষের মনে অন্তহীন ক্লেদ আছে নাকি!
নাকি এটা পুরোপুরি পরিচয়ের সংকট, আইডেনটিটি ক্রাইসিস? অথবা মানসিক চাপের প্রেসার কুকারে ক্রমাগত সেদ্ধ হতে হতে সর্বত্র বেরিয়ে আসছে অস্থিরতা, রাগ, হতাশা, খারাপ ব্যবহার৷ কোনো নিয়মকানুনই আর মানতে চাইছে না মানুষ৷ না হলে পরিচয়পত্র দেখতে চাওয়া বা তা যাচাই করতে চাওয়া এমন কী আর গুরুতর ব্যাপার! এটা তো পুলিশ বা টোল বুথ কর্মীদের কাজের অঙ্গ৷ সেটাই করতে চেয়েছিলেন নয়ডা এক্সপ্রেসওয়ের একটি টোল বুথের কর্মীরা৷ সেখানে বাসে করে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা যাচ্ছিলেন৷ তাতে একজন এমএলএ বা বিধায়কের স্টিকার লাগানো ছিল৷ টোল কর্মী যাচাই করে দেখতে চেয়েছিলেন, সেই স্টিকারটা ঠিক কিনা৷ কিন্তু তাতে কান না দিয়ে শুরু হলো মারধর৷ একে রাজনৈতিক দলের কর্মী, তার উপর বিধায়কের স্টিকার বলে কথা৷ তাদের তো যেতে দিতেই হবে৷ নিয়ম থাক বা না থাক৷
করোনার আগে প্রায়ই খবর আসতো, সাংসদ গিয়ে টোলের কর্মীদের মেরেছেন, তার সমর্থকরা টোল ভাঙচুর করেছেন৷ কেন? তারা তো সচরাচর একটা গাড়ি নিয়ে ঘোরেন না৷ সঙ্গে একাধিক গাড়ির মিছিল থাকে৷ তাদের কাছে টোল চাওয়া হয়েছিল৷ ব্যস, আর যায় কোথায়? ২০১৮, ২০১৯-এ উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থানে এরকম ঘটনা প্রচুর ঘটেছে৷
২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি ইন্ডিয়া টুডে ওয়েবসাইটে একটা রিপোর্টে অনেকগুলি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছিল, যেখানে মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীরা সরকারি কর্মীদের চড় মেরেছেন বা গায়ে হাত তুলেছেন৷ সেই তালিকা অনুযায়ী, মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান তার দেহরক্ষীকে একটি জনসভায় চড় মেরেছিলেন৷ কারণ, জানা নেই৷ হিমাচলে কংগ্রেসের বিধায়ক আশা কুমারী চড় মেরেছেন একজন নারী কনস্টেবলকে৷ কারণ, ওই কনস্টেবল তার গাড়ি থামিয়েছিলেন৷ শিবসেনার সাংসদ বিমানকর্মীকে জুতোপেটা করেছিলেন৷
গ্যাস পাইপলাইনের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে গেছিলেন বলে একজন জেলা কালেক্টরকে মেরেছিলেন মহারাষ্ট্রে এনসিপি-র বিধায়ক৷ রাজস্থানে পুলিশ কর্মী চালান কেটেছিল বলে তাকে পিটিয়েছিলেন বিজেপি বিধায়কের স্বামী৷ মহারাষ্ট্রে এক বিজেপি বিধায়ক থানায় গিয়ে পুলিশকে মেরে এসেছিলেন৷
আর কত ঘটনার উল্লেখ করবো৷ এই ঘটনাগুলো কিন্তু পুলিশ বা সরকারি কর্মীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজনীতিকদের আক্রোশ নয়৷ বরং, তারা এখানে পরিচয় সংকটে ভুগেছেন৷ পুলিশ বা সরকারি কর্মীরা আইন মেনে কাজ করেছেন৷ কিন্তু বিধায়ক, সাংসদের মনে হয়েছে, তিনি এত ক্ষমতাবান হওয়ার পরেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলো৷ এত সাহস হয় কী করে? হয় তাকে চেনার পরেও পুলিশ বা সরকারি কর্মী ব্যবস্থা নিয়েছে, পরিচয় দেয়ার পরেও থামেনি, অথবা তিনি যে নিয়ম কানুনের বাইরে সেটা পুলিশ মানেনি৷
ডয়চে ভেলেতেই দিন কয়েক আগে খবর প্রকাশিত হয়েছিল, নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী অ্যারনা সোলব্যার্গকে আমাদের হিসাবে প্রায় দুই লাখ টাকা জরিমানা করেছে পুলিশ৷ কারণ, তিনি করোনার নিয়ম ভেঙেছিলেন৷ জন্মদিনে ১০ জনের বদলে ১৩ জনকে নিয়ে বাইরে খেয়েছিলেন৷ ভারত বা এই উপমহাদেশে কবে যে এরকম হবে!
স্টিকার নিয়ে পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ভিআইপি-দের ঝামেলা তো হামেশাই হয়৷ এক পুলিশ কর্তা জানিয়েছিলেন, আজকাল যে কোনো স্টিকারের হুবহু নকল করা যায়৷ তার বক্তব্য ছিল, ভুলে যাবেন না, নকল স্টিকার গাড়িতে লাগিয়ে ভারতের সংসদ ভবন আক্রমণ করেছিল জঙ্গিরা৷ তাই স্টিকার থাকা সত্ত্বেও পরিচয়পত্র দেখা বা তা যাচাই করা জরুরি৷ আর উপমহাদেশে এই স্বাভাবিক ঘটনা ঘটলেই দেখা যায় অস্বাভাবিক রাগ৷ এই অস্বাভাবিকতাই এখন নিয়ম৷