1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘ক্ষমা না চাইলে পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক অর্থহীন’

৩ ডিসেম্বর ২০২১

বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ধরে রাখতে হলে পাকিস্তানকে গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে হবে৷ নয়তো ওই দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ধরে রাখার দরকার নেই বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷

https://p.dw.com/p/43nZD
Bangladesch Historische Bilder
ছবি: Journey/A. Hoque

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে ভয়াবহ গণহত্যার দায় স্বীকার করে পাকিস্তান এখনো ক্ষমা চায়নি৷ বাংলাদেশের পাওনা সম্পদও ফেরত দেয়নি৷ বরং অনেক বিষয়ে এখনো বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই দেশটির অবস্থান৷ যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে প্রকাশ্যেই মদত দিয়ে যাচ্ছে৷ বাংলাদেশে পাকিস্তান দূতাবাসের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতায় সহায়তার অভিযোগও আছে৷

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান, তারপর দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়৷ তবে কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের অভিমত এই পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখার কোনো মানে হয় না৷ তবে দেশটি যদি গণহত্যার দায় স্বীকার করে সেদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সহায়তা ও একাত্তরের জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে সত্যিকার অর্থে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে আগ্রহ দেখায় তাহলে আলাদা কথা৷

বাংলাদেশ সরকার বার বার একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে৷ দেশে ও দেশের বাইরে বাংলাদেশি নাগরিকরাও বার বার এই দাবি তুলছেন। এমনকি পকিস্তানের নাগরিকদের একাংশও বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে তাদের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে৷

গত ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম পাকিস্তানকে আবারো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে বলেন৷ ঝুলে থাকা দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলোরও সুরাহা করতে বলেন৷ বাংলাদেশে পাকিস্তানের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এই বিষয়গুলো তুলে ধরেন৷

শাহরিয়ার কবির

সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি সিরিজের অনুশীলনের সময় বাংলাদেশের মাঠে পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা কোনো অনুমতি ছাড়াই তাদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন৷ বিষয়টি বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে৷ ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের একটি সংগঠন এর প্রতিবাদে নানা কর্মসূচি পালন করে৷ সংগঠনটির সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা পাকিস্তারের সাথে কূটনৈতিকসহ সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানিয়ে আসছি৷ আমরা ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধার রক্ত, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেলাম৷ কিন্তু সেই পরাজিত পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে৷ তারা এখনো বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারছে না৷ এই দেশে তাদের সহযোগীরা এখনো আছে৷ তাদের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে৷’’

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান নানাভাবে মুসলিম বিশ্বকে দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য প্রভাবিত করেছে৷ তারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে৷ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তান দূতাবাসের দুই কূটনীতিক৷ শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলিম চৌধুীর কন্যা ড. নজুহাত চৌধুরী বলেন, ‘‘বাংলাদেশের পাকিস্তান দূতাবাস পাকিস্তানি গোয়েন্দা আইএসআই-এর অফিসে পরিণত হয়েছে৷ তারা এখানে বসে নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে৷ বাংলাদেশে পাকিস্তনি দূতাবাস রাখার কোনো মানে হয় না৷ দুটি দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকবে এটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু পাকিস্তানের কথা আলাদা৷ তারা এই দেশে জেনোসাইড-এর জন্য দায়ী৷ তাই তাদের সবার আগে ক্ষমা চাইতে হবে৷ কিন্তু তারা তো ক্ষমা চায়নি৷ তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যারা এই জেনোসাইডে জড়িত তাদের বিচার এখনো করেনি৷ উল্টো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে৷ এ ধরনের দুষ্ট রাষ্ট্রের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখার বিরোধী আমি৷’’

বাংলাদেশে যুদ্ধপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান সেটা বানচালের নানা ষড়যন্ত্র করেছে৷ তারা তাদের এদেশীয় দোসরদের বাঁচাতে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব এনেছে৷ শুধু তাই নয়, সেখানকার রাস্তায় যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থনে মিছিলও হয়েছে৷

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক শাহরিয়ার কবির মনে করেন, ‘‘পাকিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সীমিত পর্যায়ে কূটনেতিক সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন৷ কিন্তু বাংলাদেশে তাদের এত বড় দূতাবাসের কোনো দরকার নেই৷’’

তিনি বলেন, ‘‘গণহত্যার প্রধান অপরাধী পাকিস্তান৷ পাকিস্তান এখনো তাদের বিচার করেনি৷ কিন্তু আমরা পারি৷ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আমাদের যে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আছে, সেখানে তাদের বিচার করা যায়৷ আর পাকিস্তানকে আমাদের ক্ষমা চওয়ার জন্য চাপ দিতে হবে৷ গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করতে হবে৷ আমাদের পাওনা সম্পদ এখনো তারা ফেরত দেয়নি৷ সেটা ফেরত দিতে হবে৷’’

শাহরিয়ার কবির আরো বলেন, ‘‘এসব না করে উল্টো তারা (পাকিস্তান) বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত৷ তাদের দূতাবাস জঙ্গিদের মদত দেয়৷ স্বাধীনতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কাজ করে৷’’

Schweiz Genf | Konferenz zur anerkennung des Genozid in Bangladesch 1971
পাকিস্তান যাতে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায় চলতি মাসে নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে আয়োজিত একটি সম্মেলন থেকে এই দাবি জানানো হয়ছবি: privat

বাংলাদেশ বার বার আহ্বান জানালেও পাকিস্তান এখনো ক্ষমা না চাওয়ার ব্যাপারে অনঢ়৷ ২০০৯ সালে পকিস্তানের দূত আলী বাসার খান দেখা করতে এলে তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সাথে পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন৷ কিন্তু আলী বাসার বলেন, ‘‘পকিস্তান ক্ষমা চাইবে না৷’’

গত অক্টোবরে ঢাকায় পাকিস্তান দূতবাসের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়৷ ৯ অক্টোবর ঢাকায় পাকিস্তান রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর প্রতিবাদ জানালে তারা ভিডিওটি সরিয়ে ফেলে৷

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের একটি অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটুক্তি করা হয়৷

গণহত্যার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ক্ষমা চাইলেও একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের এখনো ক্ষমা না চাওয়ার বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘পাকিস্তানের সব ধরনের পাঠ্যপুস্তকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, অপব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে৷ ফলে সেখানকার যারা নতুন প্রজন্ম, তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা নিয়ে বড় হচ্ছে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘তারা যদি সত্যিকার অর্থে ক্ষমা প্রার্থনা করতো, অনুতপ্ত হতো, তাহলে এই কাজগুলো করতো না৷ জাপানিরা ক্ষমা চেয়েছে৷ জার্মানি অহরহ ইহুদিদের ওপর অত্যাচারের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে যাচ্ছে৷ ক্ষমা চাইলে কেউ ছোট হয়ে যায় না৷ এটা পাকিস্তানিদের বোঝানো কঠিন৷’’

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ

তিনি মনে করেন, ‘‘এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়৷ আওয়ামী লীগের একটি নীতিগত জায়গা আছে৷ সেখানে তারা ছাড় দেবে না৷ পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ানোর ব্যাপারে তারা অনঢ়৷’’

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, ‘‘পাকিস্তান সরকার এখন বাংলাদেশের নানা ধরনের উন্নয়নের প্রশংসা করলেও আসল জায়গায় তাদের মনোভাবের পরিবর্তন আসেনি৷ তারা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি৷ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় তারা তাদের পার্লামেন্টে হইচই করলো৷ তবে তাগিদ বা প্রয়োজন পাকিস্তানের৷ আমাদের তেমন কোনো প্রয়োজন নেই৷ তাই পাকিস্তান যদি চায় তাহলে তাদের মনোভাবে পরিবর্তন আনতে হবে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘তারা আমাদের পাওনাও ফেরত দেয়নি৷ আমরা কিন্তু স্বাধীনতার পর যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সহায়তা বাবদ ঋণের আমাদের অংশ ফেরত দিয়েছি৷’’

পাকিস্তান সরকারের ওপর তারপরও চাপ প্রবল হচ্ছে৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দাবি জানানো হচ্ছে পাকিস্তান যাতে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়৷ চলতি মাসেই নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে আয়োজিত একটি সম্মেলন থেকে এই দাবি জানানো হয়৷ ইউরোপভিত্তিক প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরাম (ইবিএফ) সুইজারল্যান্ড মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশের সহযোগিতায় আয়োজিত সম্মেলনে একাত্তরের গণহত্যার জন্য বাংলাদেশের জনগণের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে পাকিস্তান সরকারকে চাপ দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দাবি জানানো হয়৷ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, একাত্তরের গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিয়ে ৩০ লাখ শহিদ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন একান্ত প্রয়োজন৷ মানবাধিকার লঙ্ঘনমুক্ত বিশ্ব গঠন এবং বিশ্বজুড়ে পরবর্তী প্রজন্মের নিরাপত্তার জন্য গণহত্যার স্বীকৃতি অপরিহার্য৷ বিশ্ব সম্প্রদায় যদি কোনো অপরাধকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে ভবিষ্যতে সেই অপরাধ পুনরায় ঘটানোর দরজা খোলা থাকে৷

এদিকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বিশ্বের ৫০টি দেশের পাকিস্তান দূতাবাসে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে স্মারকলিপি দিয়েছে বিশ্বব্যাপী প্রবাসীদের সংগঠন বাংলাদেশ প্রবাসী অধিকার পরিষদ৷

পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ ঢাকায় এই ডিসেম্বরে নিয়মিত কর্মসূচি পালন করছে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান