জার্মান তরুণদের সমস্যা
২৭ অক্টোবর ২০১২সম্প্রতি ২০তম আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হল বিশ্বের নানা দেশে৷ ১৯৯২ সাল থেকে দিনটি পালিত হচ্ছে৷ এই দিনে মানসিক অসুস্থতার নানা দিক ও এর প্রতিকার সম্পর্কে সেমিনার ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়৷
বিশেষ করে অল্পবয়সীদের মধ্যে যে মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা নিয়েও মাথা ঘামানো হয়৷ আলোচনায় উঠে এসেছে, ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় জার্মানির ছাত্রছাত্রীরা অনেক বেশি ডিপ্রেশনে ভোগে৷ আত্মহত্যার চিন্তা ও এমনকি চেষ্টাও করে তারা বেশি৷
অল্পবয়সীরা গুরুতর মানসিক সমস্যার শিকার
কিমের বয়স তখন ১৫, যখন উলরিকে ভল্ফ তাঁর মেয়ের গুরুতর মানসিক সমস্যাটা বুঝতে পারেন৷ ব্লেড ও ছুরি দিয়ে সে বারবার নিজেকে আহত করতো৷ জামার লম্বা হাতার নীচে এসব সে এমনভাবে লুকিয়ে রাখতো, যে কেউ তা বুঝতে পারতো না৷
উলরিকে জানান. ‘‘পরিবারের সদস্য হিসাবে বোঝা সহজ নয়, সন্তানের কী হয়েছে৷ সে যে অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় কিছুটা আলাদা, সেটা বোঝা যায়৷ কিন্তু এটা যে মানসিক অসুস্থতা তা কেউ ধারণা করতে পারে না৷''
আজ উলরিকে জানেন যে, কিমের জরুরি ভিত্তিতে মানসিক থেরাপির প্রয়োজন ছিল৷ নিজের শরীর কাটা, পোড়ানো বা আঘাত করা ইত্যাদি কিশোর কিশোরীদের মানসিক সমস্যার এক ধরনের বহিঃপ্রকাশ৷ বলেন হাইডেলব্যার্গ'এর ইউনিভার্সিটি ক্লিনিকের প্রফেসর রোমুয়াল্ড ব্রুনার৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আত্মমর্যাদার সমস্যা, দুঃখবোধ, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি মানুষের মধ্যে কমবেশি থাকে৷ কিন্তু এইসব সমস্যা তীব্র হলে ও ঘন ঘন দেখা দিলে বয়স্ক ও অল্পবয়সী সবার জন্যই ফলাফল মারাত্মক হতে পারে৷''
‘ইউরোপে তরুণ-তরুণীদের জীবনের সুরক্ষা ও তাদের ক্ষমতায়ন' – এই শিরোনামে অনুষ্ঠিত এক সমীক্ষায় ১০টি ইউরোপীয় দেশ ও ইসরায়েল অংশ নিয়েছিল৷ স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মানসিক সমস্যা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল৷ আট শতাংশ ছাত্রী উত্তর দিয়েছে, জীবনে অন্তত একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল তারা৷ মধ্য ইউরোপীয় দেশগুলিতে কিশোর কিশোরীদের মৃত্যুর কারণের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আত্মহনন৷ প্রথম স্থানে রয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা৷ এই সমীক্ষার মাধ্যমে বিষয়টিকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা হবে৷ প্রফেসর রোমুয়াল্ড বলেন, ‘‘আত্মহত্যার চিন্তা, আত্মহত্যার চেষ্টা, ব্লেড, ছুরি ইত্যাদি দিয়ে নিজেকে আহত করার প্রবণতা, এই সব বিষয় এত অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে গেছে যে, এই রকম এক সমীক্ষার প্রয়োজন হয়ে পড়ে৷''
কৃত্রিম জগতকে প্রাধান্য দেয়া হয়
অনেক তরুণই বাস্তব জগতের বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের ছেড়ে কৃত্রিম এক ছায়া জগৎ তৈরি করতে পছন্দ করে৷ তারা ইন্টারনেট, ফেসবুক ইত্যাদিতে তাদের বন্ধুবান্ধব খুঁজে নেয়৷ অনেকেই মোবাইল ফোন ছাড়া টিকে থাকতে পারবে না বলে মনে করে৷
প্রফেসর রোমুয়াল্ড জানান, ‘‘বিষয়টি কিছুটা আপাতবিরোধী৷ একদিকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়, অন্যদিকে প্রযুক্তি কখনও বাস্তব বন্ধুবান্ধবের বিকল্প হতে পারে না৷ এই গ্রুপটির মধ্যেই ডিপ্রেশনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় বেশি৷ এ ছাড়া এদের মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকি, ভীতি, ও অন্যান্য মানসিক সমস্যাও তুলনামূলকভাবে বেশি৷''
কোলনের কাছে অবস্থিত সোমনিয়া ক্লিনিকে শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এলেন দ্য গুজমান'এর এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে৷ রোগীদের ক্লিনিকে ভর্তির সময়ে মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ জমা দিতে হয়৷ ডা. গুজমান ১৬ বছর বয়স্ক এক কিশোরীর কথা স্মরণ করেন, যার কাছ থেকে কিছুতেই মোবাইল ফোন সরানো যাচ্ছিল না৷ গুজমান জানান, ‘‘দুই দিন পর সে জানায়, ‘আমি ভাবতেই পারিনি যে এক ঘন্টাও মোবাইল ফোন ছাড়া টিকতে পারব৷' অনেক রোগীর ক্ষেত্রেই এই বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়৷ প্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যমের ওপর তারা যে কতটা নির্ভরশীল, তা তারা বুঝতে পারে এখানে এলে৷ এক সময় তারা অনুভব করতে পারে যে, প্রকৃত কোনো মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলা কিংবা জড়িয়ে ধরার মধ্যে আলাদা এক আনন্দ রয়েছে৷''
ক্লিনিকের চিকিৎসায় ভাল ফল
সোমনিয়া ক্লিনিকের চিকিৎসার সময়সীমা তিন থেকে আট সপ্তাহের মত ৷ বেশিরভাগ রোগীরই বয়স ১২ থেকে ২০ বছরের মধ্যে৷ অনেকেই অহেতুক ভীতি বা উদ্বেগের শিকার৷
বয়ঃসন্ধিকালে সমস্যাটি প্রবল হয়৷ গুজমান বলেন, ‘‘আজকের তরুণরা অত্যন্ত সচল৷ কাল্পনিক জগতে চলাচলে বিশেষ পারদর্শী ও দ্রুতগতি সম্পন্ন৷ মা-বাবারা তাদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন না৷ বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েরা একদিকে মা-বাবার বন্ধন মুক্ত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়৷ অন্যদিকে বয়স্কদের আগের মতই অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসাবে দেখতে চায়৷ এর ফলে পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগের ফারাকটা বড় হয়ে ওঠে৷''
যত তাড়াতাড়ি সমস্যাগুলি বের করা যায়, ততই ভালভাবে সমাধানের পথ পাওয়া যায়৷
প্রফেসর রোমুয়াল্ড এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আমরা স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি, যাতে তারা ছাত্রদের মানসিক বৈকল্য সম্পর্কে সতর্ক হতে পারেন এবং দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারেন৷ যেমন কোনো ছাত্রের আত্মহত্যার ইচ্ছার কথা শুনলে অথবা এ জাতীয় কোনো চিরকুট আবিষ্কার করলে৷ এছাড়া ছাত্রদের নিজেদের অনুভূতি ও সহপাঠীদের সমস্যা সম্পর্কেও সংবেদনশীল করা হয়৷ এতে তারা একে অন্যকে সাহায্য করতে পারে৷
প্রতিবেদন: গুডরুন হাইসে/আরবি
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন