‘জার্মানিকেই ফেবারিট মনে করি’
১১ জুন ২০১৮ডয়চে ভেলে : আপনি তো বাংলাদেশের প্রথম ফুটবলার যিনি দেশের বাইরে পেশাদার ফুটবল খেলতে গিয়েছিলেন৷ ৭০-এর দশকে হংকংয়ে গিয়েছিলেন৷ সেই সময়ের অভিজ্ঞতা যদি আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেন?
কাজী সালাহউদ্দিন : আমরা প্রথম ফুটবল খেলতে গিয়েছি স্বাধীনতার পরপরই, ১৯৭২-৭৩ সালে৷ সেটা পেশাদার ফুটবল ছিল না৷ আর পেশাদার ফুটবল খেলতে গেছি ১৯৭৫-৭৬ সালে হংকংয়ে৷ সেখানে এশিয়ার যত টপ স্টার ছিল, তারা খেলতে যেত৷ তখন হংকংয়েই একমাত্র পেশাদার লিগ হত৷ এখন তো বহু দেশে পেশাদার লিগ হয়৷ আমাদের দেশেও হয়৷ তখন শুধু হংকংয়েই পেশাদার লিগ হত৷ ইউরোপের কিছু স্টারও তখন ওখানে খেলত৷ এখন আমরা যেভাবে ফুটবল খেলি, যেভাবে টেনিং করি, এর সঙ্গে তখনকার খেলার কোনো মিলই নেই৷
আপনি তো দীর্ঘদিন বাফুফের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন৷ এই সময়ের মধ্যে আপনি কি বাংলাদেশের ফুটবলকে একটা পেশাদার কাঠামোর উপর দাঁড় করাতে পেরেছেন?
আমি মনে করি পেরেছি৷ কারণ আমি যখন দায়িত্ব নেই তখন পেশাদার লিগই হচ্ছিল না, লিগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ আজকের যে উপমন্ত্রী জয়, তিনি তো ফুটবল প্লেয়ারদের নিয়ে তখন মিছিল করেছেন লিগের জন্য৷ লিগ না হলে তখন তারা খেতে পারত না৷ আমি আসার পর এমন কোনো সিজন নেই, যে সিজনে লিগ হয়নি, বা মাঠে বল ছিল না, এমন কথা বলতে পারবে না কেউ৷ আগে অপেশাদারভাবে ফেডারেশন চালানো হত৷ এখন সবকিছু হচ্ছে পেশাদারভাবে৷ স্পন্সরশিপ আমরা শিখিয়েছি৷ একটা কথা অবশ্য বলতে পারেন, মাঠে লোক কম৷ এটা আমি স্বীকার করি, আমাদের দেশে এই কালচারটা আছে৷
ইন্টারন্যাশনাল খেলা ছাড়া কেউ লিগ দেখতে আসে না৷ আগে সবাই মাঠে আসত৷ ফেডারেশনের প্রধান হিসেবে আমার দায়িত্ব কোচ এনে দেয়া, ম্যাচের ব্যবস্থা করে দেয়া৷ কিন্তু আমি খেলে দিতে পারব না, গোল করে দিতে পারব না৷ ওটা তাদের করতে হবে৷ এখানে আরেকটা সমস্যা আছে৷ জাতীয় দলের প্লেয়াররা বছরের ১১ মাস থাকে ক্লাবের সঙ্গে, আর আমার সঙ্গে থাকে এক মাস৷ ১১ মাসের ট্রেনিং বা অভ্যাস এক মাসে পরিবর্তন করা খুবই কঠিন৷ এটা কীভাবে ঠিক করা যায়, তা নিয়ে আমরা বসেছিলাম৷ আসলে আমরা যতই কাজ করি, রেজাল্ট না হলে সেটা দেখা যায় না৷
সারা বিশ্বেই তো এমনই হয়৷ সব জায়গাতেই প্লেয়াররা ক্লাবে খেলে এবং একটা নির্দিষ্ট সময়ে দেশের হয়ে খেলতে যায়?
ঠিক বলেছেন৷ ৭ দিন বা ১০ দিন আগে তারা দেশের হয়ে খেলার জন্য যায়৷ দেখুন, লিভারপুলের প্লেয়ারদের কোচিং করাচ্ছেন ক্লপ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্লেয়ারদের কোচিং করান মরিনিয়ো৷ এই প্লেয়ারগুলো তো তৈরি হয়েই আসে৷ কোচ খালি বলে দেয় আমরা এই ফরমেটে খেলব এবং টিমটা সিলেকশন করে দেয়৷ কোচদের কিছুই করাতে হয় না৷ আমরা সেই জায়গায় আসছি৷ আমরা ক্লাবগুলোকে বলছি, তোমরা যদি ট্রেনিং ঠিক না করো তাহলে জাতীয় দলে ভালো প্লেয়ার আসবে না৷ আমাকে জাতীয় দলের ক্যাম্প করতে হচ্ছে৷ এখানে অধিকাংশ প্লেয়ারই ফিট না৷
আমাদের ক্লাবগুলোও তো আপনাদের অধীনে, এখানেও তো ভালো কোচ, ভালো মানের প্লেয়ার আনা সম্ভব?
অবশ্যই সম্ভব৷
সেই কাজটা তাহলে হচ্ছে না কেন?
এখানে শুধু ক্লাবগুলোকে দোষ দিলে হবে না৷ তাদের অর্থনৈতিক কাঠামো খুবই দুর্বল৷ প্রথম ৪/৫টা ক্লাব ছাড়া অধিকাংশ ক্লাব খেলে আর ভাবে কবে লিগ শেষ হবে৷ ফুটবল কিন্তু এখন আর গরিবের খেলা না, বেসিক বেতন সপ্তাহে এক কোটি টাকা এমন ৩০০ প্লেয়ারের নাম আমি আপনাকে বলতে পারব৷ এটা তো অন্য কোন খেলা না, ৭/৮টা দেশ খেলে না৷ এখানে ২১১টা দেশ খেলে৷ সবাই এখানে ফাইট করে৷
ফুটবল নিয়ে হতাশা তো দীর্ঘই হচ্ছে, এটাও তো সত্যি?
হতাশার কিছু নেই৷ হতাশা কবে ছিল না বলেন? আগে এশিয়াতে ১০/১২টা দেশ খেলত৷ এখন সবগুলো দেশ পাগলের মতো খরচ করছে৷ ৩০ মিলিয়ন ডলারে প্লেয়ার বেচাকেনা হচ্ছে৷ আপনাকে এদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হলে তো অস্ত্র নিয়েই যেতে হবে৷ এটা আমি চেষ্টা করছি সরকারকে বুঝাতে, কিছুটা পেরেছি৷ এবার বলেছে বাজেটে দুই টাকা হলেও বরাদ্দ থাকবে৷ আমি একটা কোচ আনতে পারি না, একটা ট্রেইনার আনতে পারি না৷
আমরা আশার আলো দেখব কবে?
আশা করি ৪/৫ বছরের মধ্যেই সাউথ এশিয়ায় একটা ভালো টার্নওভার দেখবেন৷ আমি কথা দিচ্ছি৷ আমাদের অনূর্ধ্ব ১৭ বা ১৯ দল কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় ভালো রেজাল্ট করছে, মেয়েরা ভালো করছে৷ আমি তাদের ২৪ ঘণ্টা ক্যাম্প করাচ্ছি৷ মেয়েরা কোনো ক্লাবের আন্ডারে না৷ আমার তত্ত্বাবধানে তাদের দেশি বিদেশি কোচ দিয়ে ট্রেনিং করাচ্ছি, তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি৷ দেখেন অনূর্ধ্ব ১৭ দল এএফসি কাপে কাতারকে হারিয়েছে ২ গোলে৷ এই দলটাই কিন্তু ২০২২ সালে কাতারের বিশ্বকাপের দল হবে৷ এখানে হতাশ হতাশ বলে মিডিয়া একটা নেতিবাচক রোল প্লে করছে৷ এখানে ৪/৫ জন সাবেক ফুটবলার আমার বিরোধিতা করতে গিয়ে ফুটবলেরই বিরোধিতা করছে৷
দুই একটা সিরিজের ফলাফলে এই ধরনের সমালোচনা বদলে যেতে পারে?
ওটার জন্যই তো পাগলের মতো করে চেষ্টা করছি৷ এই যে বিদেশি কোচ আনছি, তাদের বেতন দেয়ার পয়সা কিন্তু ফেডারেশনের নেই৷ আমি এবং দুই এক জন ভাইস প্রেসিডেন্ট নিজেদের ফান্ড থেকে কোচদের বেতন দিচ্ছি৷
ভালো কিছুর জন্য ফেডারেশন নিশ্চয় কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, তার কিছু যদি বলেন?
বরাদ্দ পেলে তিন বছরের জন্য বাচ্চাদের ক্যাম্পে নিয়ে যাব৷ অনূর্ধ্ব ১৭ আর অনূর্ধ্ব ১৯৷ মেয়েদের কিন্তু আমরা প্রাইভেট ফান্ডিং করছি৷
সরকারি টাকায় তো আর কোন খেলাই চলে না৷ এক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টর ভূমিকা রাখে৷ এখানে ফুটবলে প্রাইভেট সেক্টরের আগ্রহ কেমন?
এখানে তাদের আগ্রহ খুব একটা নেই৷ এটাই আমার দুর্ভাগ্য৷ তাদের আগ্রহ ক্রিকেট নিয়ে৷ ক্রিকেটে রেজাল্টটা তো সহজ, সে কারণে তাদের আগ্রহ ক্রিকেটে৷
সামনেই বিশ্বকাপ, আপনি কোন দলকে ফেবারিট মনে করছেন?
অবশ্যই জার্মানি৷ তবে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, স্পেনকে আপনি ফেলে দিতে পারবেন না৷
কেন এদের ফেবারিট মনে করছেন?
শেষ ৫ বছরে তাদের পারফরমেন্সের কারণে৷ জার্মানির শেষ ৫ বছরের পারফরমেন্স দেখেন৷ তাদের ক্লাব অর্থনৈতিকভাবে খুবই শক্তিশালী৷ ক্লাবগুলো প্লেয়ার তৈরি করে কোচের কাছে পাঠিয়ে দেয়৷ কোচ খালি সিটিংটা দেয়৷ এটা কিন্তু রেয়াল মাদ্রিদের মতো না৷ তারা বাইরে থেকে কোটি কোটি টাকা দিয়ে প্লেয়ার কিনে আনে৷ ম্যুলাররা কিন্তু হোম গ্রোন৷ জার্মান কোচকে কিন্তু খুব বেশি কিছু করতে হয় না৷ অবশ্যই তাঁর ক্রেডিট আছে৷ ক্রেডিট দিচ্ছি না তা নয়৷ অবশ্যই তাঁর ক্রেডিট আছে৷ তাঁর হেল্পিং হ্যান্ড খুবই শক্তিশালী৷
বড় বড় ক্লাবের নিজস্ব অ্যাকাডেমি আছে৷ যেখান থেকে প্লেয়ার তৈরি হয়ে আসে৷ আমরা কি প্লেয়ার তৈরি হওয়ার জায়গাটা তৈরি করতে পেরেছি?
অবশ্যই না৷ বাংলাদেশে একটা রং কনসেপ্ট আছে৷ এখানে মনে করা হয় ফেডারেশন প্লেয়ার তৈরি করবে৷ ইংলিশ ফেডারেশনের একটা অ্যাকাডেমি আছে৷ সেখানে বছরে ৭ মাসই খালি থাকে৷ কেবল জাতীয় দল বছরে ১৫-২০ দিনের জন্য সেখানে আসে৷ সব প্লেয়ার থাকে ক্লাবের অ্যাকাডেমিতে৷ অনেকেই ইংলিশ ফেডারেশনের সভাপতির নামই বলতে পারবেন না৷ ফেডারেশনের কাজটা কি? টিম অর্গানাইজ করা, ডিসিপ্লিন দেখা, বাই লজ দেয়া, কোচ আনা, কোথায় খেলবে সেই ভেন্যু ঠিক করা, কবে খেলবে, কি খাবে এসব দেখা৷ সর্বশেষ ভারতে ইংল্যান্ডের যে অনূর্ধ্ব ১৭ দল চ্যাম্পিয়ন হল সেখানে আর্সেনাল, ম্যান সিটি, ম্যান ইউর প্লেয়ার আছে৷ তারা যে ফাইনাল খেলল স্পেনের সঙ্গে, সেখানে স্পেনের ৫টা প্লেয়ার বার্সেলোনার, তিনটা রেয়াল মাদ্রিদের, ৭টা অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের৷ এরা ফুটবল ফেডারেশন অ্যাকাডেমির কোন খেলোয়াড় না৷
বাফুফে সভাপতির সঙ্গে আপনি কি একমত? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷