জয়নগরের তৃণমূল নেতা কার হাতে খুন?
১৬ নভেম্বর ২০২৩দীপাবলির পরের দিন ভোরে খুন হন দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরের তৃণমূল নেতা সইফুদ্দিন লস্কর। আততায়ী সন্দেহে গণপিটুনিতে মারা হয় শাহাবুদ্দিন লস্করকে। ধরা পড়ে শাহরুল শেখ।
ঘটনার কিছু পরে কাছের একটি গ্রাম দলুয়াখাকিতে গিয়ে উত্তেজিত জনতা সিপিএম সমর্থকদের বাড়িঘর, ধানের গোলা পুড়িয়ে দেয়। এরপর থেকে এই খুনের ঘটনায় পুরোদস্তুর রাজনৈতিক রং লেগেছে।
তৃণমূল বনাম তৃণমূল?
তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য সইফুদ্দিন কি অন্তর্দ্বন্দ্বের শিকার হলেন? নাকি সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীরা তাকে খুন করল? এই দুই পরস্পর বিরোধী অভিযোগ জোরালো হয়েছে খুনের ঘটনা ঘিরে।
সইফুদ্দিনের খুনের পর যে শাহাবুদ্দিনকে গ্রামবাসীরা গণপ্রহারে মেরে ফেলে, সে তৃণমূল কর্মী বলে দাবি করেছেন মৃতের স্ত্রী। তাহলে কি বীরভূমের বগটুই গ্রামের মতোই এটা তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের পরিণতি?
তৃণমূল নেতৃত্ব একথা খারিজ করে দিয়েছেন। তাদের দাবি, এর পিছনে রয়েছে সিপিএম। স্থানীয় বিধায়ক বিভাস সর্দারের দাবি, পঞ্চায়েতের দখল নিতে না পেরে সিপিএম নিশানা করেছিল সইফুদ্দিনকে। তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, "ক্ষমতা পরিবর্তনের পর রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানো ভুল হয়েছিল। সিপিএম এখন আমাদের নেতা-কর্মীদের আক্রমণ করছে।"
লাল বাইকের রহস্য
তৃণমূলের এই তত্ত্বে হাতিয়ার একটি লাল রঙের মোটরবাইক। একাধিক বাইকে গত সোমবার জয়নগরের ঘটনাস্থলে আসে দুষ্কৃতীরা। ঘাতকদের ফেলে যাওয়া একটি মোটর বাইকে নাম লেখা রয়েছে 'মসিবুর রহমান লস্কর'।
এই মসিবুর দলুয়াখাকির বাসিন্দা ও সিপিএম কর্মী হিসেবে পরিচিত। তার নাম এফআইআরে রয়েছে। নিহত সইফুউদ্দিনের এলাকা থেকে ওই গ্রামের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। তৃণমূলের দাবি, সেখান থেকে বাইকে সিপিএমের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা হানা দিয়েছিল। মসিবুর পলাতক, তার ফোনও বন্ধ।
এই বাইকের তত্ত্ব বাম নেতারা উড়িয়ে দিচ্ছেন। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, "তদন্তকে সিপিএমের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই বাইক আমদানি করা হয়েছে। খুনি কখনো নিজের নাম বাইকে লিখে হামলা করতে আসে না। তৃণমূলকে আড়াল করতেই এই চেষ্টা।"
ধৃতের মুখে দুই নাম
হত্যাকাণ্ডের আগে সিসিটিভি ফুটেজে চার দুষ্কৃতীকে দেখা গিয়েছে। বাকি দুজনের খোঁজে তল্লাশি চলছে। ধৃত শাহরুলের মুখে বড়ভাই ও নাসির, এই দুটি শব্দ শোনা গিয়েছে। এই দুজন কি আলাদা না একই ব্যক্তি, তা স্পষ্ট নয়। ধৃতের দাবি অনুযায়ী, বড়ভাই বা নাসির সইফুদ্দিনকে খুনের বরাত দিয়েছিল।
সূত্রের খবর, এই বড়ভাইয়ের আসল নাম আলাউদ্দিন সাঁপুই। যিনি মন্দিরবাজারের টেকপাঁজার বাসিন্দা। এলাকায় সিপিএম নেতা হিসেবে পরিচিত। প্রশ্ন উঠছে, গণপিটুনিতে মৃত শাহাবুদ্দিন যদি তৃণমূলের কর্মী হন, তাহলে তিনি সিপিএমের খুনের পরিকল্পনায় সামিল হলেন কীভাবে?
যে দলুয়াখাকির দিকে তৃণমূলের আঙুল, তার পুড়ে যাওয়া, ভাঙা বাড়িতে দিন দুয়েক পরে ফিরেছেন গ্রামের মহিলারা। পুরুষরা এখনো গ্রামছাড়া। বুধবার পুলিশের উপস্থিতিতে মহিলা ও শিশুদের গ্রামে ফেরানো হয়। গ্রামে পুলিশ পিকেট রাখা হয়েছে। তবে গ্রামবাসীর মাথার উপর ছাদ নেই। রান্নার উপকরণ নেই, জুটছে শুকনো চিঁড়ে-মুড়ি। নিম্নচাপের জন্য আকাশে মেঘ, বৃষ্টি হলে কোথায় আশ্রয় নেবেন তারা?
বগটুই ও জয়নগর
অনেকেই জয়নগরের সঙ্গে বীরভূমের বগটুইয়ের ঘটনার মিল দেখছেন। সেখানে কত বছরের মার্চে তৃণমূল নেতা ভাদু শেখ খুন হওয়ার পর পাল্টা হামলায় পুড়িয়ে মারা হয় কয়েকজন গ্রামবাসীকে। একটি হত্যার পর পুলিশ কেন প্রতিহিংসা রুখতে পারল না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেই ঘটনা স্মরণ করিয়ে রাজ্যের সাবেক পুলিশকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, "বগটুইয়ে ভাদু শেখ খুনের পরে বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। পুলিশ আটকাতে পারেনি। এমনকি দমকল ঢুকতে বাধা দেয়া হয়। জয়নগরে একই ধরনের অভিযোগ উঠছে। কেন সইফুদ্দিন খুনের তিন ঘণ্টা পর পাঁচ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রামে হামলা পুলিশ রুখতে পারল না?"
দলুয়াখাকির বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশের সামনেই হামলাকারীরা তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। পুলিশ বাধা দেয়নি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপে দুষ্কৃতীরা পুড়িয়ে মেরেছিল সিপিএম সমর্থক এক দম্পতিকে। ২০১৮-র সেই খুনের বিচার চেয়ে লড়ছেন তাদের আইনজীবী পুত্র দীপঙ্কর দাস। তিনি বলেন, "সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছে নিরাপত্তা প্রত্যাশা করে। তারা পাশে না থাকলে মানুষ কোথায় যাবে?"
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, "বাম আমলে পুলিশকে দলদাস বানানোর যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তৃণমূলের শাসনে তা সম্পূর্ণ হয়েছে। দলের নির্দেশ ছাড়া পুলিশ কোনো কাজ করতে দেয়া হয় না।"
সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জয়নগরের এই ঘটনা লোকসভা ভোটে বিশেষ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন না সুমন। তার বক্তব্য, "লোকসভার নির্বাচন অনেক বড় ইস্যুর উপর ভিত্তি করে হয়। কিন্তু তৃণমূলের নিচু স্তরে কোন্দল, দুর্নীতি যেভাবে প্রবল হচ্ছে, তা শাসক দলের পক্ষে দুশ্চিন্তার। ভবিষ্যতে এর ফল ভুগতে হতে পারে।"